ক্লপ-গার্দিওলা যেভাবে চমকে দিলেন সবাইকে
রক্ষণভাগ থেকে মাঝমাঠ হয়ে ধীরেসুস্থে আক্রমণে ওঠার যে পদ্ধতিটা প্রায় এক যুগ আগে পেপ গার্দিওলা বার্সেলোনার কোচ হয়ে জনপ্রিয় করে দিয়েছেন, তার একটা গালভরা নাম আছে—টিকিটাকা। যদিও গার্দিওলা নিজে নিজের এই বিশ্বজয়ী কৌশলকে ‘টিকিটাকা’ নামে ডাকতে নারাজ। নামটা যা-ই হোক না কেন, বছরের পর বছর ধরে গার্দিওলার কৌশলকে সবচেয়ে কার্যকর করেছে দলের মাঝমাঠ।
বার্সেলোনার কথাই চিন্তা করে দেখুন। মাঝমাঠে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে গার্দিওলা কতটা আগ্রহী, সেটা বোঝা যেত যখন জাভি, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা ও সার্জিও বুসকেতসকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য সেস্ক ফ্যাব্রিগাস, হাভিয়ের মাচেরানোকেও অনেক সময় একাদশে জোর করে ঢুকিয়ে দিতেন গার্দিওলা। মেসিকে উদ্বুদ্ধ করতেন সুযোগমতো একটু নিচে নেমে খেলতে। বায়ার্নেও একই অবস্থা। কাগজে-কলমে মূল একাদশ যা–ই হোক, মাঝমাঠের ব্যাটনটা কখনোই হাতছাড়া করতে চাননি।
ফুলব্যাকদের রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডারের দুপাশে উঠিয়ে ‘হাফ ব্যাক’ হিসেবে খেলার লাইসেন্সও দিতেন। সিটিতেও তাই। ফার্নান্দিনিও, ডেভিড সিলভা কিংবা কেভিন ডি ব্রুইনার মতো বল পায়ে দক্ষ কিছু মিডফিল্ডার তো আগ থেকে ছিলেন। সঙ্গে যোগ করলেন বের্নার্দো সিলভা, রদ্রি, ইলকায় গুন্দোয়ান ও ফিল ফডেনদের। ‘হাই লাইন’ ডিফেন্সে খেলা ডিফেন্ডাররাও বল পায়ে মিডফিল্ডারদের মতো খেলেন। স্টোনস বল পায়ে এতটাই দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন, ২০১৮ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড দলের দু-এক ম্যাচে তাঁকে মিডফিল্ডে দেখা গেছে।
এত কিছুর লক্ষ্য একটাই। মাঝমাঠের লড়াইয়ে জেতো, ম্যাচ এমনিতেই জেতা হয়ে যাবে। কিন্তু নিজের মাঝমাঠনির্ভর ছক থেকে আস্তে আস্তে সরে আসতে শুরু করছেন গার্দিওলা। অন্তত ইয়ুর্গেন ক্লপের লিভারপুলের বিপক্ষে পরিকল্পনা বদলান পেপ। গত পরশু ম্যানচেস্টার সিটির মাঠে দেখা গেল ক্লপও বদলাচ্ছেন নিজেকে। ১-১–এ শেষ হওয়া ম্যাচে নিজের পছন্দের ছক থেকে সরে এসেছিলেন এ ম্যাচে। এ ম্যাচে দুজনই খেলেছেন অন্যকে আটকানোর জন্য।
২০১৭-১৮ মৌসুমে লিগে সিটির মাঠে দুই দলের ম্যাচে মাঝমাঠে গুনে গুনে পাঁচজনকে নামিয়েছিলেন গার্দিওলা। বিপরীতে লিভারপুলের ছিল তিনজন। ৫-০ গোলে হারা সে ম্যাচে অনেকে সাদিও মানের লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়ার কথা তুললেও আসল লড়াইটা লিভারপুল মাঝমাঠেই হেরে গিয়েছিল। এমনকি, তিনজন করে মিডফিল্ডার নামিয়েও বেশ কয়েক ম্যাচে জয়ের হাসি নিয়েই মাঠ ছেড়েছিলেন গার্দিওলা।
গার্দিওলার এই বিশ্বাসে ধীরে ধীরে চিড় ধরানো শুরু করেছেন ক্লপ। সবাইকে দেখালেন, কুশলী মিডফিল্ডার না থাকলেও শুধু কার্যকর প্রেসিং, পরিশ্রম ও দুর্দান্ত প্রতি–আক্রমণের মিশেলে গার্দিওলার কৌশলকে। ফলাফল? গার্দিওলা সিটির কোচ হওয়ার পর বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় ক্লপ হারিয়েছেন পাঁচবার। আর গার্দিওলা? কমিউনিটি শিল্ডে পেনাল্টি শুটআউটের জয় বাদ দিলে ৯০ মিনিটের খেলায় ক্লপকে হারিয়েছেন তিনবার।
অন্য কোনো ম্যানেজারের কাছে এত ম্যাচ হারেননি গার্দিওলা। স্বাভাবিকভাবেই মাঝমাঠনির্ভর ছক থেকে ধীরে ধীরে সরে যেতে শুরু করলেন, যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল পরশুর ম্যাচে। ১-১ গোলে ড্র হওয়া ম্যাচে গার্দিওলা দেখালেন, এত দিনের পরিচিত পেপ আর এই পেপের মধ্যে বিস্তর ফারাক। আগে যিনি মাঝমাঠে বল দখলের লড়াইকেই সবকিছু মনে করতেন, এখন ম্যাচ জেতার জন্য প্রয়োজনে অন্য কৌশলের শরণও নিতে পারেন।
ম্যাচটা দুই দলের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গত তিন লিগ এই দুই দলের ঘরেই গিয়েছে, তাও আবার যেমন-তেমনভাবে নয়, রেকর্ড পয়েন্টে। কয়েক বছর ধরে ইংলিশ লিগের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দ্বৈরথ এই ম্যাচকেই মানা হয়। স্বাভাবিকভাবেই এই ম্যাচের ওপরেও মৌসুম শেষে অনেক কিছুই নির্ভর করবে। এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে দুই কোচই চেষ্টা করলেন সাবধানী খেলার। সাধারণত ৪-৩-৩ ছকে খেলা এই দুই কোচ নিজ নিজ দলকে খেলানো শুরু করলেন ৪-৪-২/৪-২-৪ ছকে।
হ্যাঁ, টিভি স্ক্রিনে দেখা গেছে দুই দলই ৪-২-৩-১ ছকে খেলছে। আর এখানেই বড়সড় চমক দিয়েছেন দুই কোচ। কাগজে-কলমে ৪-২-৩-১ বলা হলেও মাঠের লড়াইয়ে দুই দলই খেলেছে ৪-২-৪ ছকে। এই ছকের মূল বৈশিষ্ট্যই হলো মাঝমাঠে থাকবেন মাত্র দুজন। ওদিকে আক্রমণভাগে থাকবে চারজন। ভাবা যায়, গার্দিওলা মাঝমাঠে মাত্র দুজন নিয়ে খেলছেন?
ক্লপের অবশ্য এই ছকে খেলানো ছাড়া তেমন কোনো উপায়ও ছিল না। দলের মূল ডিফেন্ডার ভার্জিল ফন ডাইক ও মূল রক্ষণাত্মক মিডফিল্ডার ফাবিনিও চোটে, গত দুই বছর ধরে গার্দিওলার সিটিকে হারানো ম্যাচগুলোয় যে দুজনের ভূমিকা আকাশসমান ছিল। ওদিকে দলে নতুন আসা পর্তুগিজ উইঙ্গার দিওগো জোতা আগুনে ফর্মে। বিখ্যাত আক্রমণ-ত্রয়ীকে ভাঙতে চাননি ক্লপ। আবার চাননি ফর্মে থাকা জোতাকে বসিয়ে রাখতে। ফলাফল? ফাবিনিওর জায়গায় বাড়তি মিডফিল্ডার না নামিয়ে জোতাকেই নামিয়ে দিলেন ক্লপ, চতুর্থ ফরোয়ার্ড হিসেবে।
এখানেই চমক দেখিয়েছেন গার্দিওলা। মাঝমাঠ দখলে এত মগ্ন থাকা গার্দিওলা মাঝমাঠে দুজন ছাড়া কাউকেই রাখলেন না। রদ্রি-গুন্দোয়ানকে মাঝমাঠে রেখে কেভিন ডি ব্রুইনা যোগ দিলেন গ্যাব্রিয়েল জেসুস, ফেরান তোরেস, রহিম স্টার্লিংদের সঙ্গে। চতুর্থ ফরোয়ার্ড হিসেবে লিভারপুলে যে কাজটা করছিলেন জোতা। সিটির খেলোয়াড়দের পায়ে যখনই বল থাকছিল, ৪-২-৪ ছকটা একটু বদলে ৩-৩-৪–এ রূপ নিচ্ছিল। আর ওপরে থাকা চারজনের কাজ ছিল চার ডিফেন্ডারের পেছনে একটু জায়গা ফাঁকা পেলেই প্রতি–আক্রমণে উঠে যাওয়া। যে কাজটা সালাহ-মানেদেরই এত দিন করতে দেখা গেছে।
মাঠের অপর প্রান্তে লিভারপুলের ফরোয়ার্ডরাও সে লক্ষ্যে ছিলেন। ওপরে দুই স্ট্রাইকার হিসেবে সালাহ, জোতা; একটু নিচে মানে-ফিরমিনো। মাঝমাঠ দখলের বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না হেন্ডারসন-ভাইনালডমের। ফাবিনিও থাকলে যেটা হয়, ডি ব্রুইনাকে প্রেস করে তাঁকে পছন্দের জায়গায় যেতে দেন না এই ব্রাজিলের মিডফিল্ডার। ফাবিনিওর অনুপস্থিতিতে প্রেস করার ঝামেলায় হেন্ডারসন ভাইনালডম কেউই যাননি। ডি ব্রুইনার পায়ে যেন সতীর্থদের কাছ থেকে বল না যায়, এটুকুই শুধু নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। দুই মিডফিল্ডারের মূল লক্ষ্য ছিল সিটি রক্ষণভাগের পেছনে একটু জায়গা পাওয়া গেলেই দ্রুততার সঙ্গে প্রতি–আক্রমণের চেষ্টা করা। যেন রক্ষণের ঘাটতিতে পাঁচ গোল খেলেও জবাবে ছয়টা দেওয়া যায়!
কিন্তু গার্দিওলা কি সেটা বোঝেননি? অবশ্যই বুঝেছেন। বুঝেছেন বলেই দুই সেন্টারব্যাক রুবেন দিয়াস ও এমেরিক লাপোর্তকে ওপরে ওঠার লাইসেন্স দেননি। লাইসেন্স দেননি হাই লাইনে খেলার। বরং রদ্রি নেমে যাচ্ছিলেন অনেকটা তৃতীয় সেন্টারব্যাকের মতো। দুই ফুলব্যাক ক্যানসেলো ও ওয়াকার, জার্মান মিডফিল্ডার গুন্দোয়ানের সঙ্গে মাঝমাঠ সামলাচ্ছিলেন, ওপরে বাকি তিন ফরোয়ার্ডের সঙ্গে ডি ব্রুইনা। লিভারপুল তাই প্রতি–আক্রমণের জায়গা পায়নি তেমন।
এই কৌশলে ডি ব্রুইনাকে প্রেস না করে বেশ কবার ঝামেলায় পড়ে যাচ্ছিল লিভারপুল। ডি ব্রুইনার পায়ে বল যাওয়া আটকাতে বেশ কবার ব্যর্থ হয়েছেন। সিটির গোলটাও এভাবেই এসেছে। ডান প্রান্ত থেকে সিটির রাইটব্যাক ওয়াকার ডি ব্রুইনাকে বল পাস দিচ্ছেন, এটা বুঝেছিলেন ভাইনালডম। এগিয়েও এসেছিলেন, কিন্তু শেষ মুহূর্তে হিসাবের গড়বড় হয়, ভাইনালডম একটু সামনে চলে যান। বাড়তি প্রেস না থাকার কারণে বল পেয়েই ডি বক্সে থাকা গ্যাব্রিয়েল জেসুসকে সফলভাবে বল পাঠিয়ে দেন এই বেলজিয়ান তারকা। মুহূর্তের মধ্যে ব্রাজিল স্ট্রাইকারের ওপর যেন ভর করে সাবেক আর্সেনাল তারকা ডেনিস বার্গক্যাম্পের ভূত। নিউক্যাসল ইউনাইটেডের বিপক্ষে ২০০১-০২ মৌসুমে অনেকটা একই রকমভাবে গোল করেছিলেন এই ডাচ্ স্ট্রাইকার। লিভারপুলের দুই ডিফেন্ডার ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার-আরনল্ড ও জল মাতিপকে বোকা বানানো গোলটা যেন ঠিক সেই গোলেরই ছায়া!
দুই দলই বুঝেছিল দুই দল কীভাবে খেলতে পারে। নিজেদের স্বাভাবিক খেলা না খেলে দুই দলই চেয়েছে সতর্কভাবে পারফর্ম করতে। যে কারণে শেষমেশ জয় কেউই পায়নি, হয়েছে পয়েন্ট ভাগাভাগি। আর ড্র হওয়া সে ম্যাচে নিজের দর্শন থেকে সরে এসে বেশ বড় ধরনের চমকই দেখালেন গার্দিওলা। ফাবিনিও-ফন ডাইককে না পাওয়া ক্লপও কি চমক দেখালেন না?