ঘরের 'বাঘ' বাইরেও তেজ দেখাক
>পেশাদার ফুটবল লিগে দশ আসরে ছয়বার চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশের ফুটবলের রাজা আবাহনী লিমিটেড। কিন্তু ঐতিহ্যবাহীরা ঘরের মাঠ ছেড়ে আন্তর্জাতিক ফুটবল পা দিলেই ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। তাই নামের পাশে লেগে গেছে ‘ঘরের বাঘ’ তকমা
আবাহনী—নামটি কত মানুষের হৃদয়েই না খোদাই করে লেখা। অতীতে ফিরে তাকালে এটি লাখো মানুষের ভালোবাসা আর আবেগের স্লোগান। এই প্রজন্মের কাছে তা ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র গল্পের মতো শোনালেও এখনো অনেকেই আবাহনীকে নিয়ে আবেগাপ্লুত হন,সাফল্যে হন আনন্দিত, ব্যর্থতায় পান কষ্ট। পেশাদার ফুটবল লিগের দশ আসরের ছয়টিতেই চ্যাম্পিয়ন হয়ে তাঁরা দেশের ফুটবলের ‘রাজা’। কিন্তু ঐতিহ্যবাহীরা ঘরের মাঠ ছেড়ে আন্তর্জাতিক ফুটবল পা দিলেই ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। তাই নামের পাশে লেগে গেছে ‘ঘরের বাঘ’ তকমা।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে আবাহনীর ব্যর্থতার ফিরিস্তিটা অনেক লম্বা। যদিও আশির দশকের শেষে আর নব্বইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত আবাহনীর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব এশীয় পর্যায়ে দুর্দান্ত সাফল্য পেয়েছিল। উত্তর কোরিয়ার চ্যাম্পিয়ন এপ্রিল টুয়েন্টি ফাইভকে হারিয়েছিল। হারিয়েছিল এশীয় ফুটবলের শীর্ষ শক্তি ইরানের চ্যাম্পিয়ন পিরুজিকে। কাতারের আল সাদ, ইরানের ইশতেগলালের মতো দল কোনোমতে মান বাঁচিয়েছিল তাঁদের সঙ্গে। সাফ অঞ্চলের ক্লাবগুলি পাত্তাই পেত না মোহামেডানের সঙ্গে। বিরাট ব্যবধানে জয়ের রেকর্ডও আছে মোহামেডানের। ১৯৯৩ সালে মালদ্বীপের ভ্যালেন্সিয়া ক্লাবকে ৮-০ আর ১৯৯৬ লাওসের ইলেকট্রিসিটি ক্লাবকে একই ব্যবধানে হারিয়েছিল সাদা-কালোরা। সেই মোহামেডান তো এখন ইতিহাস।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আবাহনীর রেকর্ড খুবই খারাপ। মোহামেডানের ধারে-কাছেও নেই তাঁরা। সেই আশি-নব্বইয়ে রমরমা যুগেও আবাহনী এশিয়ান ক্লাব ফুটবলে বলার মতো কিছুই করতে পারেনি। এই যুগে তৃতীয় সারির টুর্নামেন্ট এএফসি প্রেসিডেন্ট কাপে পাঁচবার খেলে একবারও গ্রুপ পর্ব পেরোতে পারেনি বাংলাদেশ প্রতিনিধিরা। প্রেসিডেন্টস কাপের স্থলে এখন অনুষ্ঠিত হয় এএফসি কাপ। সেখানেও টানা দুই আসরে ব্যর্থ। অর্থাৎ এএফসির সাত আসরে টানা ব্যর্থ বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়নরা। ঘরের মাঠেও আন্তর্জাতিক আসরে ভালো করেনি আকাশি-নীলরা। চট্টগ্রামে শেখ কামাল ক্লাব কাপের দুই আসরেই গ্রুপ পর্ব থেকে নিয়েছে বিদায়।
ঘরোয়া ফুটবলে দাপুটে আবাহনীর আন্তর্জাতিক ফুটবলে ব্যর্থতার কারণ কি? ফুটবল পাড়ায় একটি কথা চালু আছে—আবাহনী মাগুরা গোল্ডকাপকে যতটা গুরুত্ব দেয় এএফসি কাপকে তেমন দেয় না। কথাটি প্রমাণের জন্য একটি তথ্যই যথেষ্ট, শেষেরটি বাদ দিলে আগের ছয় আসরে এশিয়ান কোটায় কোনো খেলোয়াড়ের নামই নিবন্ধন করেনি তাঁরা। এএফসির কোনো টুর্নামেন্টে ৪ জন বিদেশি খেলালে একজনকে অবশ্যই হতে হবে এশিয়ার কোনো দেশের। নয়তো তিনজন বিদেশি নিয়েই খেলতে হবে। ফলে এই অবহেলাকেই ব্যর্থতার কারণ হিসেবে মনে করে থাকেন অনেকে।
কিন্তু একটু সতর্ক হলেই আবাহনী যে পারে, সেই প্রমাণও আছে। ২০১৭ সালে ১০ জন নিয়ে ভারতের বেঙ্গালুরু এফসিকে ২-০ গোলে হারিয়েছিল আবাহনী। এই বেঙ্গালুরুই পরে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় পর্বে খেলেছিল। সেই অনুপ্রেরণাকে সঙ্গী করে আবাহনী এবার কোমর বেঁধে নেমেছে। দ্বিতীয়বারের মতো নেওয়া হয়েছে এশিয়ান কোটার খেলোয়াড় আফগানিস্তানের ডিফেন্ডার মাশি সাইগানিকে। টুর্নামেন্ট সামনে রেখে নতুন নেওয়া হয়েছে ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার ওয়েলিংটন প্রিওরিকে। গতকাল সংবাদ সম্মেলনেও বোঝা গেল, এবার আর শুধুই অংশ নিতে নয়, টুর্নামেন্টে ভালো কিছু করার প্রত্যয় তাদের।
বুধবার কাঠমান্ডুর আনফা কমপ্লেক্সে স্বাগতিক নেপালের মানাং মার্সিয়াংদির বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে শুরু হবে আবাহনীর এএফসি কাপ মিশন। দলের পর্তুগিজ কোচ মারিও লেমোস আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে দ্বিতীয় পর্বে খেলার কথাই বলেছেন, ‘জানি নেপালের দলটি কেমন। আমরা সে অনুযায়ী অনুশীলন করেছি। প্রথম ম্যাচটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের লক্ষ্য জয়। এবার আমাদের দ্বিতীয় পর্বে খেলার ভালো সুযোগ আছে।’
এএফসি কাপের গ্রুপ পর্বে দক্ষিণ এশিয়ার চার ক্লাব খেলছে ‘ই’ গ্রুপে। নেপালের মানাং ছাড়া আছে ভারতের মিনার্ভা পাঞ্জাব ও চেন্নাইন এএফসি। একটি দল পাবে দ্বিতীয় পর্বের টিকিট। সে লড়াইয়ে এবার আবাহনী থাকবে বলে বিশ্বাস করেন অধিনায়ক শহিদুল আলম সোহেল, ‘আগের চেয়ে এবার আমাদের এবারের দলটি শক্তিশালী। আশা করছি দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলার।’
আন্তর্জাতিক আসরে ব্যর্থতার মোড়ক থেকে বের হয়ে আসার এই তো সুযোগ। ঘরের মাঠে বাঘের তকমা ঝেড়ে ফেলে আবাহনী আন্তর্জাতিক ফুটবলে সফল হতে পারে কিনা, সেটাই দেখার অপেক্ষা। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আবাহনীর সাফল্যটা যে দেশের ফুটবলের জন্যই দরকার। তাই প্রত্যাশা ঘরের ‘বাঘ’ এবার বাইরেও তেজ দেখাক।