তাঁরা তিনজন—ইকবাল হোসেন, হাসান আল মামুন ও বিপ্লব ভট্টাচার্য। প্রথমজন সিলেট সফররত বাংলাদেশ ফুটবল দলের ম্যানেজার। বাকি দুজন বাংলাদেশ দলের সহকারী কোচ। তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে বড় মিল—তিনজনই মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে ২০০১ সালে বাংলাদেশের ম্যাচ দুটিতে ছিলেন।
আগামীকাল যখন সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে ২১ বছর পর মাঠে নামবে বাংলাদেশ, তখনো এই তিন সাবেক ফুটবলার থাকছেন বাংলাদেশ দলে। তবে এবার খেলোয়াড় নয়, ভিন্ন ভূমিকায়।
স্বাভাবিকভাবেই ২১ বছর আগে মঙ্গোলিয়ার সঙ্গে খেলার স্মৃতি ফিরে আসছে ইকবাল, হাসান আল মামুন ও বিপ্লবের মনে। সেই সফর ছিল সৌদি আরবের দাম্মামে ২০০২ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে। এশিয়া অঞ্চলের ১০ নম্বর গ্রুপে বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, সৌদি আরব ও মঙ্গোলিয়াকে নিয়ে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় প্রতিটি দল তখন একে অন্যের সঙ্গে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ভিত্তিতে দুটি ম্যাচই খেলেছিল দাম্মামে।
এ সুযোগে মঙ্গোলিয়ার সঙ্গে দুটি ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ-মঙ্গোলিয়া ওই দুবারই মুখোমুখি হয়েছে। প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ জেতে ৩-০ গোলে। ফিরতি ম্যাচে জেতা যায়নি। বাজে ফুটবল খেলে শেষ পর্যন্ত ২-২ গোলে ড্র করে বাংলাদেশ।
২১ বছর পার হলেও হাসান আল মামুনের কাছে মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। গতকাল রোববার সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ দলের অনুশীলনের ফাঁকে মামুনকে অতীতে ফিরিয়ে নিলে বলেন, ‘মঙ্গোলিয়ার সঙ্গে আমরা প্রথম লেগে ৩-০ গোলে জিতেছিলাম। সেটি ছিল গ্রুপে আমাদের সেরা ম্যাচ। দুর্দান্ত ফুটবল খেলেছিলাম সেদিন আমরা। মনে আছে, প্রথম লেগে ভিয়েতনামের সঙ্গে ড্র করি আমরা। সেই ড্রয়ে আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ে (পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের কোচ হওয়া ব্রাজিলিয়ান এডসন সিলভা ডিডো ছিলেন ভিয়েতনামের সেই দলের কোচ)। মঙ্গোলিয়াকে যখন পেয়েছি সামনে, আত্মবিশ্বাস বেড়েছে আরও। কোচ জর্জ কোটান আমাকে বলেছিলেন, ‘তুই দুটি ম্যাচ খেলেছিস। আমার দেখা এই ম্যাচটায় (মঙ্গোলিয়ান সঙ্গে) বেশি ভালো খেলেছিস। ওই ম্যাচে জোড়া গোল করা আলফাজ ভাইকে পরে অফার করেছিল সৌদি আরবের এক ক্লাব।’
সেই স্মরণীয় ম্যাচের আরেক সেনানী ইকবাল হোসেন ২১ বছর পর এখন বাংলাদেশ দলকে দেখছেন কাছ থেকে। ম্যানেজারের ভূমিকায় মাঠের বাইরের বিষয়গুলো দেখভাল করছেন এখন। ২১ বছর পেছন ফিরিয়ে নিলে সুখস্মৃতিতে ভাসেন ইকবাল।
মঙ্গোলিয়াকে হারানোর সেই গল্প বলেন, ‘মঙ্গোলিয়া তখন একেবারে ফেলনা দল ছিল না। ওদের ফিটনেস তখনো ভালো ছিল, এখনো ভালো। শারীরিকভাবে ওরা কিছুটা এগিয়ে আমাদের চেয়ে। আসলে তখন আমরা প্রথম লেগে সহজে জিতেছিলাম আমাদের দলে অনেক মানসম্পন্ন খেলোয়াড় ছিল বলে। জর্জ কোটানের মতো কোচ আর আমাদের চেষ্টারই ফল সেই জয়।’
কিন্তু সময়ের স্রোতে বাংলাদেশ দল এখন আর জোর দিয়ে বলতে পারে না—মঙ্গোলিয়াকে হারাবই! আর এটাই ভীষণ পীড়া দিচ্ছে ইকবালকে, ‘২১ বছর পরও যদি মঙ্গোলিয়াকে হারানোর ব্যাপারে আমাদের শতভাগ আত্মবিশ্বাস না থাকে তাহলে আর কী বলব। মঙ্গোলিয়াকে হারাতে না পারলে এই ফুটবলারদের খেলাই ছেড়ে দেওয়া উচিত!’
মঙ্গোলিয়া তখন একেবারে ফেলনা দল ছিল না। ওদের ফিটনেস তখনো ভালো ছিল, এখনো ভালো।
মাঠের এক পাশে দাঁড়িয়ে ইকবাল যখন বলছিলেন এসব কথা, মাঠে তখন ৩ গোলকিপারকে কোচিং করানো নিয়ে ব্যস্ত বিপ্লব ভট্টাচার্য। তিনিও ছিলেন সৌদি আরবে সেই স্মরণীয় সফরে। তবে বাংলাদেশের পোস্টে তখন নির্ভরতার প্রতীক আমিনুল। প্রথম লেগে সৌদি আরবের কাছে ৩-০ গোলে হারা ম্যাচে আমিনুল নজরকাড়া নৈপুণ্য দেখিয়ে সৌদি ক্লাব থেকে প্রস্তাবও পান। প্রবাসীদের কাছে হয়ে ওঠেন প্রিয় ফুটবলার।
সেসব স্মৃতি নিয়ে বিপ্লব বলছিলেন, ‘তখন আমাদের দলটা ছিল অসাধারণ। কী সব খেলোয়াড় ছিল আপনি দেখুন...আমিনুল, হাসান আল মামুন, ইকবাল, আলফাজ। কাকে রেখে কার কথা বলব!’
১২ ফেব্রুয়ারি, ২০০১...
প্রিন্স আহম্মদ বিন ফাহাদ স্টেডিয়ামে সেদিন অসাধারণ আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলছিল বাংলাদেশ। মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে প্রথম লেগে ২ গোল করে ম্যাচসেরা আলফাজ। ৪২ মিনিটে প্রায় ১৯ গজ দূর থেকে তাঁর বাঁ পায়ের ভলিতে আসে প্রথম গোল। পরদিন প্রথম আলোর ম্যাচ রিপোর্টে লেখা হয়েছিল, ‘শিল্পমণ্ডিত এক গোল...।’ হাসান আল মামুনের পাস থেকে বল পেয়ে সাইফুর রহমান মনির সঙ্গে দেয়াল করে বল বাতাসে বাঁক খাইয়ে আলফাজ তুলে দিয়েছিলেন জালে।
৭৮ মিনিটে হাফ লাইনের নিচ থেকে বল ধরে আলফাজ। ডান প্রান্ত বরাবর দুর্দান্ত এক দৌড়ে তাঁর লক্ষ্যভেদ। ৮৬ মিনিটে তৃতীয় গোলটি লেখা রয়েছে সাইফুর রহমান মনির বদলি নামা রোকনুজ্জামান কাঞ্চনের নামের পাশে। এটি আসলে হতে পারত লেফটব্যাকে খেলা ফিরোজ মাহমুদ টিটুর গোল। টিটুর শট মঙ্গোলিয়ার গোলকিপার পাঞ্চ করলে তা কাঞ্চনের বুকে লেগে ঢুকে যায় জালে। দ্বিতীয়ার্ধে টিটু মিস করেন একটি সহজ গোল। তাঁর দুর্বল হেড পরাস্ত করতে পারেনি একাকী দাঁড়িয়ে থাকা মঙ্গোলিয়ার গোলকিপারকে।
তবে সেদিন ম্যাচে ম্যাচে প্রথম আক্রমণ শাণায় মঙ্গোলিয়াই। তাদের একটি আক্রমণ কর্নারের বিনিময়ে রুখতে গিয়ে কুঁচকিতে চোট পেয়ে মাঠ ছাড়েন ডিফেন্ডার আবু ফয়সাল। তাঁর বদলি নেমে দারুণ খেলেন নজরুল। দুই উইং দিয়ে আক্রমণে মঙ্গোলিয়াকে সেদিন বিপর্যস্ত করে ফেলে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ দলে সেদিন খেলেছেন: আমিনুল, হাসান আল মামুন, রজনী, সুজন, টিটু, ফয়সাল (নজরুল ১৩ মিনিট), ইকবাল, মতিউর মুন্না (আমিন রানা ৮৬ মিনিট), মিন্টু, মনি (কাঞ্চন), আলফাজ।
১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০০১...
মঙ্গোলিয়ার সঙ্গে ফিরতি ম্যাচে বাংলাদেশকে আর চেনা যায়নি। এ ম্যাচ শেষ বাঁশির কয়েক সেকেন্ড আগে বাংলাদেশের জালে বল পাঠিয়ে উল্লাসে মেতে ওঠেন মঙ্গোলিয়ার অধিনায়ক বুমান উচরাল। ড্র করেই সেদিন জয়ের আনন্দ পেয়েছিল মঙ্গোলিয়া।
ওই ম্যাচের আগপর্যন্ত ৩৮টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে মঙ্গোলিয়া জিতেছিল মাত্র ২টি। সেই দুটি জয় আবার দুর্বল ম্যাকাও ও গুয়ামের বিপক্ষে। অথচ তখনকার সময়ে মঙ্গোলিয়া তাদের চেয়ে ৪৩ ধাপ এগিয়ে থাকা বাংলাদেশের সঙ্গে ড্র করে ফেলে। সেই মঙ্গোলিয়া এখন পর্যন্ত ৭৯টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে জিতেছে মাত্র ১৮টি। ড্র ৫। হার ৫৩। ৯০ গোল করে খেয়েছে ২৩০টি।
যা-ই হোক, ২০০১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ফিরতি ম্যাচে দাম্মামে বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথমে গোল করেছিল মঙ্গোলিয়াই। ৭৯ মিনিটে সমতায় ফেরে বাংলাদেশ। সাইফুর রহমান মনিকে মঙ্গোলিয়ার ডিফেন্ডার অলটান টোগোস বক্সের মধ্যে ফেলে দিলে বাংলাদেশ পেনাল্টি পায়। কিন্তু তখন দলের আত্মবিশ্বাস এতটাই ভেঙে পড়েছিল যে কেউ নাকি পেনাল্টি নিতে চাইছিলেন না। শেষ পর্যন্ত ডিফেন্ডার মোহাম্মদ সুজন এসে পেনাল্টিতে গোল করে উদ্ধার করেন বাংলাদেশকে।
পেনাল্টিতে সমতা এলেও এরপরই প্রতিপক্ষের এক ডিফেন্ডারকে অহেতুক ফাউল করে লাল কার্ড দেখেন আহত হয়ে মাঠ ছাড়া ইকবালের বদলি নামা কাঞ্চন। ৮২ মিনিটে পাভেলের কর্নার থেকে মনি হাওয়ায় একটু বাঁক খাইয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাইড ভলিতে ২-১ করেন সুজন। সমতা ফেরাতে মরিয়া মঙ্গোলিয়া সফল হয়েছে অতিরিক্ত ৪ মিনিট সময়ের শেষ কয়েক সেকেন্ডে। নাটকীয়ভাবে ম্যাচ ২-২।
সেই ম্যাচ খেলা ইকবাল, হাসান আল মামুনরা এত বছর পর পেছনে তাকিয়ে বলছেন, সেদিন পাকিস্তানের সহকারী রেফারি মোহাম্মদ ইকবালের বিমাতাসুলভ আচরণের শিকার হয়েছিল বাংলাদেশ। ৫৭ মিনিটে মনির থ্রু থেকে আলফাজের দেওয়া গোল অফসাইডের কারণে বাতিল করে দেন রেফারি। তবে আসল সত্যিটা ছিল অগোছালো ফুটবল খেলে ড্রয়ে হতাশা নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল বাংলাদেশ। আগামীকাল নিশ্চয়ই তেমন হতাশায় ডুবতে চাইবেন না জামাল-নাবিবরা!