কে জিতবে ইউরো? প্রশ্নটা আসলেই প্রায় ১০০ কোটি টাকার। ইউরোর চ্যাম্পিয়ন দল ১ কোটি ইউরো পাবে, বাংলাদেশি মুদ্রায় সেটা তো প্রায় ১০০ কোটি টাকাই। সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু হবে ১১ জুন, শেষ ১১ জুলাই। ইউরোতে অংশ নিতে যাওয়া ২৪টি দলের খুঁটিনাটি জেনে নিলে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সহজ হতে পারে আপনার জন্য।
ইউরো ও বিশ্বকাপ মিলিয়ে টানা সাতবার অন্তত সেমিফাইনালে ওঠা দলটা গত বিশ্বকাপে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। বাদ পড়েছিল প্রথম রাউন্ড থেকেই। তবে জার্মানরা সর্বশেষ যে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে প্রথম রাউন্ডে বিদায় নিয়েছিল, পরের টুর্নামেন্টেই উঠেছিল সেমিফাইনালে। ২০০৪ ইউরোর প্রথম রাউন্ডে বিদায় নেওয়ার পর উঠেছিল পরের ইউরোর ফাইনালেও।
এই ইউরোর পর জাতীয় দলের দায়িত্ব ছাড়তে যাওয়া ইওয়াখিম ল্যুভ শিষ্যদের কাছ থেকে অমন একটা ফলাফলই চাইবেন। কিংবা কে জানে, বিদায়ী গুরুদক্ষিণা হিসেবে ল্যুভের অধরা ইউরো শিরোপাটাই এনে দিলেন ক্রুস-কিমিখরা! দলটা যেহেতু জার্মানি, সেটা হলেও অবিশ্বাস্য কিছু হবে না।
দল: জার্মানি
ফিফা র্যাঙ্কিং: ১২
দলে আছেন যাঁরা
গোলকিপার
ম্যানুয়েল নয়্যার (বায়ার্ন মিউনিখ), বার্নড লেনো (আর্সেনাল), কেভিন ট্র্যাপ (আইনট্রাখট ফ্রাঙ্কফুর্ট)
সেন্টারব্যাক
ম্যাটস হুমেলস (বরুসিয়া ডর্টমুন্ড), আন্তোনিও রুডিগার (চেলসি), নিকলাস সুলা (বায়ার্ন মিউনিখ), ম্যাথিয়াস জিন্টার (বরুসিয়া মনশেনগ্লাডবাখ), রবিন কখ (লিডস ইউনাইটেড), এমরে জ্যান (বরুসিয়া ডর্টমুন্ড)
রাইটব্যাক/রাইট উইংব্যাক
ইয়োসুয়া কিমিখ (বায়ার্ন মিউনিখ), লুকাস ক্লস্টারম্যান (আরবি লাইপজিগ)
লেফটব্যাক/লেফট উইংব্যাক
রবিন গসেন্স (আতালান্তা), মার্সেল হালস্টেনবার্গ (আরবি লাইপজিগ), ক্রিস্টিয়ান গুন্টার (ফ্রাইবুর্গ)
সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার/ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার
টনি ক্রুস (রিয়াল মাদ্রিদ), ইলকায় গুন্দোয়ান (ম্যানচেস্টার সিটি), লিওন গোরেৎস্কা (বায়ার্ন মিউনিখ), ফ্লোরিয়ান নয়্যাহাউস (বরুসিয়া মনশেনগ্লাডবাখ)
অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার
টমাস মুলার (বায়ার্ন মিউনিখ), জামাল মুসিয়ালা (বায়ার্ন মিউনিখ), কাই হাভার্টজ (চেলসি)
উইঙ্গার/ওয়াইড মিডফিল্ডার
সার্জ ন্যাব্রি (বায়ার্ন মিউনিখ), লিরয় সানে (বায়ার্ন মিউনিখ), জোনাস হফম্যান (বরুসিয়া মনশেনগ্লাডবাখ)
স্ট্রাইকার
টিমো ভেরনার (চেলসি), কেভিন ফলান্ড (মোনাকো)
কোচ
ইওয়াখিম ল্যুভ
অধিনায়ক
ম্যানুয়েল নয়্যার
ইউরোয় সেরা সাফল্য
চ্যাম্পিয়ন (১৯৭২, ১৯৮০, ১৯৯৬)
গ্রুপে প্রতিপক্ষ
ফ্রান্স (১৫ জুন)
পর্তুগাল (১৯ জুন)
হাঙ্গেরি (২৩ জুন)
শক্তি
নিঃসন্দেহে দলের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা মিডফিল্ড। ক্রুস, কিমিখ, গুন্দোয়ান, গোরেৎস্কা, নয়্যাহাউস—কাকে ছেড়ে কাকে খেলাবেন ল্যুভ? দলের মিডফিল্ডের অবস্থা কাগজে-কলমে এতটাই ভালো, হয়তো বিশ্বের অন্যতম সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার কিমিখকে খেলতে হবে রাইটব্যাক হিসেবে। কিমিখ মিডফিল্ডে না খেললেও ক্রুস, গুন্দোয়ান ও গোরেৎস্কার মিডফিল্ড নিজেদের দিনে বিশ্বের সেরা হওয়ার সামর্থ্য রাখে।
২০১৮ বিশ্বকাপের পর অধিনায়ক ম্যানুয়েল নয়্যারকে নিয়ে যে সমালোচনা শুরু হয়েছিল, সেগুলো থামাতে এক বছরও সময় নেননি কিংবদন্তি গোলকিপার। এই দলটার অন্যতম শক্তির জায়গা তাই নয়্যার। হাভার্টজ, নয়্যাহাউস, মুসিয়ালা, গসেন্সের মতো তুলনামূলক নতুন খেলোয়াড়েরাও নিজেদের দিনে জার্মানিকে উদ্ধার করার সামর্থ্য রাখেন।
দুর্বলতা
জার্মানির এই দলটা রক্ষণে দুর্বল। ফিলিপ লাম, জেরোম বোয়াতেং ও পার মার্টেস্যাকার যাওয়ার পর থেকেই তেমন কোনো নির্ভরযোগ্য সেন্টারব্যাক পাচ্ছে না দলটা। নিকলাস সুলা মাঝে মাঝে ভরসা জোগালেও, মোটেও ধারাবাহিক নন। হামেলসও আগের মতো তেমন নির্ভরতা দিতে পারেন না। চেলসিতে কোচ হিসেবে টমাস টুখেলকে পাওয়ার পর থেকে রুডিগার যেমন দুর্দান্ত খেলছেন, সেটা জার্মানির ভক্তদের আশা বাড়াচ্ছে।
জার্মানির ফুলব্যাক হিসেবে যারা খেলেন, তাঁরাও ঠিক বিশ্বমানের নন। ক্লস্টারম্যান, হালস্টেনবার্গ মূলত সেন্টারব্যাক হিসেবে খেলেন ক্লাবে, একই কথা বলা যায় জিন্টার-গুন্টারের ক্ষেত্রেও, যাঁরা আক্রমণে মোটেও পারদর্শী নন। আধুনিক ফুলব্যাকের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো রক্ষণের পাশাপাশি সমানতালে আক্রমণ করে যাওয়া। এ কারণে মিডফিল্ড থেকে কিমিখকে টেনে এনে রাইটব্যাকে খেলাতে পারেন ল্যুভ। আরেক দিকে আতালান্তার রবিন গসেন্সের দিকেও ভরসা করতে পারেন জার্মান কোচ, একই কারণে।
ডিফেন্ডারদের নিয়ে এই অনিশ্চয়তার কারণেই কয়েক বছর ধরে ৪-২-৩-১, ৪-৩-৩, ৩-৫-২, ৩-৪-৩; নানান ছকে দলকে খেলিয়ে যাচ্ছেন ল্যুভ। দলের মূল স্ট্রাইকার টিমো ভেরনার এবার চেলসির হয়ে গোল করার দিক দিয়ে অতটা সফল মৌসুম কাটাননি। বিশ্বকাপে একটা গোলও না করতে পারা ভেরনার যদি এবারও গোলশূন্য থাকেন, চিন্তায় পড়ে যেতে পারেন ল্যুভ।
সম্ভাব্য একাদশ ও খেলার কৌশল (৪-৩-৩)
কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন ছকে দলকে খেলালেও শেষমেশ ৪-৩-৩ বা ৪-২-৩-১ ছকে এই ইউরোতে জার্মানিকে খেলাতে পারেন ল্যুভ। গোলকিপার নয়্যারের সামনে সেন্টারব্যাক হিসেবে আবারও দলে ডাক পাওয়া হামেলসের সঙ্গে জুটি বাঁধতে পারেন সদ্যই চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা রুডিগার। দুই ফুলব্যাক হিসেবে খেলতে পারেন কিমিখ (ডানে) ও গসেন্স (বাঁয়ে)। সাধারণত দুই ফুলব্যাক হিসেবে ক্লস্টারম্যান, জিন্টার, হালস্টেনবার্গ, জ্যান, গুন্টার—অনেককে খেলালেও বর্তমান স্কোয়াডে তুলনামূলকভাবে সমানতালে আক্রমণ ও রক্ষণ করে যাওয়ার মতো এই দুজনই আছেন।
কিমিখ রাইটব্যাকে চলে এলে মাঝমাঠে ক্রুসের সঙ্গে খেলানো হতে পারে বায়ার্নের দুর্দান্ত বক্স-টু-বক্স মিডফিল্ডার লিওন গোরেৎস্কাকে। ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে ইলকায় গুন্দোয়ান এই মৌসুমে দুর্দান্ত খেললেও ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে তাঁর খেলার মান প্রশ্নবিদ্ধ। স্পেনের বিপক্ষে ৬-০ গোলে জার্মানির হার, কিংবা চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে চেলসির কাছে সিটির হার—দুই ম্যাচেই জার্মানি ও সিটির হারের অন্যতম কারণ ছিল গুন্দোয়ানের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে খেলা। তাই তাঁর জায়গায় গোরেৎস্কা হতে পারেন মূল একাদশের একজন আদর্শ সংযোজন।
দলে টমাস মুলার যেহেতু আছেন, আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে তিনিই খেলবেন। বিশেষ করে দুই মৌসুম ধরে বায়ার্নের হয়ে যেমন দুর্দান্ত খেলেছেন, এরপর তাঁকে বেঞ্চে বসিয়ে রাখতে চাইবেন না ল্যুভ। দুই উইঙ্গার ও এক স্ট্রাইকার হিসেবে খেলার জন্য লড়াই হবে লিরয় সানে, সার্জ ন্যাব্রি, টিমো ভেরনার ও কাই হাভার্টজের মধ্যে। ভেরনারকে স্ট্রাইকার বলা হলেও অনেকটা পেছন থেকে, বাঁ দিক হয়ে খেলতে পছন্দ করেন। তাই তাঁকে বাঁ দিকে খেলালে সানে কে বেঞ্চে চলে যেতে হতে পারে।
সে ক্ষেত্রে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের মতো মূল স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতে পারেন হাভার্টজ। আর ভেরনার-ন্যাব্রি-সানে ত্রয়ী খেললে ভেরনারের ফেলে আসা জায়গায় প্রায়ই উঠে আসতে হবে ন্যাব্রিকে। সে ক্ষেত্রে আক্রমণভাগের তিনজনের মধ্যে সেই রসায়ন থাকা বড্ড জরুরি।
আমাদের অনেক খেলোয়াড় আছে, যাদের মধ্যে নেতৃত্বগুণ আছে, জেতার মানসিকতা আছে। হ্যাঁ, আমি নয়্যার, ক্রুস, কিমিখ, রুডিগার, জিন্টার, গুন্দোয়ানদের কথাই বলছি। ২০১২ বা ২০১৪ সালে আমাদের দলের মনোবল যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে
প্রত্যাশা ও বাস্তবতা
পরপর দুই টুর্নামেন্টে প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নেবে জার্মানরা, এমনটা ভাবা কষ্টকর। কিন্তু তাদের গ্রুপে সর্বশেষ ইউরোজয়ী পর্তুগাল ও বিশ্বকাপজয়ী ফ্রান্সের উপস্থিতি এই ভাবনাকেও অমূলক বলতে দিচ্ছে না। জার্মানি দলের চোখ যথারীতি শিরোপার দিকেই থাকলেও দেশটার জনগণ শিরোপার ব্যাপারে অতটা আশাবাদী হতে পারছেন না।
জার্মান ম্যাগাজিন কিকারের করা এক জরিপে উঠে এসেছে মাত্র ২ শতাংশ মানুষ জার্মানির হাতে ইউরোর শিরোপা দেখছেন। অন্তত ৯০ শতাংশ মানুষ ভাবছেন, কোয়ার্টারেই শেষ হয়ে যাবে জার্মানির যাত্রা। নিজেদের অধারাবাহিক ফর্ম ও কৌশল নিয়ে ল্যুভের অনিশ্চয়তা ঝামেলায় ফেলতে পারে দলটাকে। তবে যা–ই হোক, অন্তত তৃতীয় দলগুলোর মধ্যে সেরা হয়েও পরের রাউন্ডে যাওয়ার চেষ্টা থাকবে দলটা। আর একবার গ্রুপপর্বের ঝামেলা মেটাতে পারলে আর নিজেদের সঠিক ফর্মুলা বের করতে পারলে ফাইনালেও উঠে যেতে পারে দলটা।