এউইন মরগান, আন্দ্রে রাসেল, সুনীল নারাইন, প্যাট কামিন্স, লকি ফার্গুসন, টম সেইফার্টরা আগে থেকেই ছিলেন। এবার সে তালিকায় যুক্ত হয়েছেন দুই অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান ও বেন কাটিং।
বলা হচ্ছে কলকাতা নাইট রাইডার্সের বিদেশি খেলোয়াড়দের কথা। আইপিএলের মূল একাদশে সর্বোচ্চ চারজন বিদেশি খেলতে পারেন। আর কলকাতার মূল একাদশে মরগান, রাসেলের থাকা মোটামুটি নিশ্চিত। মরগান তো দলের অধিনায়কই। সাড়ে ১৫ কোটি রুপির অস্ট্রেলিয়ান পেসার প্যাট কামিন্সও দলের পেস বিভাগের মূল দায়িত্ব সামলাবেন গত বছরের মতো, এটা বলেই দেওয়া যায়। ফলে বাকি যাঁরা আছেন, তাঁদের মূল একাদশে ঢোকা বেশ কঠিনই বলা চলে।
গতবার রাসেল আর নারাইন মোটামুটি অফ ফর্মে ছিলেন, এর সঙ্গে পিচের ধরনের কথা মাথায় রেখে মাঝেমধ্যেই লকি ফার্গুসনকে খেলিয়েছিল কলকাতা। টম ব্যান্টন কিংবা ক্রিস গ্রিনের মতো বিদেশিদের খেলানো হলেও লাভ হয়নি। ফলাফল এবার তাঁরা দলেই নেই। ফলে কলকাতা এবার সাকিব আল হাসানকে যখন কিনল, সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল, সাকিব কি মূল একাদশে সুযোগ পাবেন? কিছু ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ও ভারতীয় ক্রিকেট বিশ্লেষকের কথা মানলে এবার মরগান, রাসেল, কামিন্স ও নারাইন—কলকাতার বিদেশি এই চতুষ্টয়ে ভাঙন ধরাতে পারেন বাংলাদেশের সাকিব।
হার্শা ভোগলের কথাই ধরুন। ভারতের পোড় খাওয়া এই ধারাভাষ্যকার, উপস্থাপক ও ক্রিকেট বিশ্লেষক মনে করেন, সাকিব অবশ্যই খেলবেন কলকাতার মূল একাদশে। শুধু তা-ই নয়, কলকাতার ব্যাটিং অর্ডারের তিন নম্বরে বাংলাদেশের এই অলরাউন্ডারকে খেলানো উচিত বলে তিনি মনে করেন।
ক্রিকবাজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হার্শা ভোগলে সাকিবকে দলে নেওয়ার পেছনে যেসব যুক্তি দেখিয়েছেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো ২০১৯ বিশ্বকাপে সাকিবের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স। বাঁহাতি অলরাউন্ডার যে তিন নম্বরে কতটা বিধ্বংসী হতে পারেন, সেটার উদাহরণ তিনি ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপেই দেখিয়েছেন গোটা বিশ্বকে। আট ম্যাচের মধ্যে সাতটিতেই ছিল পঞ্চাশ ছাড়ানো স্কোর- দুটি সেঞ্চুরি ও পাঁচটি হাফ সেঞ্চুরি। ৬০৬ রান তুলেছেন প্রায় ৮৭ গড়ে।
গৌতম গম্ভীর, সূর্যকুমার যাদব, মনীশ পান্ডে ও রবিন উথাপ্পার মতো ব্যাটসম্যানরা চলে যাওয়ার পর থেকেই কলকাতা নাইট রাইডার্স টপ অর্ডার নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় আছে। সঠিক রসায়নই বের করতে পারছে না। শুবমান গিল একটু দেখেশুনে খেলতে পছন্দ করেন, প্রথম থেকেই তাঁর ব্যাটে ঝড় দেখার আশা করা বৃথা। ওদিকে ইনিংসের শুরুতে ধুন্ধুমার ব্যাটিংয়ের জন্য গত কয়েক মৌসুম ধরেই লোয়ার অর্ডারের সুনীল নারাইনকে টেনে ওপেনিংয়ে এনে খেলিয়েছে কলকাতা। ফাটকাটা আগে কাজে লাগলেও এখন বোলাররা বুঝে গেছেন নারাইনের দুর্বলতা।
ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান অলরাউন্ডার বাউন্সার সামলাতে পারেন না, স্পিন বোলিং ছাড়া সেভাবে মেরে খেলতেও পারেন না। নারাইন ক্রিজে এলেই তাঁকে গতি দিয়ে নিয়মিত পরাস্ত করছে প্রতিপক্ষ। ফলে অধিকাংশ ম্যাচে ঝড় তোলার আগেই প্যাভিলিয়নে ফেরত যাচ্ছেন এই ক্যারিবীয়। স্ট্রাইক রেট ১৫০ এর ওপরে হলেও ২০১৯ সালের পর নারাইনের রান ২২ ম্যাচে মাত্র ২৬৪, অর্থাৎ গড় দশের চেয়ে একটু বেশি। প্রতি ম্যাচের শুরুতে ‘ঝোড়ো’ দশ রানের আশায় সাকিবের মতো অলরাউন্ডারকে বসিয়ে রাখাটা হার্শার কাছে অর্থহীন বলে মনে হয়েছে।
বল হাতেও নারাইন যে খুব বেশি আলো ছড়াচ্ছেন, তা নয়। ৭.৮৮ ইকোনমি আর প্রায় ৩৩ স্ট্রাইক রেটে ১৫ উইকেট নিয়েছেন। অর্থাৎ প্রতি ম্যাচে চার ওভার বল করলে অন্তত ত্রিশ রান দিচ্ছেন নারাইন, উইকেট পাচ্ছেন গড়ে একটার মতো। হার্শার মতে, সাকিব একই কাজ বর্তমানে নারাইনের চেয়েও ভালো করতে পারবেন। এ ছাড়া নিয়মিত প্রশ্নবিদ্ধ অ্যাকশনের জন্য আইসিসির নজরদারির মধ্যে থাকা নারাইন কীভাবে পরিবর্তিত অ্যাকশনে বল হাতে সফল হন, সেটাও দেখার বিষয়।
আদর্শ রসায়নের আশায় গতবার টপ অর্ডারে গিল, নারাইন, নিতিশ রানা, রাহুল ত্রিপাঠি, দীনেশ কার্তিকদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খেলিয়েছে কলকাতা। কেউই জানতেন না দলে তাঁর আদর্শ পজিশন কোনটা। হার্শার মতে, নারাইনকে সরিয়ে গিলের সঙ্গে রানাকে ওপেনিংয়ে পাঠালে শুরুতে ডানহাতি-বাঁহাতি রসায়নও বজায় থাকে, তিনে সাকিব নামলে টপ অর্ডারও অপেক্ষাকৃত বেশি স্থিতিশীল হয়। তিনে সাকিবের উপস্থিতি চার-পাঁচ ও ছয় নম্বরে যথাক্রমে এউইন মরগান, দীনেশ কার্তিক ও আন্দ্রে রাসেলদের আরও বেশি হাত খুলে খেলতে সাহায্য করবে বলে মনে করছেন এই জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার, যা টপ থেকে শুরু করে মিডল অর্ডারকে আরও শক্তিশালী করবে।
কলকাতার ম্যাচের ভেন্যুও সাকিবকে সাহায্য করবে বলে মনে করছেন হার্শা। এবার কলকাতা নিজেদের বেশির ভাগ ম্যাচ খেলবে চেন্নাইয়ের ভি চিদাম্বরম স্টেডিয়াম, আহমেদাবাদের নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়াম, মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়ে ও বেঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে। প্রথম দুই মাঠকে স্পিন-স্বর্গ বললেও ভুল বলা হয় না। কলকাতা নিজেদের প্রথম ম্যাচগুলো চেন্নাই, আহমেদাবাদ আর মুম্বাইতেই খেলবে। ধীরগতির পিচে সাকিবের ঘূর্ণিজাদু প্রতিপক্ষের চিন্তার কারণ হতে পারে বলে হার্শার ধারণা। সব মিলিয়ে এবার সাকিবকেই কলকাতার ‘এক্স ফ্যাক্টর’ মানছেন এই অভিজ্ঞ ক্রিকেট বিশ্লেষক।
ওদিকে ইএসপিএন ক্রিকইনফোয় লেখা বিশ্লেষণে সাকিবকে নিয়ে অনেকটা ইতিবাচক কথা লিখেছেন ভারতের সাবেক ক্রিকেটার ও বর্তমানে ধারাভাষ্যকার–বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করা আকাশ চোপড়াও। তাঁর মতে, কলকাতার একাদশে মরগান, রাসেল ও কামিন্সের জায়গা নিশ্চিত হলেও, চার নম্বর বিদেশি হিসেবে কে খেলবেন, সেটা নিয়ে জোর লড়াই হবে সাকিব আর নারাইনের মধ্যে।
কারণ হিসেবে চোপড়া বলেছেন, ‘সাধারণত কলকাতার সাফল্যের পেছনে নারাইনের অনেক অবদান থাকে। কিন্তু গত মৌসুমে ওর বোলিং অ্যাকশন আবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অধিকাংশ দলই পাওয়ার-প্লেতে ব্যাটসম্যান নারাইনকে কীভাবে আটকানো যায়, সে পথও বের করে ফেলেছে। ও যদি পাওয়ার-প্লেতে বল বা ব্যাট হাতে সফল না হতে পারে, ডেথ ওভারে ওকে দিয়ে যদি বল না করানো যায়, তাহলে কলকাতার উচিত হবে ওর জায়গায় চোখ বন্ধ করে সাকিবকে খেলানো।’
শুধু তা–ই নয়, ইন্ডিয়া টুডে, আনন্দবাজারের মতো বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমও কলকাতার একাদশে সাকিবের উপস্থিতি দেখছে ভালোভাবেই। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে আন্তস্কোয়াড প্রস্তুতি ম্যাচে বেশ ভালো খেলেছেন সাকিব। ব্যাট হাতে একটা করে চার-ছক্কায় ১০ বলে ১৭ রান তুললেও সাকিব বেশি সফল ছিলেন বল হাতে। চার ওভার বল করে মাত্র ৮ রানে উইকেট নিয়েছেন দুটি। রান আউট করেছেন অস্ট্রেলিয়ান অলরাউন্ডার বেন কাটিংকে। সব মিলিয়ে কলকাতার মূল একাদশে সাকিবের অন্তর্ভুক্তি সময়ের ব্যাপার বলেই মনে করছে সংবাদমাধ্যমগুলো।
আগামীকাল বাংলাদেশ সময় রাত আটটায় সাকিবেরই সাবেক আরেক দল সানরাইজার্স হায়দরাবাদের বিপক্ষে মাঠে নামবে কলকাতা। সংশয়-সম্ভাবনা আর পূর্বানুমান-বিশ্লেষণ একদিকে, কিন্তু বাংলাদেশি অলরাউন্ডার কি আসলেই ম্যাচে কলকাতার মূল একাদশে থাকবেন?