জিদানের দুই ‘রিয়াল’ কেমন ছিল?
রিয়াল মাদ্রিদ বলছে, এটা জিনেদিন জিদানের ঘর হয়েই থাকবে। এ কথা আগেও দুবার শোনা গেছে। ২০০৬ সালে যখন খেলোয়াড় জিদান অবসর নিয়েছিলেন, আরেকবার ২০১৮ সালে সবাইকে চমকে দিয়ে যখন ক্লাবের কোচের দায়িত্ব থেকে সরে গিয়েছিলেন। আজ যখন দ্বিতীয় দফা কোচ হিসেবে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জিদান, তখনো এ কথা সত্যি বলেই মানতে হচ্ছে।
রিয়াল মাদ্রিদ তাঁর ঘর। বারবার বলেছেন, ভবিষ্যতেও বলবেন। তবে এবারের বিদায় আর চমক জাগাচ্ছে না। বহুদিন ধরেই আভাস মিলছিল ঘরে শান্তি পাচ্ছেন না। যে কোচ টানা তিন চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার পর নিজের স্বস্তিকে প্রাধান্য দিয়েছেন, তিনি যে শিরোপাশূন্য মৌসুম কাটানোর পর এমন সিদ্ধান্ত নেবেন, তাতে আর চমক কী!
কেন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এ নিয়ে বহু আলোচনা হতে পারে। তার আগে দেখে নেওয়া যাক কোচ হিসেবে রিয়ালে কেমন কাটল জিদানের দুই অধ্যায়।
সাফল্যের দিক থেকে রিয়ালের সর্বকালের সেরা কোচ হয়ে গেছেন জিদান। দুই মেয়াদে ক্লাবের হয়ে ২৬৩ ম্যাচের দায়িত্বে ছিলেন। রিয়ালের ইতিহাসেই তাঁর চেয়ে বেশি ম্যাচের দায়িত্বে ছিলেন মাত্র একজন। টানা ১৫ বছর রিয়ালের মতো ক্লাবের দায়িত্বে থেকে অবিশ্বাস্য কীর্তি গড়েছিলেন মিগেল মুনোজ।
ম্যাচের হিসাবে জিদানের চেয়ে অনেক বড় ব্যবধানে (৩৪২ ম্যাচ) এগিয়ে আছেন ষাট-সত্তরের দশকে রিয়ালকে কোচিং করানো স্প্যানিশ কোচ। রিয়ালের হয়ে মুনোজের ৬০৫ ম্যাচ ডাগআউটে থাকার রেকর্ড কেউ যদি ভাঙতে পারতেন, সেটা জিদান। কিন্তু তিনিও হাল ছেড়ে দিলেন আবার।
রিয়ালের হয়ে ৩৫৭ ম্যাচ জিতেছেন মুনোজ। এত ম্যাচে কোচের দায়িত্বেই থাকতে পারেননি জিদান। তবে জয়ের হারের দিক থেকে মুনোজের চেয়ে এগিয়ে জিদান। ৬৬ শতাংশ ম্যাচে জয় পেয়েছেন জিদান। ওদিকে ১৬ মৌসুমে রিয়ালকে ৫৯ ভাগ ম্যাচে জিতিয়েছেন মুনোজ। জয়ের হারের দিক থেকে জিদানকে শুধু একজনই টেক্কা দিতে পেরেছেন। তিনি স্পেশাল ওয়ান, জোসে মরিনিও। ১৭৮ ম্যাচ রিয়ালের দায়িত্বে থাকা মরিনিও ৭২ শতাংশ ম্যাচেই জয় পেয়েছেন।
জয়ের হারের দিক থেকে মরিনিও এগিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু রিয়ালের কোচ হিসেবে থাকার জন্য যেটা জরুরি, সেটা করে দেখিয়েছেন জিদান। তিন বছরে রিয়ালে তিনটি শিরোপা জিতেছেন মরিনিও। ওদিকে মাত্র আড়াই বছরের প্রথম মেয়াদেই জিদান শিরোপা জিতেছিলেন ৯টি। পরের মেয়াদেও জিতেছেন দুটি শিরোপা—গত মৌসুমের লিগ ও স্প্যানিশ সুপারকাপ।
২০২০–২১ মৌসুম, অর্থাৎ সদ্য সমাপ্ত মৌসুমে লিগে ক্লাবের গোলের সংখ্যা ও খেলোয়াড়ের চোটের সংখ্যা পাল্লা দিয়ে না এগোলে হয়তো কোচিং ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো একটা পূর্ণ মৌসুম শিরোপাহীন থাকার অভিজ্ঞতা পেতে হতো না জিদানকে। তবু ১১ শিরোপা জিতে রিয়ালের দ্বিতীয় সফল কোচ জিদান। সেরা মুনোজের ১৪ শিরোপা এসেছে ১৬ মৌসুমে। রিয়ালের হয়ে প্রতি ২৩ ম্যাচে জিদানের এক শিরোপার রেকর্ড অক্ষুণ্ণ থাকবে বহুদিন।
২০১৯ সালে ভয়ংকর দুঃসময়ে ক্লাবকে খাদের কিনার থেকে ফেরাতে আবার এসেছিলেন। দুই বছরের মধ্যেই আবার প্রিয় ক্লাবকে বিদায় দিয়ে দিচ্ছেন। এর পেছনের কারণ চাইলেই বলে নেওয়া যায়। প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পরও নিজের পছন্দের খেলোয়াড় কিনতে না পাওয়া। দলে পর্যাপ্ত গোল স্কোরার পাননি, এক করিম বেনজেমার ওপরই ভর করে চলেছেন দুই বছর। আক্রমণভাগে যাঁকে জিদান পছন্দ করে এনেছিলেন, সেই এডেন হ্যাজার্ড দুই বছরে চোটের কারণে মাঠের চেয়ে মাঠের বাইরেই সময় কাটিয়েছেন। এর প্রভাব মাঠের পারফরম্যান্সেও পড়েছে।
জিদানের দুই মেয়াদে রিয়ালের খেলার ধরনের পার্থক্য পরিসংখ্যানেই টের পাওয়া যায়।
প্রথম মেয়াদে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো একজন ছিলেন। গ্যারেথ বেলও ছিলেন ছন্দে। বেনজেমা ছাড়াও বেঞ্চে ছিলেন আলভারো মোরাতার মতো খেলোয়াড়েরা। হামেস রদ্রিগেজ, ইসকো, মার্কো আসেনসিওরাও নিয়মিত গোল পেতেন। সে দল রক্ষণের চেয়ে আক্রমণেই মন বেশি দিত। ইউরোপের শীর্ষ লিগে টানা গোল দেওয়ার রেকর্ড গড়েছিল সে দল।
নতুন মেয়াদে জিদান বুঝতে পেরেছিলেন, গোল করার লোক যেহেতু নেই, গোল ঠেকানোতেই মন দেওয়া জরুরি। তাই দ্বিতীয় মেয়াদে অনেক বেশি রক্ষণাত্মক খেলিয়েছেন দলকে। সেটা নিচে তাকালেই বোঝা যায়।
রক্ষণ সামলে প্রয়োজন অনুযায়ী গোল বের করে নেওয়া রিয়ালকে লিগে সাফল্য এনে দিয়েছে। কিন্তু চ্যাম্পিয়নস লিগে সাফল্য এনে দিতে পারেনি এই রক্ষণভাগ। আক্রমণভাগের ব্যর্থতা, বয়স বেড়ে যাওয়া এক স্কোয়াড আর বেঞ্চে ভরসা রাখার মতো খেলোয়াড় না থাকা প্রভাব ফেলেছে জিদানের দলের পারফরম্যান্সে। এ কারণেই প্রথম মেয়াদের চেয়ে ৩৫ ম্যাচ কম খেলেও দ্বিতীয় মেয়াদে বেশি হেরেছে তাঁর দল।
এ কারণেই মাত্র আড়াই বছরে ৯ শিরোপা জিতে তাক লাগানো জিদানকে তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে মাত্র দুই শিরোপাতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। ব্যর্থতার ক্লান্তিতে তাই আবার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন। গন্তব্য এখনো জানা যাচ্ছে না।