ক্লপ-গার্দিওলার দ্বৈরথটা মেসি-রোনালদোর চেয়ে কম কী!
ইংল্যান্ডে কদিন ধরে বেশ আলোচনা, পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটি আর ইয়ুর্গেন ক্লপের লিভারপুলের এই যে দ্বৈরথ, এটিই ইংল্যান্ডের ফুটবলের ইতিহাসের সেরা কি না!
পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি থাকতে পারে। দুই দলের ফুটবল মুগ্ধতা জাগায়, ম্যাচগুলো রোমাঞ্চ ছড়ায়। অন্য দলগুলোর বুঝি আফসোস জাগায়, ক্লপ আর গার্দিওলার দল দুটি যে ইংল্যান্ডের অন্য যেকোনো দলের চেয়ে অনেক উঁচু মানের। লিগের মানই অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে ক্লপের লিভারপুল আর গার্দিওলার সিটি। শুধু ইংল্যান্ড কেন, ইউরোপে এই মুহূর্তে সেরা দলের আলোচনায়ও তো লিভারপুল আর ম্যান সিটিকে রাখতেই হবে!
কিন্তু তাতেও এই দুই দলের দ্বৈরথকে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দিতে অনেকের বাধবে। দ্বৈরথ বললে যেমন গার্দিওলার বার্সেলোনা আর জোসে মরিনিওর রিয়াল মাদ্রিদের ছবি কল্পনায় আসে, ইংল্যান্ডে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড আর আর্সেন ওয়েঙ্গারের আর্সেনালের একে অন্যকে ফুটবলে-কথার লড়াইয়ে ছাড়িয়ে যাওয়ার স্মৃতি মনে ভাসে...ক্লপের লিভারপুল আর গার্দিওলার সিটিতে সে ঝাঁঝ কই।
না থাক, লিভারপুল-সিটি না হয় শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি না-ই পেল। শুধু লিগের নতুন যুগের সূচনার গল্পেই তাদের নাম না হয় থাকল। কিন্তু দুই দলের কোচের দ্বৈরথ? গত দেড় দশকে ফুটবল মাঠে লিওনেল মেসি আর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর দ্বৈরথই ফুটবলের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন হয়ে ছিল, ডাগআউটে ক্লপ আর গার্দিওলার দ্বৈরথও কি তা নয়? ডাগআউটের মেসি-রোনালদো!
সপ্তাহখানেকের মধ্যে ইংল্যান্ডের দুই টুর্নামেন্টে দুই দলের লড়াইয়ের পর আলোচনাটা না এসে পারে না! লিগে তো দুই দলের শিরোপার লড়াইটা শিহরণ ছড়াচ্ছেই—৭ ম্যাচ বাকি থাকা অবস্থায় শীর্ষে থাকা সিটির চেয়ে মাত্র ১ পয়েন্ট পিছিয়ে লিভারপুল।
গতকাল আরেকবার হয়ে গেল দুই দলের মল্লযুদ্ধ, মঞ্চ—ইংল্যান্ডের ফুটবলতীর্থ ওয়েম্বলি! বিশ্বের প্রাচীনতম ক্লাব টুর্নামেন্ট এফএ কাপের ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে এবার হাসিটা ক্লপের, গার্দিওলার সিটিকে কাল ৩-২ ব্যবধানে হারিয়ে ফাইনালে উঠে গেছে ক্লপের লিভারপুল।
তাতে ক্লপের একটা দারুণ রেকর্ডও হলো। কী রেকর্ড, সেটি বলার আগে একটু অতীত কপচানো যাক!
সেই ২০০৯ সালে গার্দিওলা বার্সেলোনার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তো স্প্যানিশ কোচের ফুটবল দর্শন ইউরোপে-বিশ্বে অন্য আবেদন নিয়ে হাজির হয়েছে, ১৩ বছরে গড়ানো কোচিং ক্যারিয়ারের প্রথম ৪-৫ বছর পরই সর্বকালের সেরা কোচদের সঙ্গে একই কাল্পনিক টেবিলে ওঠা-বসা গার্দিওলার।
মাঝে কিছুদিন মরিনিওর সঙ্গে তাঁর দ্বৈরথ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দুজনের কথার লড়াই আর পুরো ১৮০ ডিগ্রি বিপরীত ফুটবল দর্শনের কারণে আলোচনাটা বেশ গতিও পেয়েছে। এ পর্যন্ত গার্দিওলা সবচেয়ে বেশি ২৫ ম্যাচ খেলেছেন মরিনিওর বিপক্ষেই। কিন্তু একে তো মরিনিও এখন অনেকটাই ম্রিয়মাণ, তার ওপর উজ্জ্বল দিনগুলোতেও গার্দিওলার সঙ্গে সেভাবে পেরে ওঠেননি। এ পর্যন্ত ২৫ ম্যাচে গার্দিওলার ১২ জয়ের বিপরীতে মরিনিওর জয় ৭টি।
মরিনিওর জায়গায় ক্লপকে বসানোই কি উচিত এখন? রেকর্ড বলছে, গতকাল এফএ কাপ সেমিফাইনালে জয় নিয়ে এ পর্যন্ত গার্দিওলাকে ১০ বার হারিয়েছেন ক্লপ। হারে দুই অঙ্ক গার্দিওলা আর কোনো কোচের বিপক্ষেই দেখেননি!
সেটিও যদি অবাক না করে থাকে, আরেকটি তথ্য আপনাকে দেওয়া যায়। ক্যারিয়ারে এ পর্যন্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৪ বার ক্লপের মুখোমুখি হয়ে গার্দিওলা জিতেছেন ৯ বার, হেরেছেন ১০ বার। অন্তত ১০ বার খেলেছেন, এমন কোচদের মধ্যে ক্লপ ছাড়া আর কারও বিপক্ষেই গার্দিওলার জয়ের চেয়ে হার বেশি নেই!
গার্দিওলা: কোন কোচের বিপক্ষে কত হার
* গার্দিওলা অন্তত ১০ ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছেন, এমন কোচদের রেকর্ডই বিবেচনায় এসেছে
অন্তত ৫ বার মুখোমুখি হয়েছেন—এমন কোচদের মধ্যে জয়ের চেয়ে হার বেশি গার্দিওলা শুধু দেখেছেন আন্তোনিও কন্তের বিপক্ষে (জয় ২, হার ৩, ড্র ০)। আর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের উলে গুনার সুলশার জয়-হারে সমতা রাখতে পেরেছেন—৯ ম্যাচে ৪টি করে জয় ও হার গার্দিওলার। এর বাইরে অন্তত ৫ ম্যাচে মুখোমুখি বাকি সব কোচের বিপক্ষেই গার্দিওলার গল্পটা দাপটের। ক্লপের রেকর্ডটার মাহাত্ম্য এখন কি আরেকটু বেশি মনে হচ্ছে? হওয়ারই কথা!
দুজনের মধ্যে কথার লড়াইটা মরিনিও-গার্দিওলার মতো নয় বলে হয়তো ক্লপ-গার্দিওলার দ্বৈরথও সেভাবে কখনো আকর্ষণ জাগায়নি। ক্লপ তো অকপটেই মেনে নেন, গার্দিওলা বিশ্বের সেরা কোচ। গার্দিওলার পাল্টা প্রশংসা আসে, ক্লপের দলের সঙ্গে প্রতিটি ম্যাচ তাঁকে নতুন কিছু শেখায়।
দুজনের ফুটবলের ধরন এক নয়, তবে একেবারে দুই মেরুরও নয়। আক্রমণ দুজনেরই মূল অস্ত্র, সেটির ঢংটা আলাদা, এই যা! গার্দিওলার টিকি-টাকা, ক্লপের জেজেনপ্রেসিং। ক্লপের ভাষায় ‘বক্সিং বাউটে’র মতো ম্যাচগুলো সে কারণেই হয়তো আরও বেশি জমে।
ক্লপ-গার্দিওলার শ্রেষ্ঠত্বের আলোচনাও আরও পানি পায়। একে অন্যকে নিয়ত ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা, অন্যকে হারানোর নতুন উপায় খোঁজা...ক্লপ দ্বৈরথটার তুলনায় টেনেছেন টেনিসে রজার ফেদেরার আর রাফায়েল নাদালের লড়াইয়ের কথা। কিন্তু ফুটবলে? মেসি-রোনালদোর দ্বৈরথের মতোই তো!
ক্লপ বনাম গার্দিওলা
জার্মানিতে
ইংল্যান্ডে
সবচেয়ে বড় জয়
ক্লপ: বায়ার্ন ০: ৩ ডর্টমুন্ড (২০১৩) ও লিভারপুল ৩: ০ ম্যান সিটি (২০১৮)
গার্দিওলা: ম্যান সিটি ৫-০ লিভারপুল (২০১৭)