কে জিতবে ইউরো? প্রশ্নটা আসলেই প্রায় ১০০ কোটি টাকার। ইউরোর চ্যাম্পিয়ন দল ১ কোটি ইউরো পাবে, বাংলাদেশি মুদ্রায় সেটা তো প্রায় ১০০ কোটি টাকাই। সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু হবে ১১ জুন, শেষ ১১ জুলাই। ইউরোতে অংশ নিতে যাওয়া ২৪টি দলের খুঁটিনাটি জেনে নিলে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সহজ হতে পারে আপনার জন্য।
২০০২ বিশ্বকাপে তুরস্ককে তৃতীয় বানানোর পেছনে কোন কোচের ভূমিকা ছিল, মনে পড়ে?
রুস্তু রেকবার, হাকান সুকুর, হাসান সাস, এমরে বেলোজোগ্লু—সেই বিশ্বকাপে তুরস্কের সাড়া–জাগানো এসব খেলোয়াড়ের ভিড়ে কোচ সেনোল গুনেসের নাম কয়জনই–বা মনে রাখেন? তবে মনে রেখেছিল তুরস্কের জনগণ। আর মনে রেখেছিল বলেই দেশে কিংবদন্তির মর্যাদা পাওয়া এই কোচকে সম্মান জানানো হয় তাঁর নামে স্টেডিয়াম বানিয়ে। তুরস্কের ক্লাব ত্রাবজোনস্পোর এখন যে মাঠে খেলে, সে মাঠের নাম রাখা হয়েছে গুনেসের নামানুসারে। সেই গুনেসের হাতেই আবারও পড়েছে তুরস্কের দায়িত্ব। এবার আশা, ইউরোতেও এই দল নিয়ে হয়তো কিছু একটা করে দেখাতে পারবেন এই কোচ।
দল: তুরস্ক
ফিফা র্যাঙ্কিং: ২৯
দলে আছেন যাঁরা
গোলকিপার
উরজান চাকির (ত্রাবজোনস্পোর), মের্ত গুনোক (ইস্তাম্বুল বাশেকশেহির), আলতে বায়িনদির (ফেনেরবাচে)
সেন্টারব্যাক
চাগলার সয়ুঞ্জু (লেস্টার সিটি), মেরিহ দেমিরাল (জুভেন্টাস), কান আয়হান (সাসসুয়োলো), ওজান কাবাক (লিভারপুল)
রাইটব্যাক/রাইট উইংব্যাক
জেকি চেলিক (লিল), মের্ত মুলদুর (সাসসুয়োলো)
লেফটব্যাক/লেফট উইংব্যাক
রিদভান ইলমাজ (বেসিকতাস), উমুত মেরাস (লা হাভরা)
সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার/ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার
ওকায় ইয়োকুসলু (ওয়েস্ট ব্রমউইচ অ্যালবিওন), ওজান তুফান (ফেনেরবাচে), তায়লান আনাতালি (গালাতাসারাই), ইরফান জান কাভেচি (ফেনেরবাচে), ওরকুন কোকচু (ফেইনুর্ড), দোরুখান তোকোয়েজ (বেসিকতাস)
অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার
হাকান চালহানোলু (এসি মিলান), আব্দুলকাদির ওমুর (ত্রাবজোনস্পোর)
উইঙ্গার/ওয়াইড মিডফিল্ডার
হালিল দেরভিশোগলু (ব্রেন্টফোর্ড), কেরেম আকতুর্কোগ্লু (গালাতাসারাই), জেঙ্গিজ উইন্দা (লেস্টার সিটি), ইউসুফ ইয়াজিকি (লিল)
স্ট্রাইকার
বুরাক ইলমাজ (লিল), কেনান কারামান (ফরচুনা ডুসেলডর্ফ), এনেস ইউনাল (হেতাফে)
কোচ
সেনোল গুনেস
অধিনায়ক
বুরাক ইলমাজ
ইউরোয় সেরা সাফল্য
তৃতীয় (২০০৮)
গ্রুপে প্রতিপক্ষ
ইতালি (১১ জুন)
ওয়েলস (১৬ জুন)
সুইজারল্যান্ড (২০ জুন)
শক্তি
নিঃসন্দেহে দলটার সবচেয়ে বড় শক্তি রক্ষণভাগ। সব সময় এই রক্ষণ নিয়ে ভাবনায় থাকা তুরস্কের সবচেয়ে বড় ভরসায় জায়গা এখন এটাই। সয়ুঞ্জু, দেমিরাল, চেলিক, কাবাক প্রত্যেকেই বড় ইউরোপিয়ান ক্লাবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। ইউরো বাছাইপর্বে ১০ ম্যাচ খেলে মাত্র তিন গোল হজম করেছে তুরস্ক। ফ্রান্সের বিপক্ষে তারা দুই ম্যাচে নিয়েছে চার পয়েন্ট। রক্ষণভাগ এই ফর্ম ধরে রাখতে পারলে এবার ইউরোয় ভালো কিছুর স্বপ্ন দেখতেই পারে তুরস্ক।
দুর্বলতা
রক্ষণভাগ দলের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা হলেও রক্ষণের প্রত্যেক খেলোয়াড়ই মাঝেমধ্যে মেজাজ হারিয়ে বসেন। ক্লাব ক্যারিয়ারে কাবাক, সয়ুঞ্জু, দেমিরালের মনোযোগ ও মেজাজ হারিয়ে কার্ড দেখেছেন, এমন অনেকবার দেখা গিয়েছে। ইউরোর কোনো ম্যাচে যদি এমন হয়, তাহলে আগে থেকেই চাপে পড়বে দলটি।
গোলের মূল উৎস বুরাক ইলমাজের বয়স ৩৬ বছর। দীর্ঘ একটা মৌসুমের পর ইউরোয় গোল করার জন্য কতটা ফিট থাকেন এই স্ট্রাইকার, সে প্রশ্নও তোলা যায়। ইলমাজ ছাড়া এনেস উনালের মতো অন্য স্ট্রাইকারদের গোল করার হার ঠিক আশাপ্রদ নয়। রক্ষণভাগের অন্যান্য পজিশনের তুলনায় লেফটব্যাক পজিশনও বেশ দুর্বল এই দলটার।
সম্ভাব্য একাদশ ও খেলার কৌশল (৪-১-৪-১/৪-২-৩-১)
এক বছর ধরে কোচ সেনোল গুনেস দলকে বিভিন্ন ছকে খেলাচ্ছেন। তবে ৪-২-৩-১ ছকেই তুলনামূলকভাবে স্থির থেকেছেন বেশি। সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার ওজান তুফানের মুভমেন্টের ওপর নির্ভর করে ছকটা ৪-১-৪-১ হয়ে যায় আক্রমণে। গোলকিপার হিসেবে অভিজ্ঞ মের্ত গুনোকের জায়গায় এখন ত্রাবজোনস্পোরের উরজান চাকিরের ওপর বেশি ভরসা করছেন গুনোল। গুনোকের চেয়ে বল পায়ে চাকির বেশি দক্ষ, এর সঙ্গে শট থামানোর দুর্দান্ত ক্ষমতা আছেই। গত বছরও নিজেদের দ্বিতীয় গোলকিপার হিসেবে চাকিরকে চেয়েছিল লিভারপুল। শেষমেশ চুক্তিটা না হলেও চাকির যে দুর্দান্ত, সেটা এই এক তথ্যেই প্রমাণ হয়ে যায়।
চাকিরের সামনে সেন্ট্রাল ডিফেন্সে জুটি বাঁধবেন লেস্টার সিটির চাগলার সয়ুঞ্জু, জুভেন্টাসের মেরিহ দেমিরাল ও লিভারপুলের ওজান কাবাকের মধ্যে যেকোনো দুজন। তিনজনই দুর্দান্ত। মেরিহ দেমিরালের শারীরিক শক্তি ও উচ্চতা, কড়া ট্যাকল করার ক্ষমতা প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়ের জন্য বিভীষিকার মতো। জুভেন্টাসে জর্জো কিয়েল্লিনির জায়গায় তো এমনি এমনি তাঁকে খেলানো হচ্ছে না!
একই কথা বলা যায় লেস্টারের সয়ুঞ্জুর ক্ষেত্রেও। সয়ুঞ্জু আবার বল পায়েও অসাধারণ। পাকা প্লেমেকারের মতো বল পায়ে ওপরে নিখুঁত পাস দেওয়ার ক্ষমতা আছে সয়ুঞ্জুর। ঠিক এ কারণেই মৌসুমের শুরুতে বেনফিকার রুবেন দিয়াসকে কেনার আগে সয়ুঞ্জুকে দলে চেয়েছিলেন ম্যানচেস্টার সিটির কোচ পেপ গার্দিওলা। ওদিকে কাবাকের বয়স দুজনের তুলনায় কম হলেও লিভারপুলের মতো ক্লাবে গত জানুয়ারি থেকে খেলছেন। বেশ প্রতিভাবান এই সেন্টারব্যাকের ওপর গুনেসের ভরসাও অনেক। রাইটব্যাক জেকি চেলিক রক্ষণ ও আক্রমণে সমানভাবে দক্ষ, নজরে এসেছেন টটেনহামের মতো ক্লাবের। লেফটব্যাক হিসেবে খেলার সম্ভাবনা বেশি উমুত মেরাসের।
মাঝমাঠে প্রথাগত ট্যাকলপ্রিয় রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডারের মতো রক্ষণকে বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন ওকায় ইকোকুসলু। পাশে ওজান তুফান বক্স-টু-বক্স মিডফিল্ডারের ভূমিকা পালন করেন। তুফান সুযোগ পেলে যেন ওপরে উঠে আক্রমণে যোগ দিতে পারেন, সেটা নিশ্চিত করেন ইয়োকুসলু।
একক স্ট্রাইকার হিসেবে নেইমার-এমবাপ্পেদের হারিয়ে সদ্য ফরাসি লিগ আঁ-জয়ী ৩৬ বছর বয়সী বুরাজ ইলমাজের খেলা নিশ্চিত। লিগে ১৬ গোল করেছেন। তুরস্কের আক্রমণের বড় ভরসাও তিনি। পেছনে তিন আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে ইলমাজের ক্লাব-সতীর্থ ইউসুফ ইয়াজিকি, লেস্টারের জেঙ্গিজ উইন্দা, এসি মিলানের হাকান চালহানোলু, ফরচুনার কেনান কারামানের মধ্যে যেকোনো তিনজন খেলবেন।
সেট পিস থেকে শুরু করে আক্রমণভাগে গোল বানিয়ে দেওয়া ও নিখুঁত ক্রস—সৃষ্টিশীলতায় চালহানোলু এই দলের মূল খেলোয়াড়। ওদিকে ইয়াজিকির সঙ্গে ইলমাজের বোঝাপড়া বেশ ভালো, হুটহাট থ্রু বল দেওয়ার পাশাপাশি ওপরে উঠে প্রয়োজনীয় গোলও করতে পারেন। ওদিকে ইউন্দার গতি তুরস্কের আক্রমণকে অন্য মাত্রা দেয়।
‘দায়িত্ব নেওয়ার পর ইউরোয় সুযোগ পাওয়াই ছিল আমার একমাত্র লক্ষ্য। আমরা এমন এক স্কোয়াড বানিয়েছি, যাদের সবাই পছন্দ করে ও ভরসা রাখতে পারে। আমরা সে অনুযায়ী নিজেদের পরিকল্পনা নির্ধারণ করেছি। কিছু চোট সমস্যা ছিল, যা ঠিক হয়ে গিয়েছে’
প্রত্যাশা ও বাস্তবতা
বিশ্বমানের রক্ষণভাগে ভর করে অন্তত কোয়ার্টারে ওঠার আশা করতেই পারে তুরস্ক। তবে আক্রমণভাগে যথেষ্ট গোল করার মতো খেলোয়াড়ের অভাব ভোগাতে পারে দলটিকে।