>কোবে ব্রায়ান্টের মৃত্যুশোক এখনো পুরোনো হয়নি। প্রায় তিন বছর পেরিয়ে গেছে, তবু শাপেকোয়েনস দলটার জন্য এখনো হয়তো কাঁদেন অনেক ফুটবলপ্রেমী। খেলা যুগে যুগে আনন্দ যেমন দিয়েছে, কষ্টও যে কম দেয়নি! কখনো দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন প্রিয় খেলোয়াড়, প্রিয় দল, কখনো ভক্তরা প্রাণ দিয়েছেন খেলার প্রতি তাঁদের ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে। কেউ বেঁচে ফিরেছেন অবিশ্বাস্যভাবে, কারও কারও মৃত্যু রয়ে গেছে চিরদিনের রহস্য হয়ে। খেলার জগতে ঘটে যাওয়া এমন স্মরণীয় কিছু ট্র্যাজেডি নিয়েই এবারের আয়োজন। ধারাবাহিকের আজ প্রথম পর্ব—
সুপারগার কালো মেঘ
শেষ মুহূর্তে ছেলেটা অসুস্থ হয়ে পড়ল। খেলার চিন্তা বাদ দিয়ে বাবা তাই ছেলের পাশে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। সতীর্থদের সঙ্গে পর্তুগালে যাওয়া হলো না তাঁর।
ইনজুরি থাকায় খেলতে পারবেন না, এ ব্যাপারে আগেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন একজন। অন্য একজনের সব ঠিকঠাক থাকার পরও পর্তুগালের ভিসা মিলল না। এ তিনজন ছাড়াই বেনফিকার বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচটা খেলার জন্য উড়াল দিল ইতালির তুরিনো ফুটবল ক্লাব। কখনো ফেরা হবে না জানলে হয়তো বাকি তিন সতীর্থের মতো থেকে যেতেন তাঁরাও। কিন্তু ভবিষ্যৎ জানার সাধ্য কার!
ফেরার পথে আবহাওয়া খারাপ ছিল। তবে এতটা খারাপও না যে অবস্থা বেগতিক দেখে তুরিনো তাদের ফ্লাইট বাতিল করবে। সুপারগা পাহাড়ের কাছে এসে কালো মেঘের আড়ালে ঢাকা না পড়লে হয়তো নিরাপদেই দেশে পৌঁছে যেতেন তাঁরা। কিন্তু ওই যে নিয়তি! সামনে কী আছে, সেটা দেখাই অসম্ভব হয়ে গেল পাইলটের জন্য। রেডিওটাও খারাপ হলো ঠিক ওই সময়। নিচে নামতে গিয়ে সুপারগা পাহাড়ের পাদদেশের ব্যাসিলিকা চার্চের উঁচু এক দেয়ালে ধাক্কা খেল ইতালিয়ান এয়ারলাইনসের ফিয়াট জি-২১২ বিমানটা। দিনটা ছিল ১৯৪৯ সালের ৪ মে। ১৮ জন ফুটবলার, বেশ কয়েকজন ক্লাব কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও বিমানের কর্মকর্তা মিলিয়ে ৩১ জন ছিলেন বিমানে। কেউ বাঁচেননি।
এটা যে সময়ের কথা, তখন সিরি ‘আ’তে তুরিনোর জয়জয়কার। সে মৌসুমসহ টানা চারবারের লিগ চ্যাম্পিয়ন তারা। সমর্থকেরা ভালোবেসে নাম দিয়েছিল ‘গ্রান্দে তুরিনো’ (দ্য গ্রেট তুরিনো)। যে ১৮ জন ফুটবলার মারা গিয়েছিলেন, তাঁদের ১০ জনই তখন খেলেন ইতালির জাতীয় দলে!
ক্ষতিটা কখনো পুষিয়ে উঠতে পারেনি তুরিনো। হঠাৎ এতজন খেলোয়াড়ের চিরবিদায়ের ক্ষতি পোষাতে ইতালি জাতীয় দলেরও সময় লেগেছিল। ত্রিশের দশকে দুবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের তাই পরের ফাইনালটা খেলার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৯৭০ সাল পর্যন্ত!
ক্রোধে উন্মত্ত লিমা
আর্জেন্টিনাই এগিয়ে ছিল ম্যাচটায়। তখনকার সময় তাদের অন্যতম বড় প্রতিদ্বন্দ্বী পেরুর বিপক্ষে অলিম্পিক ফুটবলের বাছাইপর্ব চলছিল। লিমা স্টেডিয়ামে খেলা শেষ হওয়ার মিনিটখানেক আগে পেরুর একটা গোল বাতিল করে দিলেন রেফারি। ব্যস, বদলে গেল দৃশ্যপট। ক্ষুব্ধ স্বাগতিক সমর্থকদের রোষানলে পড়লেন প্রথমে রেফারি, পরে অতিথি সমর্থকেরা। পরের ঘটনাগুলোর কারণে ইতিহাসে এখনো কলঙ্কিত দিন হয়ে আছে ২৪ মে, ১৯৬৪।
ক্রোধে উন্মত্ত দুই দলের সমর্থকদের উত্তেজনা রূপ নেয় অরাজকতায়। যেন হিংস্র হয়ে উঠেছিল লিমা স্টেডিয়াম! পুলিশ কেন, সেদিন উন্মত্ত সমর্থকদের থামানোর সাধ্য ছিল না কারোরই। নিজে থেকে যখন থামল, তখন আর কারও বোঝার উপায় নেই যে এ স্টেডিয়ামে কিছুক্ষণ আগে ফুটবল খেলা হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রের মতো ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে লাশ। ততক্ষণে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন ৩১৮ জন। গুরুতর আহত হয়েও কোনোরকমে প্রাণে বেঁচেছেন পাঁচ শতাধিক।
যাঁদের কিছু হয়নি, কিন্তু সেদিন লিমা স্টেডিয়ামে ছিলেন, পরের বহু বছর তাঁদেরও কি মাঠে গিয়ে খেলা দেখার কথা ভাবলে বুক শিউরে উঠত না?
ভয়াল আন্দেজ: এভাবেও ফিরে আসা যায়!
রবার্তো কানেসা বেঁচে আছেন এখনো। ১৯৯৪ সালে উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনও করেছেন। সেদিনের মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র এখন উরুগুয়ের নামকরা হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ। বেঁচে আছেন নান্দো প্যারাদোও। ৩৮ বছর আগের উরুগুয়ের সেই রাগবি খেলোয়াড় এখন একটা ক্লাবের মালিক। সঙ্গে টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকানা, বেশ কিছু কলকারখানা মিলিয়ে পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী প্যারাদো। এত সাফল্যের পেছনে পরিশ্রম তো অবশ্যই আছে, কিছুটা কি ভাগ্যের সহায়তাও ছিল না? হয়তো ছিল। কিন্তু ভাগ্যও কি আর সবাইকে সঙ্গী করে?
ওই যে কথায় আছে না, ‘ভাগ্য সাহসীদের সঙ্গ দেয়।’ নাম দুটি যাঁদের চেনা, তাঁরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, কানেসা ও প্যারাদোর সাহসের কোনো অভাব ছিল না। নইলে ৩৮ বছর আগে আন্দেজের সেই ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার পরও বেঁচে ফিরেছেন কীভাবে? সাহসের জোরে কানেসা ও প্যারাদো শুধু নিজেদের নয়, বাঁচিয়েছিলেন তাঁদের আরও ১৪ জন সহযাত্রীকে।
১৯৭২ সালের ১৩ অক্টোবর। উরুগুয়ের মন্টেভিডিও থেকে বিমানে করে চিলির সান্তিয়াগোতে যাচ্ছিল ওল্ড ক্রিস্টিয়ান রাগবি ক্লাব। প্যারাদো ছিলেন সে দলের সদস্য। বিমানের ৪৫ জন যাত্রীর মধ্যে খেলোয়াড় ছাড়াও ছিল তাঁদের পরিবার-পরিজন, দলের কর্মকর্তা ও বিমানকর্মী। বিস্ময়করভাবে পাইলট নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলায় ফ্লাইট-৫৭১ বিধ্বস্ত হলো আন্দিজ পর্বতমালায়, আর্জেন্টিনা-চিলি সীমানার কাছাকাছি। তাৎক্ষণিকভাবে মারা যান ১২ জন। পরের দিন সকালে আরও পাঁচজন।
যে জায়গাটায় বিমান বিধ্বস্ত হয়েছিল, সেটি ১১ হাজার ফুট উঁচুতে। বিমানের রং সাদা হওয়ায় বরফ ঢাকা পাহাড়ে সেটা খুঁজে বের করাও খুব কষ্টকর ছিল। দুর্ঘটনার আট দিন পর বিমানে থাকা একমাত্র রেডিওর মাধ্যমে যাত্রীরা জানতে পারলেন, তাঁদের খোঁজার অভিযান বাতিল করা হয়েছে। বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় পরীক্ষাটা শুরু হলো কানেসা-প্যারাদোদের।
প্রচণ্ড শীত সামলানোর মতো জামাকাপড় ছিল না। তার ওপর উচ্চতায় অক্সিজেনের অভাব। খাবার নেই, তাই একসময় মৃত সহযাত্রীদের মাংস খেয়ে বাঁচার সংগ্রাম শুরু করলেন তাঁরা। কিন্তু এভাবে কত দিন? কানেসা আর প্যারাদো সিদ্ধান্ত নিলেন সাহায্য খুঁজতে বেরোনোর। তত দিনে দুর্ঘটনার দুই মাস পেরিয়ে গেছে।
১৯৭২ সালের ১২ ডিসেম্বর শুরু হলো কানেসা আর প্যারাদোর যাত্রা। পাহাড়ি পথে টানা ১২ দিন ট্রেকিংয়ের পর দেখা পেলেন সার্জিও কাতালান নামের চিলির এক আদিবাসীর। তাঁকে নিয়েই চিলির এক গ্রামের পুলিশ ফাঁড়িতে পৌঁছালেন তাঁরা। সেখান থেকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করার পর পাঠানো হলো হেলিকপ্টার। দুর্ঘটনার ৭২ দিন পর উদ্ধার করা হলো বেঁচে থাকা ১৬ জনকে। ঝুঁকি নিয়ে নিজেদের ও সহযাত্রীদের জীবন বাঁচান কানেসা-প্যারাদো।
হতে পারে উরুগুয়ের অখ্যাত কোনো রাগবি ক্লাব, কিন্তু প্যারাদোদের জীবনে ঘটে যাওয়া এ ভয়াবহ ঘটনা যেমন এখনো কাঁদায় সারা বিশ্বকে, তেমনি অবিশ্বাস্যভাবে কয়েকজনের ফিরে আসাটা প্রেরণাও জোগায় বেঁচে থাকার।
চলবে...