কে কিনবেন মুন্নার সেই জার্সি?
>দেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলার মোনেম মুন্নার জার্সি নিলামে উঠবে আজ। নিলামকারী প্রতিষ্ঠান 'অকশন ফর অ্যাকশনে'র ফেসবুক পেজে রাত সাড়ে ১০ টায় শুরু হবে নিলাম।
'মুন্নার মতো ফুটবলার এই দেশে ( বাংলাদেশ) জন্মেছে। তোমরা কেন পারবে না ভাই ? '
ব্রাদার্স ইউনিয়নের টিম মিটিংয়ে ভারতীয় কোচ সৈয়দ নঈমুদ্দিনের মুখে কথাটি শোনা গেছে বহুবার। ভারতীয় দ্রোণাচার্য এই কোচ যেন অলক্ষ্যে মুন্নাকে পাশে বসিয়েই তরুণ খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলতেন। নঈমুদ্দিনের অধীনেই ১৯৯১ সালে ইস্টবেঙ্গলের জার্সিতে কলকাতা জয় করেছিলেন মুন্না। সেই থেকেই মুন্নার প্রতি ভারতীয় জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও কোচের অগাধ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। মুন্নার নাম বলতে গিয়ে বর্ষীয়ান কোচের ভারি চোয়ালটা ঝুলে পড়তো আরও সামনে।
ভালোবেসে মুন্নাকে 'দ্যা কিং ব্যাক' নামে বুকে আসন পেতে দিয়ে ছিলেন দেশের ফুটবল প্রেমীরা। বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ককে বোঝাতে ওই–ই তো যথেষ্ট! কিডনির জটিল রোগে ১৫ বছর আগে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেও এখনো সুরভী ছড়িয়ে যাওয়া একটি নাম মোনেম মুন্না। দেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই ফুটবলারের বিশেষ একটি জার্সি নিলামে উঠতে যাচ্ছে আজ।
১৯৮৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়া বাংলাদেশ লাল দলের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ছিলেন মুন্না। সেই টুর্নামেন্টে পরে খেলা তাঁর '২' নাম্বার জার্সিটিই নিলামে তোলা হচ্ছে। জার্সি বিক্রির পুরো অর্থ প্রদান করা হবে করোনায় অসহায় হয়ে পড়া মানুষদের সহযোগিতায়।
১৯৮৬ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপিয়েছেন মুন্না। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত চার জাতি ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা জিতে বাংলাদেশ। ক্লাব ফুটবলে তিনি ছিলেন আবাহনী লিমিটেডের ঘরের ছেলে। ক্যারিয়ারের শুরুতে ১৩ নম্বর জার্সিতে খেললেও পরবর্তি সময়ে মুন্নার পরিচয় বহন করেছে '২'। এটাই ছিল তাঁর সিগনেচার নাম্বার। বর্তমান প্রজন্মের কাছে হয়তো গুরুত্বহীন এই জার্সির আবেদন। সেজন্যই হয়তো মুন্নাকে নিয়ে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান বা মুশফিকুর রহিমের ব্যাট বিক্রির মতো উন্মাদনা নেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
ইউরোপিয়ান ফুটবলে বুদ হয়ে থাকা দেশের তরুণ প্রজন্মের কাছে সাবেক ফুটবলার মুন্না অচেনাই থাকার কথা। তাদেরই বা দোষ কি! বিশ্ব ফুটবলের সঙ্গে যে বড্ড বেমানান দেশের ফুটবলের রুগ্ন চেহারাটা।
মুন্নার ফুটবল শৈলী বুঝানোর জন্য বাংলাদেশের সাবেক জার্মান কোচ অটো ফিস্টারের একটি মন্তব্যই যথেষ্ট ,'মুন্না ওয়াজ মিসটেকেইনলি বর্ন ইন বাংলাদেশ'। বাংলাদেশকে প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা জেতানো ফিস্টার বর্তমানে আছেন সুইজারল্যান্ডে। ১৯৯৮ সালে সৌদি আরব ও ২০০৬ সালে টোগোর বিশ্বকাপ দলের কোচ ছিলেন। এর আগে সেনেগাল , আইভরিকোস্ট ও পরবর্তীতে সামলেছেন ক্যামেরুনের মতো বিশ্বমানের দলের দায়িত্ব। ফুটবলের কত রথী মহারথীকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে তাঁর। তবু এই জার্মানের কাছে ফুটবলের তৃতীয় বিশ্বের বাংলাদেশের এক রক্ষণ সেনার মেধার কি কদর!
সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার হলেও সেখান থেকে উপরে উঠে গিয়ে আক্রমণের সূচনা হতো মুন্নার পা থেকে। ডিফেন্ডার হয়েও প্লেমেকারের ভূমিকা পালন করে হয়ে উঠেছিলেন দলের হ্রদপিন্ড। অভিজাত খেলার ধরণ ও দূরদর্শী নেতৃত্বে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলাদেশ দলের অবিসংবাদিত নেতা। হোয়াটসঅ্যাপে এই প্রতিবেদকের কাছে যেই শুনলেন নিলামে উঠবে মুন্নার বিখ্যাত দুই নাম্বার জার্সি, কণ্ঠে অস্ফুটে বেরিয়ে এলো, 'মুন্না মনে রাখার মতো একজন খেলোয়াড় ও নেতা। এই জন্যই তাঁর মতো একজন নায়কের জার্সি নিলামে উঠেছে। এটাই প্রমাণ করে সে কতটা জনপ্রিয় ছিল।'
মুন্নার মৃত্যুর পর খুব যত্ন করে তাঁর আটটি জার্সি ও এক জোড়া বুট আগলে রেখেছেন তাঁর স্ত্রী সুরভী মোনেম। তবু করোনার এই সংকটকালে দেশের দুস্থ মানুষের সহায়তার লক্ষ্যে মু্ন্নার প্রিয় জার্সিটা বের করে দিয়েছেন তিনি। সুরভীর প্রত্যাশা শুধুই মুন্নার জার্সির সম্মান, 'খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম জার্সিটি। মুন্নার কথা মনে পড়লেই দেখতাম। দুস্থ মানুষদের সহায়তার লক্ষ্যে জার্সিটি নিলামের জন্য দিয়েছি। এখান থেকে আমার কিছু চাওয়ার নেই। আমি শুধু চাই আমার স্বামী মুন্নার সম্মান যেন থাকে। জার্সি বিক্রির পুরো অর্থই প্রদান করা হবে দুস্থদের সহায়তায়।' জার্সির ভিত্তি মূল্য রাখা হয়েছে দুই লাখ টাকা।
আজ একই রাতে নিলামে উঠতে যাচ্ছে ক্রিকেটার মুশফিকুর রহিমের টেস্টে একমাত্র ডাবল সেঞ্চুরির ব্যাট, অনূর্ধ্ব–১৯ বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক আকবর আলীর জার্সি ও গ্লাভস এবং সাবেক ফিফা রেফারী তৈয়ব হাসানের জার্সি। সব নিলামেরই উদ্দেশ্য করোনার দুঃসময়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো।
মুন্না আজ পৃথিবীতে নেই, তবে দূরলোক থেকে হয়তো খেয়াল রাখবেন, তাঁর জার্সির সম্মান কতটা দেয় মানুষ।