জাভিকে এনে লাভ হবে বার্সেলোনার?
কয়েক দিন ধরেই বাতাসে একটা গুঞ্জন ভাসছে।
বার্সেলোনার কোচ হিসেবে ফিরতে পারেন সাবেক কিংবদন্তি মিডফিল্ডার জাভি হার্নান্দেজ। কয়েক বছর আগেও বার্সেলোনার জার্সি গায়ে মেসি-ইনিয়েস্তাদের সঙ্গে খেলতেন যিনি। এখন আছেন কাতারে, খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ারের ইতি টেনে কাতারের আল সাদ ক্লাবের দায়িত্ব নিয়েছেন কোচ হিসেবে। গত বছর আল সাদকে একটা সুপার কাপও জিতিয়েছেন।
এদিকে বার্সেলোনার অবস্থা তথৈবচ। কোচ আর্নেস্তো ভালভার্দে কখনই পাঁড় বার্সেলোনা ভক্তদের পছন্দের কোচ ছিলেন না। ফলে বার্সা কোনো ম্যাচ হারলেই তাঁকে নিয়ে শুরু হয় সমালোচনা। মেসিরা কোনো ম্যাচ জিতলেও শান্তি নেই। বার্সার স্টাইল যে আর আগের মতো দৃষ্টিসুখকর নেই, সে কারণেও গালি খেতে হয় ভদ্রলোককে। ভালভার্দের অধীনে ঘরোয়া ফুটবলে বার্সেলোনা নিয়মিত সাফল্য পেলেও হতাশ করেছে ইউরোপীয় পর্যায়ে। সেমিফাইনালে, কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বাদ পড়েছে। বাদ পড়ার ধরনগুলোও জ্বালা ধরিয়েছে বার্সা সমর্থকদের বুকে। বৃহস্পতিবার স্প্যানিশ সুপারকোপার সেমিফাইনালে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে হেরেছে বার্সেলোনা। তাও আবার ম্যাচের ৮১ মিনিট পর্যন্ত এগিয়ে থেকে শেষের নয় মিনিটে দুই গোল খেয়ে ম্যাচ হেরেছেন মেসিরা।
স্বভাবতই মুণ্ডুপাত শুরু হয়েছে ভালভার্দের। আর তাঁর জায়গাতেই নিজেদের সাবেক সফল মিডফিল্ডার জাভি হার্নান্দেজকে আনতে চাইছে বার্সেলোনা, এমন খবর এসেছে। আর এই গুঞ্জনটা গত কয়েক বছর ধরে বিশ্ব ফুটবলে চলতে থাকা একটা ফর্মুলারই আরেকটা উদাহরণ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে যেন।
কোন ফর্মুলা?
ক্লাবগুলো এখন বেদবাক্যের মতো একটা কথা বিশ্বাস করে, নিজেদের সাবেক খেলোয়াড়কে কোচ হিসেবে ফেরালেই সাফল্য পাওয়া যাবে, কেননা সাবেক খেলোয়াড়দের চেয়ে ক্লাবকে ভালো আর কেউ চেনেন না। এই এক ফর্মুলার ওপর ভিত্তি করে ক্লাবগুলো এখন নিজেদের সাবেক যেকোনো সফল খেলোয়াড়কে কোচ বানাতে বেশি আগ্রহী, অন্য যেকোনো পোড় খাওয়া কোচকে নিয়োগ দেওয়ার চেয়ে। এই হিড়িকটা শুরু হয়েছে মূলত গত দশকে। আর জাভি-বার্সেলোনা গুঞ্জন এটাই নিশ্চিত করল, হিড়িকটা এখনই কমছে না।
তবে নিজেদের সাবেক সফল খেলোয়াড়কে কোচ হিসেবে ফিরিয়ে এনে সাফল্যের মুখ দেখার উদাহরণ কিন্তু শুধুই এই শতাব্দীর না। রিয়াল মাদ্রিদের কিংবদন্তি ম্যানেজার মিগুয়েল মুনোজের কথাই ধরুন। ধারাটা বলতে গেলে তিনিই শুরু করে দিয়েছিলেন। রিয়ালের হয়ে খেলোয়াড় হিসেবে চার বার লিগ ও তিন বার ইউরোপিয়ান কাপ জেতা মুনোজ ম্যানেজার হিসেবেও লিগ জিতেছেন নয় বার। ইউরোপিয়ান কাপ জিতেছেন দুই বার। সঙ্গে অন্যান্য শিরোপা তো ছিলই। খেলোয়াড় হিসেবে সেল্টিকে সফল জক স্টাইন একই ক্লাবে ম্যানেজার হিসেবে একবার ইউরোপিয়ান কাপ ও দশবার লিগসহ জিতেছেন অসংখ্য ট্রফি। এরপরই বলতে হয় কেনি ডালগ্লিশের কথা। লিভারপুলের ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই খেলোয়াড় ম্যানেজার হিসেবে একই দলকে জিতিয়েছেন তিন লিগসহ একাধিক শিরোপা। স্টুয়া বুখারেস্টের হয়ে তত দিনে দেমেরিখ জেনেইও একই কাজ করে ফেলেছেন।
এরপরই আসে ইয়োহান ক্রুইফের কথা। আর দশটা ম্যানেজারের মতো যিনি শুধু ক্লাবের হয়ে ট্রফিই জিতেননি, যে ক্লাবে খেলোয়াড় হিসেবেও সফল ছিলেন, সে ক্লাবের গোটা দর্শনটাই বদলে দিয়েছেন লা মাসিয়া অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠা করে। ক্রুইফ যখন বার্সেলোনায় রাজত্ব করছিলেন, বায়ার্ন মিউনিখের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার তখন ম্যানেজার হিসেবে বায়ার্নে একই কাজ করছিলেন। আর ইতালিতে করছিলেন ফাবিও ক্যাপেলো। এককালে এসি মিলানের মিডফিল্ড নিয়ন্ত্রণ করা এই খেলোয়াড় পরে মিলানের হয়ে জিতেছেন একাধিক শিরোপা। মিলানের আরেক মিডফিল্ডারও একই কাজ করে গেছেন, তিনি কার্লো আনচেলত্তি। শতাব্দীর শুরুর দিকে রিয়ালের ইতিহাসের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার ভিসেন্তে দেল বস্কও লস ব্লাঙ্কোসদের ম্যানেজার হয়ে সফলতার মুখ দেখেছেন।
এরপরেই দৃশ্যপটে আবির্ভাব ঘটে পেপ গার্দিওলার। গুরু ক্রুইফের মতো এই গার্দিওলাও শুধু শিরোপা জেতার মধ্যে নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বার্সেলোনার সাবেক এই মিডফিল্ডার রাইকার্ড-পরবর্তী যুগে আত্মপরিচয়ে ভুগতে থাকা বার্সেলোনাকে দিয়েছেন নতুন দিশা। কোচিংয়ের দুনিয়ায় উন্মোচন করেছেন এক নতুন দিগন্ত।
আর গার্দিওলার সাফল্যের পর থেকেই ক্লাবগুলোর মধ্যে যেন এই ধারণাটা প্রকট হয়ে যায়, সাফল্য আনতে চাইলে সাবেক খেলোয়াড়কে ধরে আনা ছাড়া বিকল্প নেই। গত দশকে সাবেক খেলোয়াড়দের কোচ বানিয়ে আনার হিড়িকটা যেন গত যেকোনো সময়ের চেয়েই বেড়েছে অনেক। ফলে এখন প্রায়ই দেখা যায়, কয়েক বছর আগেও যারা নিয়মিত বিভিন্ন ইউরোপীয় দলের দায়িত্বে ছিলেন, তারা চাকরি খুঁজে পাচ্ছেন না।
>খেলোয়াড় হিসেবে যে ক্লাবে খেলে গেছেন, সে ক্লাবেই কোচ হিসেবে সাফল্যের মুখ দেখা, যেমন তেমন কথা নয়। সফল খেলোয়াড়েরা যে নিজেদের ক্লাবে ফিরে এসে সফল কোচও হতে পারেন, ইয়োহান ক্রুইফ, কেনি ডালগ্লিশ বা ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের কল্যাণে আমরা আগেই জেনেছি। তবে নিজেদের সফল খেলোয়াড়কে কোচ বানিয়ে আনার হারটা ক্লাবগুলোর মধ্যে আগে এত বেশি ছিল না। নতুন শতাব্দীতে, বিশেষ করে গত দশকে সফল খেলোয়াড়দের কোচ হিসেবে ফেরানোর হিড়িকটা আরও বেড়েছে যেন। আর এটা শুরু হয়েছে মূলত বার্সেলোনার হয়ে পেপ গার্দিওলার আকাশছোঁয়া সাফল্যের পর। এই ফর্মুলা অনুসরণ করে ক্লাবগুলো আসলে কতটুকু সাফল্য পাচ্ছে?
মরিসিও পচেত্তিনো টটেনহামের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর বসে আছেন। জুভেন্টাস ও এসি মিলানের সফল কোচ ম্যাসিমিলিয়ানো আলেগ্রি তো সেই গত ছয় মাস ধরে বেকার। ইতালিয়ান লিগের অন্যতম প্রজ্ঞাবান ম্যানেজার লুসিয়ানো স্পালেত্তির চাকরি নেই। আর্সেনালের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বসে আছেন উনাই এমেরিও। বার্সেলোনাকে গত মৌসুমে কোপা দেল রের ফাইনালে হারানো সাবেক ভ্যালেন্সিয়ার কোচ মার্সেলিনোও বসে আছেন। পিএসজি থেকে বিদায় নিয়েছেন প্রায় চার বছর হতে চলল, তাও লরাঁ ব্লাঁ কে ম্যানেজার হিসেবে কারওর পছন্দ হয় না।
গত মৌসুমে বার্সেলোনার মাঠে গিয়ে দৃষ্টিনন্দন ফুটবল খেলিয়ে রিয়াল বেতিসকে জিতিয়ে আনা কিকে সেতিয়েনও বেকার। একই অবস্থা সাবেক মিলান কোচ মার্কো জাম্পাওলো ও সাবেক এভারটন কোচ মার্কো সিলভার। রোমার হয়ে বার্সেলোনাকে চ্যাম্পিয়নস লিগে হারানো ইউসেবিও ডি ফ্রান্সেসকো ও চেলসির হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা রবার্তো দি মাত্তেও, কারওরই চাকরি নেই। স্যাম অ্যালার্ডাইস, মার্ক হিউজ, দুঙ্গা, হোসে পেকারম্যান, লিওনার্দো জার্ডিম, ম্যানুয়েল পেলেগ্রিনি, মির্সেয়া লুসেচকু, সেজারে প্রানদেল্লি, রেমি গার্দে, ক্রিস হিউটন, লুই ফেলিপে স্কলারি, হোর্হে সাম্পাওলি, লুইজি দেলনেরি, টনি পিউলিস, হুয়ান্দে রামোস, রজার শ্মিট, স্টিভ ম্যাকলারেন, হাভি গ্রাসিয়া, কিকে সানচেস ফ্লোরেস, পাবলো মাচিন, বার্নড সুস্টার, ফেলিক্স মাগাথ, হেক্টর কুপার-বেকার কোচদের তালিকা যেন শেষ হওয়ার না! অথচ কয়েক বছর আগেও ক্লাবগুলো নিজেদের সাবেক খেলোয়াড়দের দিকে না তাকিয়ে এদেরকেই চাকরি দিত।
এখন এদের জায়গায় দেখা যাচ্ছে আনকোরা সব নতুন মুখ। দেখা যাচ্ছে সাবেক খেলোয়াড়দের। হিসেব করে দেখুন, শেষ কবে চেলসি বা আর্সেনালের মতো ক্লাবকে দেখেছেন নিজেদের সাবেক খেলোয়াড়কে কোচের দায়িত্ব দিতে? কিংবা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে? এখন সেটাই হচ্ছে। প্রত্যেক ক্লাবেই ম্যানেজারের দায়িত্বে আছেন সাবেক খেলোয়াড়।
কিন্তু চোখ বন্ধ করে এই একই ফর্মুলা অনুসরণ করা কি আসলেই ক্লাবগুলোকে সাফল্য এনে দিচ্ছে? আপনি যদি জুভেন্টাস, রিয়াল মাদ্রিদ বা নিদেনপক্ষে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের সমর্থক হয়ে থাকেন, তাহলে এক গাল হেসে এই প্রশ্নের উত্তর দেবেন, ‘দিচ্ছে।’
নিজের সাবেক খেলোয়াড় জিনেদিন জিদানকে কোচ বানিয়ে টানা তিন বার চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে রিয়াল মাদ্রিদ। ওদিকে নিজেদের সাবেক অধিনায়ক আন্তোনিও কন্তেকে ম্যানেজার বানিয়ে নিজেদের ইতিহাসের অন্যতম বাজে সময় থেকে বেরিয়ে এসে তিন বার লিগ জিতেছে জুভেন্টাস। সাবেক খেলোয়াড় ডিয়েগো সিমিওনের কৌশলের ওপর ভর করে স্প্যানিশ লিগে বার্সেলোনা ও রিয়াল মাদ্রিদের দ্বৈরথে ছেদ টেনেছে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ। আয়াক্সের ফ্রাঙ্ক ডি বোর, পিএসভির ফিলিপ কোকু, লাজিওর সিমোনে ইনজাঘি কিংবা ফেইনুর্দের জিওভান্নি ফন ব্রঙ্কহর্স্ট, প্রত্যেকেই খেলোয়াড়ি জীবনে এসব ক্লাবে যেমন সফল ছিলেন, তাদের সেই সাফল্য অনূদিত হয়েছে ম্যানেজার হিসেবেও।
মুদ্রার ওপিঠও আছে। বায়ার্ন মিউনিখের দিকেই তাকিয়ে দেখুন। নিজেদের সাবেক মিডফিল্ডার নিকো কোভাচকে কোচ বানিয়ে এনে এক বছরের মাথায় ছাঁটাই করেছে তারা। এসি মিলান তো আরও এক কাঠি সরেস। গত দশ বছরে নিজেদের সাবেক পাঁচ খেলোয়াড়কে কোচ বানিয়েছে তারা-ফিলিপ্পো ইনজাঘি, ক্লারেন্স সিডর্ফ, ক্রিস্টিয়ান ব্রচ্চি, জেনারো গাত্তুসো ও লিওনার্দো। প্রত্যেকেই ব্যর্থ হয়েছেন। শুধু ব্যর্থ হয়েছেন বলাটা ভুল হবে, বেশ বাজেভাবেই ব্যর্থ হয়েছেন। ওলে গুনার সুলশার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে এক রকম খাবি খাচ্ছেন, যেকোনো মুহূর্তে মাথায় নেমে আসতে পারে ছাঁটাইয়ের খড়্গ। টটেনহাম পচেত্তিনোর আগে সাবেক খেলোয়াড় টিম শেরউডকে ম্যানেজার করতে গিয়ে সাফল্যের মুখ দেখেনি। রিয়াল মাদ্রিদের সাবেক খেলোয়াড় হুলেন লোপেতেগি গত বছর রিয়ালের দায়িত্ব নেওয়ার পর কী বাজেভাবে ব্যর্থ হয়েছেন, সবাই দেখেছে।
আয়াক্সকে ইউরোপা লিগের ফাইনালে তোলা পিটার বশচ ডর্টমুন্ডের দায়িত্ব নেওয়ার পর নিজেদের সাবেক খেলোয়াড় মার্সেল কাইজারকে এনেছিল ডাচ ক্লাবটি। লাভ হয়নি। মোনাকোর সাবেক স্ট্রাইকার থিয়েরি অঁরি কোচ হয়ে মেরেকেটে তিন মাস টিকেছিলেন। একই অবস্থা হয়েছে থিয়াগো মোত্তারও। ২-৭-২ ছকের ধারণা দিয়ে ফুটবল বিশ্বে ঝড় তোলা সাবেক বার্সেলোনা, জেনোয়া ও ইন্টার মিলানের এই মিডফিল্ডার জেনোয়ার কোচ হয়ে তিন মাসও টেকেননি। ফিওরেন্টিনার স্ট্রাইকার হিসেবে সাফল্য পাওয়া ভিনসেঞ্জো মন্তেয়া কয়েক দিন আগেই ছাঁটাই হয়েছেন। পিএসভির আইন্দহোভেনের সাবেক ডাচ মিডফিল্ডার মার্ক ফন বোমেলও সাফল্য পাননি। এখন তিনি বেকার।
নিজের সাবেক কোনো একটা খেলোয়াড়কে ধরে এনে ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব দিয়েই তাঁকে গার্দিওলা বা ক্রুইফ মনে করার কোনো কারণ নেই। ব্যর্থ কোচের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়!