কান্তেই চেলসির নেইমার, এমবাপ্পে, সালাহ, ফন ডাইক, ডি ব্রুইনা
‘ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর শারীরিক ক্ষমতা, ইব্রাহিমোভিচের শরীরের নমনীয়তা, সের্হিও রামোসের হেডে দক্ষতা, এমবাপ্পের গতি, মেসির বাঁ পা, আমার ডান পা, লেভানডফস্কির জায়গা নেওয়ার দক্ষতা, কান্তের ট্যাকলিং আর মাঝমাঠে ভেরাত্তির সৃষ্টিশীলতা’—বছরখানেক আগে নেইমারের উত্তরটা ছিল এমন। পিএসজির ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ডের কাছে প্রশ্ন ছিল, তাঁর চোখে আদর্শ ফুটবলার কে?
চেলসি কোচ টমাস টুখেলকে এমন কোনো প্রশ্ন করা হয়নি। তবে নিজ দলের মিডফিল্ডার এনগোলো কান্তের বর্ণনায় যা বলেছেন টুখেল, তাতে নেইমারের আদর্শ ফুটবলারের বিশ্লেষণ মনে পড়তে পারে অনেকের। টুখেলের চোখে, লিভারপুলে মো সালাহ আর ভার্জিল ফন ডাইক যা, পিএসজিতে নেইমার বা কিলিয়ান এমবাপ্পে যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ম্যানচেস্টার সিটিতে কেভিন ডি ব্রুইনা যেমন...চেলসিতে কান্তে তা-ই।
নিজেদের মাঠে লেস্টার সিটির বিপক্ষে লিগে গতকাল পিছিয়ে পড়েও ১-১ গোলে ড্র করেছে চেলসি। গ্যালারিতে ক্লাবের সম্ভাব্য নতুন মালিক টড বোয়েলির উপস্থিতিতে জয় পেল না চেলসি। তবে এ ড্রয়ে চেলসির পয়েন্ট তালিকার তিনে থেকেই লিগ শেষ করা অনেকটা নিশ্চিত হয়ে গেছে। কিন্তু এই তৃতীয় হওয়াকেই ‘মিরাকল’ জানিয়ে এর পেছনের কারণের বিশ্লেষণে চেলসি কোচ টুখেল নিয়ে এলেন কান্তের কথা।
আরও নির্দিষ্ট করে বললে কান্তের অনুপস্থিতির কথা। চোটে চোটে মৌসুমটাতে এবার ঠিকমতো খেলতেই পারেননি ফরাসি মিডফিল্ডার, গতকালই শুরুর একাদশে নেমেছেন ২৮ এপ্রিলের পর প্রথমবার। এবারের মৌসুমে লিগে ৩৮ ম্যাচের মধ্যে ২০টিতে খেলতে পেরেছেন কান্তে।
কখনো ফিটনেসজনিত সমস্যা, কখনো কুঁচকির চোট, কখনো পেশিতে চোট, কখনো করোনা...সব মিলিয়ে মৌসুমটাতে মাঠের বাইরেও অনেকটা সময় কেটেছে কান্তের। গত মৌসুমে চেলসির চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের পথে তর্ক সাপেক্ষে সবচেয়ে বড় অবদান রাখা কান্তেকে এবার কতটা মিস করেছেন, সেটি বোঝাতেই হয়তো এমন কথা টুখেলের।
‘আমার চোখে সে আমাদের দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। কিন্তু এই অনেক গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়কে তো মাঠে থাকতে হবে! এমন একজন যদি মৌসুমে ৪০ শতাংশ ম্যাচ খেলে, সে ক্ষেত্রে আমরা যে লিগে তৃতীয় হতে পারছি, সেটাই একটা মিরাকল। ও আমাদের মো সালাহ, আমাদের ফন ডাইক, আমাদের ডি ব্রুইনা। সহজভাবে বলতে গেলে ও এমনই একজন খেলোয়াড়’—চেলসি কোচের কথা।
শুধু তিনটি নাম নিয়েই সম্ভবত মন ভরেনি টুখেলের। এরপর নিজের সাবেক ক্লাব পিএসজির দুই খেলোয়াড়ের নামও টেনে আনলেন, ‘ও আমাদের নেইমার, আমাদের কিলিয়ান এমবাপ্পে। ও এমন একজন যে পার্থক্য গড়ে দেয়। আর এমন একজনকে শুধু ৪০ শতাংশ ম্যাচে পাওয়া মানে সেটা একটা অনেক বড় সমস্যা।’
সেই কান্তেকে ছাড়াই এবার লিগে তৃতীয় হওয়া কত বড় অর্জন, সেটা বোঝাতে একবার তো ‘মিরাকল’ বলেছেনই, তবে সেখানেও মন ভরেনি টুখেলের। গত মৌসুমে ফন ডাইককে ছাড়া লিভারপুলের অবস্থার সঙ্গে দলের তুলনা টেনেছেন, ‘আমরা যেভাবে ধারাবাহিকভাবে ম্যাচ থেকে ফল বের করে আনতে পেরেছি, সেটা একটা মিরাকল। পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করে ব্যাপারটা বুঝতে হবে। কারণ, গত মৌসুমে লিভারপুলকে দেখেছি, ফন ডাইককে ছাড়া ওরা বেশ ভালোই ভুগেছে। পার্থক্যটা চোখে দেখা যায়। এনগোলো আমাদের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় এবং ওর মাঠে থাকাটা আমাদের দরকার।’
গত মৌসুমে প্রায় পুরোটা সময়ই চোটের কারণে মাঠের বাইরে ছিলেন ফন ডাইক, তাঁকে ছাড়া ধুঁকতে থাকা লিভারপুল শেষ পর্যন্ত লিগে তৃতীয় হয়েছে। অবশ্য ফন ডাইকের চোটের পরও অনেকটা সময় লিগের পয়েন্ট তালিকার শীর্ষেই ছিল লিভারপুল। কিন্তু মৌসুমের মাঝামাঝি পর্যায়ে ফন ডাইকের পাশাপাশি জোয়েল মাতিপ, জো গোমেজ, ফাবিনিও...সবার দীর্ঘমেয়াদি চোট মিলিয়ে রক্ষণভাগের এমনই অবস্থা ছিল যে তরুণ রিস উইলিয়ামস, ন্যাট ফিলিপস আর ধারে আনা ওজান কাবাকদের দিয়ে কাজ চালাতে হয়েছে লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপকে। তা নিয়েই শেষ পর্যন্ত লিগে তৃতীয় হয়েছে লিভারপুল।
চেলসির এবারের লিগে তৃতীয় হওয়া অবশ্য এখনো একেবারে অঙ্কের হিসাবে নিশ্চিত হয়ে যায়নি। তবে অঙ্কের হিসাবও যে এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়, সেটি পয়েন্ট তালিকায় তাকালেই বোঝা যাবে। লিগে আর এক ম্যাচ বাকি সব দলের, তিনে থাকা চেলসির পয়েন্ট ৭১, চারে থাকা টটেনহামের ৬৮। শেষ ম্যাচে চেলসির হার আর টটেনহামের জয়ে দুই দলের পয়েন্ট সমান হবে ঠিকই, তবে সে ক্ষেত্রেও গোল ব্যবধানের হিসাবটা চেলসিকে নির্ভার রাখবে। এ মুহূর্তে চেলসির গোল ব্যবধান (+) ৪২, টটেনহামের (+২৪)। অর্থাৎ চেলসির হার আর টটেনহামের জয়টা এমন ব্যবধানে হতে হবে, যাতে ১৮ গোলের ব্যবধানও ঘুচে যায়। একটু কঠিনই বটে!
কাল অবশ্য চেলসির জয় না পাওয়াই একটা মিরাকল ছিল। ম্যাচে বলের দখল ছিল চেলসির কাছে ৬৮ শতাংশ, শটেও লেস্টারের (২) ১০ গুণ চেলসি (২০)। কিন্তু ৬ মিনিটে জেমস ম্যাডিসনের গোলে লেস্টারই এগিয়ে যায়, ৩৪ মিনিটে মার্কোস আলোনসোর গোলে সমতায় ফেরে চেলসি।
কিন্তু ম্যাচ শেষে আলোচনা কান্তেকে নিয়েই বেশি ছিল। নিয়মিত খেলতে না পারা কান্তের ছন্দ নষ্ট করে দিচ্ছে বলে মনে হয় টুখেলের। আবারও তুলনায় ফিরে যান গত মৌসুমে, ‘চ্যাম্পিয়নস লিগে সর্বশেষ পাঁচ ম্যাচেও ও ছিল ম্যাচসেরা। ওরা তো পারলে ম্যাচের আগেই ওকে ম্যাচসেরার পুরস্কার দিয়ে দিত। অথচ যে কিনা চ্যাম্পিয়নস লিগে গত মৌসুমে সব ম্যাচে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছে, সে-ই এবার খেলতে পেরেছে মাত্র ৪০ শতাংশ ম্যাচে।’
এতে ভাগ্যেরই দোষ দেখেন টুখেল, ‘ওকে দোষ দিই না আমি। এটা আমাদের জন্য উদ্বেগের। আমরা ওকে বেশিই মিস করেছি। কারণ, ও মাঠে এমন কিছু করতে পারে, যেটা বিশ্ব ফুটবলেই অনন্য। সবাইকে জাগিয়ে তুলতে পারে, ম্যাচে পার্থক্য গড়ে দিতে পারে। ওর জন্যও ব্যাপারটা একটা চ্যালেঞ্জ, আমাদের জন্যও।’