তাহলে কি তর্জন-গর্জনই সার ইব্রাহিমোভিচের
‘যত দিন সম্ভব, আমি খেলে যেতে চাই। বাস্তবতা হচ্ছে আমার চেয়ে ভালো কাউকে খেলতে দেখছি না, তাই এখনও খেলে যাচ্ছি...’
কয়েকদিন আগে উয়েফাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কথাগুলো বলেছিলেন সুইডিশ স্ট্রাইকার ইব্রাহিমোভিচ। কথাতেই স্পষ্ট, নিজের চেয়ে ভালো ফুটবলার হিসেবে কাউকে দেখছেন না তিনি। মেসি, রোনালদো, লেভানডফস্কি, নেইমার কিংবা হালের এমবাপ্পে, হরলান্ড, ডি ব্রুইনা, সালাহ ; কাউকেই চোখে পড়ছে না কিংবদন্তি এই সুইডিশ স্ট্রাইকারের।
অবশ্য কোনোদিন চোখে পড়েওনি। দলের অবস্থা যতই খারাপ হোক না কেন, গোল করার ক্ষমতা দিনকে দিন যতই কমতে থাকুক না কেন, ইব্রাহিমোভিচের মুখ চলেছে সমানে। ধারালো তরবারির মতো। মাঠের খেলায় দল হারছে হারুক, একের পর এক প্রতিযোগিতা থেকে দল বাদ পড়ছে পড়ুক— মুখের খেলায় হার মানা যাবে না মোটেও।
ঈশ্বর থেকে শুরু করে রাজা, রাজপুত্র, ফেরারি, সিংহ— হেন কোনো বিশেষণ নেই যা দিয়ে নিজেকে বিশেষায়িত করেননি এই স্ট্রাইকার। সারাজীবন মেসি-রোনালদোর চেয়ে নিজেকে সেরা মেনেছেন। কখনো ব্যালন ডি’অর না জেতার অপ্রাপ্তিকে নিজের ব্যর্থতা বলে মানেননি, বরং সেই পুরষ্কারের দুর্ভাগ্য হিসেবে মেনেছেন।
যত দিন সম্ভব, আমি খেলে যেতে চাই। বাস্তবতা হচ্ছে আমার চেয়ে ভালো কাউকে খেলতে দেখছি না, তাই এখনও খেলে যাচ্ছি
হুট করে যে এমন স্বভাব হয়েছে তাঁর, ব্যাপারটা তেমন নয়। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই কথার তুবড়ি ছুটিয়েছেন।
নিজের দেশের ক্লাব মালমোর হয়ে যখন আলো ছড়াচ্ছিলেন, নজরে পড়েছিলেন আর্সেনাল কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গারের। ইব্রাহিমোভিচের প্রতিভা সম্পর্কে ওয়েঙ্গার আগে থেকেই জানতেন, তাও সামনাসামনি প্রমাণ দেখতে চেয়েছিলেন। ‘ইব্রা কখনও অডিশন দেয় না’, বলে ওয়াঙ্গারকে মুখের ওপর না করে দিয়ে আয়াক্সে নাম লেখান ইব্রাহিমোভিচ।
পরের ২২ বছর ফুটবলপ্রেমীদের একের পর এক এমন অমর বাণীর জুগিয়ে গেছেন। কোনোটা জোগান দিয়েছে হাস্যরসের, আবার কোনোটা নিখাদ বিরক্তির উদ্রেক করেছে। যার সর্বশেষ সংযোজন একদম ওপরের বক্তব্যটা। কথাগুলো ইব্রাহিমোভিচ বলেছিলেন পোল্যান্ডের বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের প্লে-অফ ম্যাচের ঠিক আগে আগে। যে ম্যাচে হারলেই বাদ পড়বে সুইডেন। আর বাদ পড়লে ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ খেলার আশা চিরতরে মিটে যাবে ইব্রাহিমোভিচের।
স্বাভাবিক, ৪০ বছর বয়সী ইব্রাহিমোভিচ নিজেকে যতই বিশ্বসেরা বলে মনে করুন না কেন, আরও চার বছর পর দেশের হয়ে বিশ্বকাপ খেলবেন, এমন আশা অন্তত তিনিও করেন না। ক্যারিয়ারের সম্ভাব্য শেষ বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন যেখানে সুতোয় ঝুলছে, এমন সঙিন পরিস্থিতিতেও লেভানডফস্কি বা তাঁর দলের প্রতি বিন্দুমাত্রও শ্রদ্ধাবোধ ঝরেনি ইব্রাহিমোভিচের কণ্ঠ থেকে। উল্টো নিজের চেয়ে ভালো কাউকে খেলতে দেখেন না বলে খেলে যাচ্ছেন— এমন কথা বলে যথারীতি বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন।
কিন্তু যে খেলোয়াড় নিজের চেয়ে ভালো কাউকে খেলতে দেখেন না, ওই খেলোয়াড়কেই এমন মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে নব্বই মিনিট খেলানোর সাহস দেখালেন না কোচ ইয়ানে অ্যান্ডারসন। রাখলেন বেঞ্চে। ৭৯ মিনিটে ইব্রাহিমোভিচকে যখন মাঠে নামান হলো, ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। লেভানডফস্কি আর জিয়েলিনস্কির জাদুতে ২-০ গোলে এগিয়ে পোল্যান্ড। পরের ১১ মিনিটে দলকে জেতাতে পারে এমন কিছু করে দেখাতে পারলেন না সাবেক অধিনায়ক। দুটো পাস দেওয়ার চেষ্টা করে সফল হলেন একবার। গোল বা গোলসহায়তা দূরে থাকুক, পোস্টে শটই নিতে পারলেন না। কিছুক্ষণ পর দেখলেন লেভানডফস্কিদের উল্লাস। নিজের কথা আবারও গিলতে হলো ইব্রাকে।
অবশ্য আগে মুখের কথায় হাতিঘোড়া মেরে খেলার মাঠে কিছু করে না দেখাতে পারার ‘অভ্যাস’টা ইব্রাহিমোভিচের আজকের নয়। ১৯৯৯ সালে ক্যারিয়ার শুরু করা ইব্রাহিমোভিচ ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় সফল হলেও কখনও ইউরোপ–সেরা হতে পারেননি। যখন যে ক্লাবে খেলেছেন, সে ক্লাব কখনও ওই সময়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে পারেনি। বরং ইব্রা ক্লাব ছাড়ার পরই ঐ দলের কপাল খুলেছে। ইন্টার মিলান ছেড়ে বার্সেলোনায় গেলেন ২০০৯ সালে, পরের বছরই ট্রেবল জিতল নেরাজ্জুরিরা। কোনোরকমে এক বছর বার্সায় কাটিয়ে পেপ গার্দিওলাকে গালমন্দ করে বার্সেলোনা ছাড়লেন পরের বছর, সঙ্গে সঙ্গে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতল কাতালানরা।
এমন না যে ইব্রাহিমোভিচ চ্যাম্পিয়নস লিগে দুর্দান্ত খেলার পরেও তাঁর দলগুলো কিছু করতে পারে না। চ্যাম্পিয়নস লিগে ইব্রার সর্বোচ্চ সাফল্য সাকল্যে একবার সেমিফাইনাল খেলা, তাও সেই ২০১০ সালে। সে ম্যাচে গোল পাননি। চ্যাম্পিয়নস লিগের নকআউট রাউন্ডে ২০১৬ সালের পর কোনো গোল নেই তাঁর। কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যায়ে গোল পেয়েছেন তিনটি। ৪৮ গোলের বাকিগুলো হয় গ্রুপপর্বে, না হয় দ্বিতীয় রাউন্ডে করা। মুখের কথার মতো সেসব ম্যাচে আরেকটু জ্বলে উঠলে নিশ্চিতভাবেই মাত্র একবার সেমিফাইনাল খেলতেন না ইব্রাহিমোভিচ!
২০১৭ সালে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে দ্বিতীয় সারির প্রতিযোগিতা ইউরোপা লিগ জিতেছিলেন, সেটাই ইউরোপীয় আসরে সর্বোচ্চ সাফল্য হয়ে আছে।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারও একই ব্যর্থতার গান গাইছে। ১৯৯৯ সালে ক্যারিয়ার শুরু করা ইব্রাহিমোভিচ শুধু ২০০৬ সালে বিশ্বকাপেই খেলেছেন। সেবার ফ্রেডি লিউংবার্গ আর হেনরিক লারসনের কল্যাণে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছিল সুইডেন, ইব্রার পা থেকে আসেনি কোনো গোল। দ্বিতীয় রাউন্ডে জার্মানির কাছে ২-০ গোলে হেরে বিদায় নেওয়া সুইডেন মাথা কুটে মরেছে ইব্রাহিমোভিচের পা থেকে একটা গোল দেখার আশায়। এরপর আর একটা বিশ্বকাপও খেলা হয়নি তাঁর।
অবশ্য আগে মুখের কথায় হাতিঘোড়া মেরে খেলার মাঠে কিছু করে না দেখাতে পারার ‘অভ্যাস’টা ইব্রাহিমোভিচের আজকের নয়। ১৯৯৯ সালে ক্যারিয়ার শুরু করা ইব্রাহিমোভিচ ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় সফল হলেও কখনও ইউরোপ–সেরা হতে পারেননি। যখন যে ক্লাবে খেলেছেন, সে ক্লাব কখনও ওই সময়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে পারেনি
২০১৪ সালে রোনালদোর পর্তুগালের বিপক্ষে বাছাইপর্বের প্লে-অফ খেলার আগে ঘোষণা দিলেন, ‘ঈশ্বর ছাড়া কেউ জানেন না কে বিশ্বকাপ খেলবেন’— সাংবাদিক উত্তর দিলেন, ‘ঈশ্বরকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা তো কঠিন ব্যাপার।’ জবাবে ইব্রাহিমোভিচ জানালেন, ‘আপনি তাঁর সঙ্গেই কথা বলছেন!’
যদিও রোনালদোর অতিমানবীয় হ্যাটট্রিকের সামনে জোড়া গোল করা ‘ঐশ্বরিক’ ইব্রাহিমোভিচকে ম্যাচ শেষে ম্লানই দেখাচ্ছিল। দুবছর পর ২০১৬ ইউরোতে গ্রুপপর্বে গোল দেওয়া তো দূর, তিন ম্যাচ মিলিয়ে পোস্ট বরাবর শটও মারতে পারেননি। প্রথম রাউন্ড থেকে বাদ পড়ে রেগেমেগে অবসর নিয়ে নিলেন। পরে তাঁকে ছাড়াই ২০১৮ বিশ্বকাপে জায়গা করে নিল সুইডেন। উত্তরসূরিদের সাফল্য দেখেই কি না, আবারও দলে ফেরার খায়েশ হলো তাঁর। ততদিনে কোচ ইয়ানে অ্যান্ডারসন বুঝে গেছেন, ইব্রাহিমোভিচকে দলের প্রধান খেলোয়াড় বানিয়ে রাখলে হয়তো সাফল্যের মুখ দেখা হবে না। ইব্রাকে ছাড়াই সুইডেনকে ২০১৮ বিশ্বকাপ আর ২০২১ ইউরো খেলান অ্যান্ডারসন। আর এবার তো বিশ্বকাপ খেলার সর্বশেষ সুযোগটাও হারালেন।
কিছুদিন পর হয়তো আসলেই বুটজোড়া তুলে রাখবেন। ক্যারিয়ার-সায়াহ্নে চাওয়া-পাওয়ার হিসেব মেলাতে বসলে ইব্রাহিমোভিচের মনে একটুও কী শূন্যতা জম্ম নেবে না? খেলোয়াড়ি জীবনের লেনদেন শেষ করে পাদপ্রদীপের আড়ালে, ক্যামেরা-ঝলকানির সীমানা ছাড়িয়ে ইব্রা যখন একান্তই নিজের বিবেকের মুখোমুখি হবেন, এসব ব্যর্থতার কথা চিন্তা করে একটুও কি খচখচানি কাজ করবে না?