চ্যাম্পিয়নস লিগ, বার্নাব্যু, রিয়াল মাদ্রিদ... রূপকথা!
একবার হলে সেটিকে ভাগ্যের খেল বলা যায়।
দুবার হলেও হয়তো ভাগ্যকেই কৃতিত্বটা দেওয়া চলে।
কিন্তু তিনবার, চারবার, বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে? ঝড়ে বক মরার তত্ত্ব সেখানে আর খাটে না, ফকিরের কেরামতিও আর চলে না, সেটি তখন দক্ষতারই প্রমাণ হয়ে দাঁড়ায়।
রূপকথা লেখা রিয়াল মাদ্রিদের অনন্য দক্ষতাই তো!
শেষ ষোলোতে পিএসজি, শেষ আটে চেলসির পর সেমিফাইনালে আজ ম্যানচেস্টার সিটি যে দক্ষতা টের পেল। খাদের কিনারা থেকে অবিশ্বাস্যভাবে ফিরে আসার দক্ষতা। চ্যাম্পিয়নস লিগটা যে তাদেরই টুর্নামেন্ট, সেটি বারবার মনে করিয়ে দেওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা। যার সর্বশেষ কিস্তির প্রদর্শনীতে রেকর্ড ১৭তম চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে রিয়াল। অথচ ৮৯ মিনিট শেষেও এমনটা কে ভাবতে পেরেছিল!
সিটির মাঠে প্রথম লেগে ৪-৩ গোলে হেরে আসায় জয়ের বিকল্প ছিল না রিয়ালের, বার্নাব্যুতে তেড়েফুঁড়েই শুরু হলো দুই দলের। ইংলিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের ভাষায়, 'ঘন্টায় ১০১ মাইল গতির' ম্যাচ!
লম্বা পাসে ভিনিসিয়ুসকে বারবার খুঁজে নিয়ে আক্রমণে উঠছিল রিয়াল, তার আগ পর্যন্ত রিয়ালের ডি বক্সের সামনে দারুণ ক্ষিপ্রতায় বল দখলের চেষ্টা ছিল সিটির। আবার রিয়াল আক্রমণে উঠলে ৪-৪-২ ছকে মাঠ সংকুচিত রেখে নিজেদের বক্সের সামনে 'লো ব্লক' তৈরি করে রক্ষণের চেষ্টা করছে গার্দিওলার সিটি, এমন অভাবনীয় দৃশ্যের দেখাও মিলল।
মিলছিল না শুধু গোলের দেখা। বিরতির আগে সিটি তবু পোস্টে শট রাখতে পেরেছে কিছু, সিট বক্সের সামনে আক্রমণে হড়বড়ে রিয়াল তা-ও পারেনি। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই অসাধারণ সুযোগ পেয়েও ভিনিসিয়ুস বাইরে মারায় বার্নাব্যুতে হতাশা বাড়ল। মনে হচ্ছিল, রাতটা বুঝি রিয়ালের নয়।
৭৩ মিনিটে যখন রিয়াদ মাহরেজের শট জালে জড়িয়ে গেল, ধারণাটা আরও পোক্ত হলো। আর ১৭ মিনিট বাকি, দুই লেগের সম্মিলিত ফলে দুই গোলে এগিয়ে সিটি। কিন্তু ৮৭ মিনিটে জ্যাক গ্রিলিশের শটটা গোললাইন থেকে ফিরিয়ে দিয়ে বুঝি রিয়াল মাদ্রিদের ফেরার আশা বাঁচিয়ে রাখলেন ফারলাঁ মেন্দি! কে জানত, আর ৩৩ মিনিট পর পেছনে ফিরে সেটিকেই মনে হবে অসাধারণ প্রত্যাবর্তনের গল্পটার "মোমেন্টাম" বদলে দেওয়া মুহূর্ত!
পিএসজি, চেলসি যে ভুল করেছে, সুযোগ কাজে লাগিয়ে রিয়ালকে "খুন" করতে না পারার সে ভুলটা সিটিরও হলো। আর মঞ্চ যখন চ্যাম্পিয়নস লিগের নকআউট পর্ব, শিকারে পরিণত হওয়া থেকে বেঁচে গেলে রিয়ালই শিকারী! তাদের নবতম শিকার - ম্যান সিটি।
৯০ মিনিটে গোল হলো, গায়ের সঙ্গে লেগে থাকা সিটি ডিফেন্ডার দিয়াসকে এড়িয়ে রদ্রিগো বেনজেমার ক্রসে দারুণ শিকারির দক্ষতায় পা ছোঁয়াতেই বার্নাব্যু জেগে ওঠে। ম্যাচে ১-১, দুই লেগ মিলিয়ে ৫-৪। তখনো ১ গোল দরকার রিয়ালের, হাতে বাকি যোগ করা ৬ মিনিট সময়। অনেক সময় রিয়ালের জন্য!
আহত বাঘের প্রতিটি পদক্ষেপে তখন ফেরার আত্মবিশ্বাস, সিটি ভীত হরিণ। ১৩ চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা দলের সঙ্গে কখনো শিরোপাটি না জেতা, একবারই মাত্র ফাইনালে ওঠা দলের আত্মবিশ্বাসের পার্থক্য চোখে স্পষ্ট। নিজ ঘরে ছোটাছুটি করতে থাকা একজনের সঙ্গে অতিথির ইতস্তত পদচারণার পার্থক্য। এখানে রিয়ালের নিজ ঘর বলতে শুধু বার্নাব্যুই নয়, চ্যাম্পিয়নস লিগের মঞ্চও।
পার্থক্যের প্রতিফলন এক মিনিট পরই দেখা গেল। আবার গোল। আবার রদ্রিগো! এবার হেডে। দুই লেগ মিলিয়ে ৫-৫! তখনো যোগ করা সময়ের পাঁচ মিনিট বাকি। রিয়াল তখনই তৃতীয় গোলটা পেয়ে গেলে হয়তো অতিনাটকীয় হতো, কিন্তু মঞ্চটা চ্যাম্পিয়নস লিগ আর দলটা রিয়াল বলেই হয়তো সেটিও মানিয়ে যেত।
অতিনাটকীয় কিছু হয়নি, তবে যা হয়েছে, তা-ই কম অবিশ্বাস্য কী! যোগ করা সময়ে আবার বার্নাব্যুতে উচ্ছ্বাস। পেনাল্টি পেয়েছে রিয়াল। বিতর্কিত? হয়তো। দিয়াজ বেনজেমাকে বক্সে ফেলে দিয়েছেন, কিন্তু সেটি বেনজেমা তাঁর সামনে চলে এসেছেন বলেই। তাতে রিয়ালের কী! পেনাল্টি এসেছে, ঠান্ডা মাথায় বলটা জালে জড়িয়ে দিয়ে উল্লাস বেনজেমার। তখনো অতিরিক্ত সময়ের ২৫ মিনিট বাকি, কিন্তু রিয়ালের ফাইনালে ওঠা সম্ভবত তখন থেকেই নিঃসংশয়!
এ যে চ্যাম্পিয়নস লিগ! তারওপর ম্যাচটা বার্নাব্যুতে। এখানে রিয়ালেরই দাদাগিরি।
আর দাদাগিরি শুধুই ভাগ্যের জোরে হয় না।