>আনা ফ্রাঙ্ক ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখা তাঁর ডায়েরির জন্য। অনেকে বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এই অনিশ্চিত সময়টাও নাকি বিশ্বযুদ্ধের মতোই। ক্ষুদ্র এক অণুজীবের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবী তো যুদ্ধেই নেমেছে! তা এই সময়ে বাংলাদেশের ঘরবন্দী খেলোয়াড়েরা যদি ডায়েরি লিখতেন, কী থাকত তাঁদের লেখায়? খেলোয়াড়দের হাতে কলম তুলে দিয়ে সেটিই জানার চেষ্টা করেছে প্রথম আলো-
বগুড়ার শিবগঞ্জ থানার গাঙনগরের পোড়ানগরে আমাদের গ্রামের বাড়ি। চারদিক সবুজে ঘেরা। করোনাভাইরাসের থাবায় খেলা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবাহনী কাম্প ছুটি দিলে আমি বাড়িতে চলে আসি। সেই থেকে দেড় মাস একটানা এই সবুজ পরিবেশেই আছি।
কিন্তু তাতেও কি স্বস্তিতে নিশ্বাস নেওয়ার উপায় আছে!
আমাদের আশপাশে অনেকের করোনাভাইরাস ধরা পড়েছে। বাড়ি থেকে খুব একটা বের হই না। কখনো কখনো আশপাশের ছোট ভাইদের সঙ্গে টুকটাক গল্প করি। সেটা অবশ্যই সামাজিক দূরত্ব বজার রেখে। মাঝেমধ্যে পাশের চায়ের দোকান পর্যন্ত যাই। অথচ আগে বাড়ি এলে মূল কাজই ছিল আড্ডা দেওয়া। চায়ের দোকানে প্রতিবেশীদের সঙ্গে গল্প করা। এখন গ্রামটাকে ঠিক আগের মতো লাগছে না। কোথাও যেন প্রকৃতিও বিষণ্ন।
তবে গ্রামের তাজা তরিতরকারি খাওয়ার একটা সুযোগ হয়েছে। কৃত্রিম কিছু নেই। কত রকম শাক যে এখানে পাওয়া যায়! আস্মা নিয়ে আসেন। তাঁর হাতের রান্না আমার কাছে বরাবরই লোভনীয়। পুকুরে মাছ ধরাও আমার খুব পছন্দের। কিন্তু পুকুরে এখন পানি নেই। থাকলে অবশ্যই মাছ ধরতাম। এটা খুব মিস করছি।
মিস করছি আসলে অনেক কিছুই। ক্লাবে সবার সঙ্গে থাকা, আড্ডা দেওয়া, ডাইনিংয়ে একসঙ্গে খাওয়া—এগুলো আপাতত ছুটি নিয়েছে জীবন থেকে। মনে হয় কত দিন হয়ে গেছে! কত দিন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ঘাসের গন্ধ পাই না! আবাহনীর অনুশীলন মাঠে সকাল-বিকেল কোচের বিফ্রিং, এটা ওটা নিয়ে ব্যস্ততা—কিছুই এখন নেই। ডাঙ্গায় উঠলে মাছের যেমন লাগে, মাঝেমধ্যে মনে হয় আমার তেমনই লাগছে। ফুটবল ছাড়া জীবনে আর আছে কী! কবে আবার সেই জীবনে ফিরে যাব, তাই শুধু ভাবি।
করোনাকালীন জীবনটা বন্দী হয়ে আছে ৪-৫ ইঞ্চির একটি যন্ত্রের ভেতর, যার নাম সেলফোন। টিভি খুব একটা দেখি না, আব্বা দেখেন। আমি ঘুম বাদে বাকি সময়টা সেলফোনের সঙ্গেই বন্ধুত্ব পাতিয়েছি। ইউটিউবে পুরোনো দিনের ফুটবল দেখি। চ্যাম্পিয়নস লিগ, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগসহ অনেক লিগের ভালো ভালো ম্যাচ দেখা হয়। এগুলো বারবার দেখলেও ভালো লাগে। মেসি, রোনালদো, নেইমার, দিবালাদের স্কিল দেখে নিজেও কিছু শেখার চেষ্টা করি।
ঢাকা থেকে আসার সময় পছন্দের বইগুলো সঙ্গে আনতে পারলে খুব ভালো হতো। আমি ইসলামিক বই পড়ি। যেমন হাদিসের বই, নবিজির জীবনী। তাড়াহুড়োয় চলে আসায় ওগুলো আর ব্যাগে ভরতে পারিনি। তেমন একটা কাপড়চোপড়ও আনা হয়নি। অবশ্য গ্রামে এলে পোশাক-আশাক নিয়ে অত ভাবতে হয় না। গ্রামে তো আমি আর আবাহনী বা জাতীয় দলের স্ট্রাইকার নই। আমি পোড়ানগরের নাবিব নেওয়াজ জীবন, যে লুঙ্গি পরে ঘুরে। সাধারণ তার চলাফেরা। গাঙনগরের পুকুর, গাছ তাঁকে খুব টানে। আমি এখন নিজের শিকড়ে। তবে সত্যি বলতে মনটা পড়ে আছে ঢাকায় খেলার মাঠে।
মানুষ এখন জঙ্গলে গেলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় থাকতে চায়। আমি আবার সে রকম নই। ফেসবুকটাও আপাতত অকার্যকর করে রেখেছি। কিছু মানুষ আজেবাজে মন্তব্য করে। একজন খেলোয়াড়ের প্রতি ভালোবাসা দূরে থাক, সামান্য শ্রদ্ধাবোধও নেই অনেকের। মাঠে ভালো-খারাপ দুই রকম সময়ই যায়। আমাদের দেশে কিছু মানুষ সেটা বুঝতে চায় না। তারা খোঁচা দিতে ওত পেতে খাকে। খারাপ মন্তব্য করে। তাই ফেসবুক থেকে এখন দূরে আছি।
তবে হোয়াটসঅ্যাপে জাতীয় দলের কোচের নির্দেশনাগুলো দেখি। ফিটনেস রাখতে জাতীয় দলের ফুটবলারদের তিনি নানা পরামর্শ দেন। সে অনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা করি। বাড়িতে আসার পর ছাদে কিছু ব্যায়াম নিয়মিত করতাম। বল নিয়ে টুকটাক খেলতাম। রোজার মধ্যে সেটিতেও বিরতি পড়েছে। রোজায় শরীর এমনিতেই ফিট থাকে। তাই ফিটনেস নিয়ে অত ভাবছি না। আর আমি তো এমনিতেও মোটা হই না। কত চেষ্টা করলাম তবুও হলাম না! করোনার সময়ে তাই ফিটনেস নিয়ে ভয় নেই আমার।