গার্দিওলার জায়গায় থাকলে যিনি লিগজয়ী হতেন...
‘আজ সে যদি এখানে (ম্যানচেস্টার সিটি) থাকত, তাহলে সে শিরোপার জন্য লড়াই করত। আজ আমি যদি ওখানে থাকতাম, তাহলে হয়তো অবনমন এড়ানোর জন্য লড়াই করতাম...’
কথাটা পেপ গার্দিওলার। এতেই স্পষ্ট, যার সম্পর্কে কথাগুলো বলা হচ্ছে তিনি কোচ হিসেবে কতটুকু দুর্দান্ত ও কৌশলী। কিন্তু কাকে নিয়ে এ কথাগুলো বলেছেন গার্দিওলা? মনে হতেই পারে, লিভারপুলের ইয়ুর্গেন ক্লপ, ইন্টার মিলানের আন্তোনিও কন্তে, টটেনহামের জোসে মরিনিও কিংবা নিদেনপক্ষে আতালান্তার জিয়ানপিয়েরে গাসপেরিনি কিংবা আর্সেনালের মিকেল আরতেতাকে নিয়ে বলা হচ্ছে কথাগুলো।
আসলে তা নয়। গার্দিওলার এই প্রশংসাবাণী শেফিল্ড ইউনাইটেডের বিদায়ী কোচ ক্রিস ওয়াইল্ডারের উদ্দেশে। পাঁচ বছর দায়িত্বে থাকার পর গতকাল শেফিল্ড ইউনাইটেডের দায়িত্ব ছেড়েছেন এই কোচ। আর সে খবর পেয়েই গার্দিওলার প্রশংসাবাক্য। শুনে আশ্চর্য লাগাই স্বাভাবিক, শেফিল্ডে সদ্য সাবেক হওয়া এই ইংলিশ কোচ এমন কী করে ফেলেছেন, যে তাঁর প্রশংসায় গার্দিওলা এসব কথা বলছেন?
সে জন্য একটু পেছনে ফিরতে হবে। দেখতে হবে, শেফিল্ড ইউনাইটেডের ইতিহাসে ওয়াইল্ডারের স্থান কোথায়। কেন শেফিল্ডে ‘ঈশ্বর’ মানা হয় ইয়র্কশায়ারে জন্ম নেওয়া ৫৩ বছর বয়সী এই ভদ্রলোককে।
ছিলেন রাইটব্যাক, শেফিল্ড ইউনাইটেড বলতে অজ্ঞান। খেলোয়াড়ি জীবনে দুই দফায় শেফিল্ডের হয়ে খেলে যাওয়া এই ভদ্রলোক কোচ হয়েও প্রিয় দলের দায়িত্ব পেয়েছিলেন পাঁচ বছর আগে। নাইজেল অ্যাডকিন্সের বিদায়ের পর যখন ওয়াইল্ডারের হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়া হলো, এই একটিমাত্র কারণেই শেফিল্ডের সমর্থকেরা নতুন কোচকে নিয়ে নৈরাশ্যবাদী হননি। আরও অভিজ্ঞ ও সফল কোচ কেন আনা হলো না, সেটা নিয়ে সমালোচনা করেননি। কারণ ওই একটাই। শেফিল্ডের প্রতি ওয়াইল্ডারের ভালোবাসার কোনো কমতি ছিল না। ঘরের ছেলে ঘরের ক্লাবকে সফল করবে একদিন, তা আস্তে আস্তে হোক, এমনটাই আশা ছিল শেফিল্ড ইউনাইটেড ভক্তদের। ক্লাবের কোচ হওয়া সত্ত্বেও সমর্থকদের সঙ্গে তাঁর বন্ধন ছিল অটুট। সমর্থকদের সঙ্গে লোকাল বাসে চড়ে অ্যাওয়ে ম্যাচের ভেন্যুতেও চলে যেতেন!
ছোট থেকে যে ক্লাবের ভক্ত, সে ক্লাবের হয়ে দুই দফা খেলার সুযোগ পাওয়ার পাশাপাশি ম্যানেজারের দায়িত্ব পাওয়া—একজন আজন্ম ভক্তের কাছে এর চেয়ে বেশি পাওয়ার আর কী আছে? হয়তো ১০০ জনের মধ্যে ৯৫ জনই অতটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকতেন। কিন্তু ওয়াইল্ডার অন্য ধাতে গড়া। ৯৫ নয়, ওই বাকি ৫ জনের মধ্যে আবাস তাঁর। মৌসুম শেষে শেফিল্ডের মানুষজন সেটা বোঝা শুরু করল বেশ ভালোভাবে। দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম চার ম্যাচে মাত্র ১ পয়েন্ট জোগাড় করা ওয়াইল্ডার মৌসুম শেষ করলেন শতাধিক পয়েন্ট নিয়ে। পাঁচ বছর ধরে তৃতীয় বিভাগে ঘুরঘুর করতে থাকা শেফিল্ডের দ্বিতীয় বিভাগে উন্নয়ন হলো তাতেই। দ্বিতীয় বিভাগে দুই বছর থেকে দলকে সোজা নিয়ে তুললেন প্রিমিয়ার লিগে। আর এখানেই গার্দিওলার মতো কোচরা বুঝতে শুরু করলেন, কেন ওয়াইল্ডার অনন্য।
ওয়াইল্ডার জানতেন, লিগের ধনী প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে টাকার লড়াইয়ে পেরে উঠবে না তাঁর শেফিল্ড। দামি খেলোয়াড় এনে দল ভারী করা সম্ভব না তাদের পক্ষে। প্রিমিয়ার লিগের অন্যান্য ক্লাবের সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার মাধ্যম একটাই, মাঠের লড়াইয়ে অভিনব কৌশলের আশ্রয় নিতে হবে। এমন কৌশলে খেলতে হবে, যা কেউ আগে কখনো দেখেনি, শোনেনি। এমনভাবে খেলতে হবে, যেন গার্দিওলা-ক্লপ থেকে শুরু করে মরিনিও, আনচেলত্তি, ল্যাম্পার্ড, সুলশার, আরতেতারা বিস্মিত হয়ে যান প্রতিমুহূর্তে। আর তাঁদের মতো কোচদের বিস্মিত করে দলকে প্রিমিয়ার লিগে প্রথম মৌসুমে নবম করতে পারাই ওয়াইল্ডারের কোচিং ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ সাফল্য।
হ্যাঁ, ভুল পড়েননি। নবমই। তিন বছর আগেও যে দলটা তৃতীয় বিভাগে খাবি খেত, ওয়াইল্ডারের উদ্ভাবনী কৌশলের জোরে সে দলটাই তিন বছর পর ইংল্যান্ডের শীর্ষ লিগের নবম সেরা দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিল। ডিন হেন্ডারসন, ক্রিস বাশাম, জন এগান, জ্যাক ও’কনেল, জন লুন্ডস্ট্রাম, জন ফ্লেক, এন্ডা স্টিভেনস, জর্জ বালডকের মতো খেলোয়াড়েরা পরিচিতি পেলেন কৌশলগতভাবে লিগের অন্যতম বুদ্ধিমান খেলোয়াড় হিসেবে।
যে কৌশলে ওয়াইল্ডার শেফিল্ডকে খেলানো শুরু করেছিলেন, তা শুধু শেফিল্ডকেই যে নবজীবন দান করেছে, তা নয়। বরং আধুনিক ফুটবলেই নতুন চিন্তার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। না হয় কে কবে ভেবেছিল, দলের অধিকাংশ ডিফেন্ডারদের নিয়মিত আক্রমণে তুলে গোল আদায় করে নেওয়া যায়? প্রতিপক্ষের আক্রমণের পথ বন্ধ করে দেওয়া যায়?
এটাই করেছিলেন ওয়াইল্ডার। ওয়াইল্ডারের কৌশলের দিকে নজর দিতে গেলে অন্য দলগুলোর মতো দুটি বিষয় লক্ষ করা যায়। এক—আক্রমণের সময়ে দলের কৌশল কী থাকে, দুই—রক্ষণের সময় দলের পরিকল্পনা কেমন থাকে।
প্রথমে রক্ষণের দিকে তাকানো যাক। রক্ষণে সাধারণত কাগজে-কলমে ৫-৩-২ ছকে মাঠে নামত শেফিল্ড। গোলবারের নিচে ইংলিশ গোলরক্ষক ডিন হেন্ডারসনের সামনে থাকতেন তিন সেন্টারব্যাক হিসেবে জন এগান (সবার মাঝে), জ্যাক ও’কনেল (বাঁ দিকের সেন্টারব্যাক), ক্রিস বাশাম (ডান দিকের সেন্টারব্যাক)। দুই উইংব্যাক হিসেবে জর্জ বালডক (রাইট উইংব্যাক) ও এন্ডা স্টিভেনস (লেফট উইংব্যাক)। মাঝমাঠে তিন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারদের মধ্যে থাকতেন অলিভার নরউড (সবার মাঝে), জন ফ্লেক (একটু বাঁয়ে) ও জন লুন্ডস্ট্রাম (একটু ডানে)। আক্রমণভাগে ফরাসি স্ট্রাইকার লিজ মুসে, আইরিশ স্ট্রাইকার ডেভিড ম্যাকগোল্ডরিক, স্কটিশ স্ট্রাইকার অলিভার ম্যাকবার্নি ও অলিভার বুর্ক, অধিনায়ক বিলি শার্পের মধ্যে যেকোনো দুজনকে খেলানো হতো। এঁদের কেউই গোল করার জন্য তেমন পরিচিত নন। অবশ্য ওয়াইল্ডারের পরিকল্পনায় স্ট্রাইকারদের মূল কাজ কখনোই গোল করা ছিল না। কোচের পরিকল্পনা মাঠে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য ওয়াইল্ডার কম দামে এদের চেয়ে ভালো কাউকে পেতেন না। তাই তাঁদের ভূমিকা এই দলে গোল করার চেয়েও অনেক বেশি ছিল।
রক্ষণে পাঁচজন ডিফেন্ডার এক লাইনে দাঁড়িয়ে নিজেদের কাজ করতেন, আক্রমণের চিন্তা বাদ দিয়ে। তিন মিডফিল্ডারের মধ্যে নরউডকে মধ্যে রেখে বাকি দুই মিডফিল্ডার ফ্লেক আর লুন্ডস্ট্রাম অনেকটা ওয়াইড মিডফিল্ডার হয়ে যেতেন রক্ষণে দুই উইংব্যাক স্টিভেনস ও বালডককে সাহায্য করার জন্য। ওদিকে দুই স্ট্রাইকারের কাজ ছিল নরউড-লুন্ডস্ট্রাম ও নরউড-ফ্লেকের মধ্যে ফাঁকা জায়গায় অবস্থান করে প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের মধ্যকার পাস দেওয়ার পথগুলো বন্ধ করা।
ওয়াইল্ডার দলের কাউকে দিয়ে কঠিনভাবে প্রেস করাতেন না। প্রতিপক্ষের পায়ে বল গেলে ইয়ুর্গেন ক্লপ, ইউলিয়ান নাগলসমান, মরিসিও পচেত্তিনো কিংবা আধুনিক কালে পেপ গার্দিওলা যে কাজটা করেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রতিপক্ষকে প্রেস করে বল কেড়ে নেওয়া, সে কাজটা ওয়াইল্ডার শিষ্যদের দিয়ে করাতেন না। বরং প্রতিপক্ষ যেন তাঁদের ভেদ করে সামনে পাস পাঠাতে না পারেন, সেটা নিশ্চিত করতেন। বল যদি মাঠের ডান প্রান্তে থাকা কোনো প্রতিপক্ষের পায়ে থাকে, তাহলে সেদিকে থাকা লেফট সেন্টারব্যাক জ্যাক ও’কনেল, লেফট সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার জন ফ্লেক, লেফট উইংব্যাক এন্ডা স্টিভেনস ও একজন স্ট্রাইকার গিয়ে সুন্দর মতো ফাঁকা জায়গাগুলোতে দাঁড়িয়ে যেতেন, পাস দেওয়ার পথ বন্ধ করতেন। আবার বল যদি একইভাবে মাঠের বাঁ প্রান্তে থাকা কোনো প্রতিপক্ষের পায়ে থাকে, একই কাজ করতেন রাইট সেন্টারব্যাক ক্রিস বাশাম, রাইট সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার জন লুন্ডস্ট্রাম, রাইট উইংব্যাক জর্জ বালডক ও আরেকজন স্ট্রাইকার। প্রয়োজনে সাইডলাইনকেও বাড়তি ডিফেন্ডার হিসেবে ব্যবহার করত শেফিল্ড। বল পায়ে থাকা প্রতিপক্ষকে ওই দিকে থাকা দুজন বা তিনজন খেলোয়াড়ের সাহায্যে সাইডলাইনের কাছে নিয়ে গিয়ে বল ‘আউট’ করে দিত শেফিল্ড। যে কাজটা দিয়েগো সিমিওনের আতলেতিকো কিংবা সাম্প্রতিককালে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর জুভেন্টাসকে চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে বিদায় করে দেওয়া এফসি পোর্তো করতে পারে বেশ ভালোভাবে।
শেফিল্ডের রক্ষণের মূল নির্যাস এটাই। অনেক সময় শেফিল্ড আগে গোল করে এগিয়ে গেলে ঠিক এই পরিকল্পনা মাথায় রেখেই ম্যাচের বাকি সময়টা রক্ষণ করে যেত। প্রতিপক্ষকে প্রেস না করেও শুধু সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে পাসিং পথ বন্ধ করে বল ইন্টারসেপ্ট করার মাধ্যমে দ্রুত আক্রমণে উঠে যেত আবার।
এবার আসা যাক আক্রমণের ক্ষেত্রে। আর এখানেই দেড় বছর ধরে আসল ‘কেরামতি’ দেখিয়েছেন ওয়াইল্ডার। শেফিল্ডের ছক ৫-৩-২ থেকে ৩-৫-২ হয়ে যেত আক্রমণে। আগেই বলা হয়েছে, ওয়াইল্ডারের হাতে গোল করতে পটু স্ট্রাইকার বা উইঙ্গার নেই, যাঁরা কিনা শীর্ষ লিগে ১৫ থেকে ২০টা করে গোল করতে পারবেন। এমনকি গত মৌসুমে শেফিল্ড যে নবম হয়েছিল, সে মৌসুমেও দল গোল করেছে মাত্র ৩৯টা। কিন্তু গোল যাঁরা করেছেন এবং যেভাবে করেছেন, সেটাই জাগিয়েছে চমক।
শেফিল্ডের আক্রমণ কৌশলের মূল দায়িত্ব স্ট্রাইকারদের নয়, বরং ডিফেন্ডারদের। তিন সেন্টারব্যাকের মধ্যে একজন এগানই তেমন নড়তেন না, কিন্তু বাকি দুই সেন্টারব্যাক ক্রমাগত ওপরে উঠে যেতেন। বাঁ দিকের সেন্টারব্যাক জ্যাক ও’কনেল হয়ে যেতেন ছদ্ম লেফট উইংব্যাক (অর্থাৎ আসল লেফট উইংব্যাক এন্ডা স্টিভেনসের জায়গায় চলে যেতেন), আর ডান দিকের সেন্টারব্যাক ক্রিস বাশাম হয়ে যেতেন ছদ্ম রাইট উইংব্যাক (চলে যেতেন আসল রাইট উইংব্যাক জর্জ বালডকের জায়গায়)।
তখন আসল লেফট ও রাইট উইংব্যাক স্টিভেনস আর বালডক কী করতেন? প্রশ্ন উঠতেই পারে। উত্তরে অনেকে বলতে পারেন আধুনিক উইংব্যাকের মতো ছদ্ম উইঙ্গার হয়ে যেতেন স্টিভেনস আর বালডক। এখন লিভারপুলের ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার-আরনল্ড ও অ্যান্ডি রবার্টসন, বায়ার্ন মিউনিখের জোশুয়া কিমিখ ও আলফোনসো ডেভিস, চেলসির রিস জেমস ও বেন চিলওয়েল, রিয়াল মাদ্রিদের দানি কারভাহাল ও ফারলঁদ মেন্দি যা করে থাকেন।
আর এখানেই আসল ফাটকাটা খাটিয়েছেন ওয়াইল্ডার। আধুনিক ফুলব্যাকদের মতো নিজের ফুলব্যাক/উইংব্যাক দুজনকে ছদ্ম উইঙ্গারের দায়িত্ব দিতেন না এই ইংলিশ কোচ। বরং তাঁদের ভূমিকা হতো আধুনিক সেন্ট্রাল বক্স-টু-বক্স মিডফিল্ডারের মতো, যারা এক প্রান্ত থেকে ভেতরের দিকে সরে এসে প্রতিপক্ষের ডি বক্সের একটু সামনে ঘুরঘুর করতে থাকতেন, শট নেওয়ার সুযোগ খুঁজতেন। এখনকার ফুটবলে রক্ষণভাগের খেলোয়াড়েরা প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকারদের মার্ক করেন, প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকাররাও নিজেদের মার্ক করতে থাকা সেন্টারব্যাকদের পাল্টা মার্ক করেন। ওয়াইল্ডারের সেন্টারব্যাকরা ওপরে উঠে গেলে ধন্দে পড়ে যেতেন প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকাররা। কারণ, ওসব ডিফেন্ডারকে মার্ক করতে করতে নিচে চলে আসলে নিজেদের গোল করার জন্য আক্রমণভাগে মানুষ পাওয়া যাবে না। আর ওয়াইল্ডারের সেন্টারব্যাকদের মার্ক করার জন্য নিচে নেমে না এলে নিজেদের রক্ষণভাগে বাড়তি চাপ পড়বে, কারণ ততক্ষণে শেফিল্ডের সেন্টারব্যাক, উইংব্যাক, দুই স্ট্রাইকার, দু-একজন মিডফিল্ডারের সবাই ওপরে উঠে যাবেন। এ যেন শাঁখের করাত!
আর প্রতিপক্ষের এই দ্বিধার সুযোগই নিয়েছেন ওয়াইল্ডার গত মৌসুমে। ওয়াইল্ডারের খেলোয়াড়েরা বিচিত্র সব ভূমিকা পালন করতেন মাঠের মধ্যে, যে ভূমিকা ওসব খেলোয়াড় পালন করতে পারেন, সাধারণত প্রতিপক্ষ চিন্তাও করে না। কে চিন্তা করেছিল দলের ফুলব্যাক ভেতরে ঢুকে আদর্শ বক্স-টু-বক্স মিডফিল্ডারের মতো খেলতে পারেন? কে ভেবেছিল দলের সেন্টারব্যাককে আদর্শ উইংব্যাক বানানো যেতে পারে? ওয়াইল্ডার ভেবেছিলেন। আর ভেবেছিলেন বলেই দলকে নিয়ে যেতে পেরেছেন প্রিমিয়ার লিগের নবম স্থানে। অর্জন করেছেন গার্দিওলা, ক্লপের মতো কোচের বাহবা। সদ্য উত্তীর্ণ দলের জন্য যা অনেক বড় অর্জন।
কিন্তু সুখের পরে দুঃখ থাকে, যেকোনো সফলতার মধ্যেই ঘাপটি মেরে বসে থাকে ব্যর্থতা। ওয়াইল্ডারের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। গত মৌসুমে চূড়ান্ত সফল এই কোচ এই মৌসুমেই মুদ্রার উল্টো পিঠ দেখে ফেলেছেন। অপেক্ষাকৃত ‘গরিব’ যেসব ক্লাব নিজেদের কৌশলের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল থাকে, তাঁদের মূল একাদশের কেউ চোটে পড়লেই তাসের ঘরের মতো সাজানো সংসার ভেঙে যায়, যদি না বেঞ্চে যোগ্য ব্যাকআপ থাকে। আর এটাই কাল হয়েছে শেফিল্ডের। নিয়মিত তিন সেন্টারব্যাকের একজন জ্যাক ও’কনেল, মিডফিল্ডার জন ফ্লেকের চোটের কারণে ওয়াইল্ডার নিজের কৌশলের সার্থক প্রয়োগ করতে পারেননি এবার। ছিলেন না গত মৌসুমের গোলরক্ষক ডিন হেন্ডারসনও। বিশেষ করে হেন্ডারসন আর ও’কনেলের না থাকাটা বেশি ভুগিয়েছে শেফিল্ডকে। তাঁর জায়গায় এন্ডা স্টিভেনস, কিন ব্রায়ান, ফিল জাগিয়েলকাদের খেলিয়েও লাভ হয়নি। ও’কনেল যেমন সফলভাবে কোচের দেওয়া দায়িত্ব পালন করতেন, তাঁর বিকল্প কোনো খেলোয়াড়ই সেভাবে দায়িত্ব পালন করেননি। ফলে কি আক্রমণ, কি রক্ষণ—সব জায়গাতেই ভুগেছে শেফিল্ড। ওদিকে ও’কনলের সঙ্গে একই প্রান্তে খেলা মিডফিল্ডার জন ফ্লেকের অনুপস্থিতি শেফিল্ডের গোটা বাঁ দিককেই অকার্যকর বানিয়ে দিয়েছে। প্রতিপক্ষরা এখন সহজেই ওই প্রান্ত থেকে বল ঠিকঠাক পাস দিয়ে আক্রমণভাগে পাঠাতে পারে, শেফিল্ডের রক্ষণে ফাঁক খুঁজে বের করতে পারে।
যেহেতু বাঁ দিকে ও’কনেল ও ফ্লেক নেই, সেহেতু আক্রমণের জন্য ডান দিকে থাকা বাশাম, বালডক ও লুন্ডস্ট্রামের (কিংবা তাঁর বিকল্প হিসেবে খেলা নতুন মিডফিল্ডার স্যান্ডার বার্জ) দিকে এই মৌসুমে বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন ওয়াইল্ডার। আগে মাঝখান দিয়ে তেমন আক্রমণ করতে চাইত শেফিল্ড, এখন মাঝখানে থাকা মিডফিল্ডার নরউডকেও আগের চেয়ে বেশি আক্রমণে ভূমিকা রাখতে হয়, যেহেতু বাঁ দিক অকার্যকর। আর এটাই বুঝে গেছেন প্রতিপক্ষরা। নরউড, বাশাম আর বালডককে ঠিকঠাক মার্ক করলেই যে শেফিল্ড নখদন্তহীন হয়ে পড়ে, এটা এখন একরকম ‘ওপেন সিক্রেট’। এই মৌসুমে শেফিল্ড যে অবনমন অঞ্চলের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে, সেটাও এই কারণেই। সামনের মৌসুমে শেফিল্ড আর প্রিমিয়ার লিগে খেলছে না, এটা প্রায় নিশ্চিত।
ওদিকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে ধারে গত মৌসুমে শেফিল্ডে খেলে যাওয়া হেন্ডারসন সেবার অন্তত ৭টা থেকে ৯টা গোল আটকেছিলেন। তর্কযোগ্যভাবে দেশের সেরা গোলকিপার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। নিজেদের গোলকিপারের এই ফর্ম দেখে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এই মৌসুমে আর হেন্ডারসনকে ধারে পাঠায়নি। বরং ভবিষ্যতে নিজেদের নিয়মিত গোলরক্ষক দাভিদ দা হেয়ার জায়গা নেওয়ার জন্য এবার এই হেন্ডারসনকে প্রস্তুত করছে হাতের কাছে রেখে। হেন্ডারসনের জায়গায় শেফিল্ড বোর্নমাউথ থেকে এনেছিল আরেক ইংলিশ গোলকিপার অ্যারন র্যামসডেলকে। মানের দিক দিয়ে র্যামসডেল যে হেন্ডারসনের সমকক্ষ নন, সেটা বোঝা গেছে এই মৌসুমের বিভিন্ন সময়ে।
মালিকপক্ষের সঙ্গে ওয়াইল্ডারের সম্পর্কটাও এখন তিতকুটে হয়ে গেছে। ফলাফল? দায়িত্ব থেকে ওয়াইল্ডারের বিদায়।
দায়িত্ব ছাড়লেও ওয়াইল্ডার এই কয় বছরে দলটার জন্য যা করেছেন, প্রত্যেক সমর্থক গর্বের সঙ্গে স্মরণ করবেন সেটা। ২০১৬ সালের যে সময়ে ওয়াইল্ডার শেফিল্ডে যোগ দিয়েছিলেন, সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত ইংল্যান্ডের শীর্ষ চার লিগে ম্যানচেস্টার সিটির পেপ গার্দিওলা (১৩৪) আর লিভারপুলের ইয়ুর্গেন ক্লপ (১১৭) ছাড়া আর কেউ ওয়াইল্ডারের চেয়ে বেশি লিগ ম্যাচ জেতেননি (সব স্তরের লিগ মিলিয়ে ওয়াইল্ডারের জয় ৯৪টি)।
ওয়াইল্ডারের মহিমা তো এখানেই!