কাঁদছে নাপোলি, রক্ত ঝরছে আর্জেন্টাইনদের বুকে
তাঁর জীবনটা কখনো সরলরেখায় চলেনি। এই এক মুহূর্তে মুগ্ধ করেছেন ফুটবল জাদুতে, তো পর মুহূর্তে ডিয়েগো ম্যারাডোনা নামটা জড়িয়ে গেছে বিতর্কে। কখনো মাদক, কখনো ইতালিয়ান মাফিয়ার সংগত।
উত্থান-পতনে ভরা ৬০ বছরে ম্যারাডোনার জীবনে দুটি শব্দ সব সময় গৌরব হয়ে থেকেছে। আর্জেন্টিনা, নাপোলি। ম্যারাডোনার প্রাণ আজ তাঁর দেহ ছেড়েছে, কিন্তু আর্জেন্টিনা জাতীয় দল আর ক্লাব ফুটবলে নাপোলির জার্সিতে কীর্তিগুলো ম্যারাডোনা নামটাকে কখনো নিষ্প্রাণ রাখবে না।
তাঁর অন্যলোকে যাওয়ার দিনে আর্জেন্টিনা আর নেপলসের মানুষের আজ হৃদয় ভাঙা, রক্ত ঝরছে সেখানে। প্রতিটি হৃৎপিণ্ডের একেকটি ধ্বনি হয়তো আজ সেখানে হাহাকারের আওয়াজ তুলছে।
শোকে বিহ্বল আর্জেন্টিনা এরই মধ্যে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে। চিরদিনের যে শোক, তাতে তিন দিনে ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা হয়তো।
‘ডিয়েগো আরমান্ডো ম্যারাডোনার মৃত্যুশোকে দেশের প্রেসিডেন্ট মৃত্যুর দিন থেকে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছেন’—জানানো হয়েছে দেশটির প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে। ‘প্রতিটি দুয়ার আজ ডিয়েগোর জন্য খোলা’—আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যম টিওয়াইসি স্পোর্টসে শোক জানাতে গিয়ে বলেছেন আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্দেজ।
আর্জেন্টিনার সাবেক প্রেসিডেন্ট মরিসিও মাক্রির কথাগুলো হয়তো প্রতিটি আর্জেন্টাইনেরই হৃদয়ের কথা, ‘বিশ্বজুড়ে ফুটবল সমর্থকদের জন্য খুব দুঃখের দিন, বিশেষ করে আর্জেন্টাইনদের জন্য। যে অবারিত আনন্দ ডিয়েগো আমাদের দিয়েছেন, সেটির অনুভূতি কখনো মুছে যাবে না।’
আর্জেন্টিনা তাঁকে হৃদয়ে ধারণ করে। এত বিতর্ক, এত মাদকের প্রতি ভালোবাসা—সব সত্ত্বেও তিনি আর্জেন্টাইনদের হৃদয়ের খুব কাছের।
মেসি না ম্যারাডোনা বিতর্কে আর্জেন্টাইনদের কাছে সব সময় ম্যারাডোনা এগিয়ে থাকার একটা কারণ ছিয়াশির বিশ্বকাপ এনে দেওয়ার পথে ম্যারাডোনার চিরসবুজ হয়ে থাকা কীর্তি বটে, তবে তার চেয়েও বড় কারণ হয়তো এই—আর্জেন্টাইনরা তাঁর মধ্যে নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখে।
মেসি তাঁদের চোখে বাড়ির পাশের ভদ্র ছেলেটি, ম্যারাডোনা তাঁদের নিজ ঘরের মানুষ। ম্যারাডোনা তাঁদের কাছে উপাস্য। তাঁর নামে আর্জেন্টিনায় মন্দির আছে। শুধু সেখানকার ‘দেবতা’ এখন সত্যিই অন্যলোকের।
আর নেপলস? ম্যারাডোনা সেখানেও মানুষের ভালোবাসায় বাঁধা। মৃত্যুর কী সাধ্য সে বাঁধন ছিঁড়ে ম্যারাডোনাকে নিয়ে যায়! এই শহরের ক্লাবটাকে ম্যারাডোনা নিজ হাতে ইউরোপে, বিশ্বে চিনিয়েছেন। এখনো ক্লাবটার ক্যাবিনেটে শোভা পাওয়া দুই লিগ শিরোপা আর এক উয়েফা কাপ ম্যারাডোনারই অবদান।
কিন্তু শিরোপা তো বাহ্যিক স্বীকৃতি, নেপোলিতানদের ফুটবল পায়ে যে বিমলানন্দে মোহিত করেছেন ম্যারাডোনা, সে-ও কি শিরোপার চেয়ে কম!
সে কারণেই হয়তো, এই নাপোলিতেই ১৯৯০ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ইতালির মুখোমুখি যখন হয় আর্জেন্টিনা, নাপোলি দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। একদিকে নিজ দেশ, অন্যদিকে ম্যারাডোনা। দেশপ্রেমের অনড় সীমাটাকে একটু বাঁকিয়ে সেখানে সেদিন ম্যারাডোনাকেও জায়গা দিয়েছিলেন নেপোলিতানরা।
‘ম্যারাডোনা আমাদের হৃদয়ে, ইতালি আমাদের সংগীতে’—নেপলসের মানুষের ভালোবাসা সেদিন ছিল দুই ভাগ। কয়েক হাজার মাইল দূরের বাংলাদেশে ম্যারাডোনার মৃত্যু এত আপন বিয়োগের অনুভূতি দিয়ে যায়, তাহলে নাপোলিতে কী হবে, তা অনুমান করা দুঃসাধ্য কি?