এমবাপ্পের মতো যাদের চেয়েও পায়নি রিয়াল
যেকোনো ফুটবলারের কাছে রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনার মতো ক্লাবগুলো স্বপ্নের জায়গা। প্রায় সবারই জীবনের লক্ষ্য থাকে এমন বড় ক্লাবে খেলার। আবার এমন অনেক খেলোয়াড়ও আছেন, যাঁরা রিয়াল-বার্সাকে ছাড়াই নিজেদের ক্যারিয়ার দিব্যি গড়ে তুলেছেন।
সেই তালিকারই সর্বশেষ সংযোজন—কিলিয়ান এমবাপ্পে। এই ফরাসি ফরোয়ার্ড গতকাল ‘না’ করে দিয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদকে। জানিয়ে দিয়েছেন, পিএসজিতেই থাকবেন আরও তিন বছর। ফুটবলবিশ্বে প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে যেভাবে ঘটনা ভিন্ন দিকে বাঁক নেয়, সেদিক থেকে বিবেচনা করলে তিন বছর পর রিয়াল মাদ্রিদ এমবাপ্পেকে দলে টানার ব্যাপারে এতটা আগ্রহী হবে কি না, সে নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়।
আপাতত এটা তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, রিয়ালকে ছাড়াই নিজের ভবিষ্যৎ গুছিয়ে নিয়েছেন এমবাপ্পে।
তবে এবারই যে পছন্দের খেলোয়াড়কে চেয়েও পায়নি রিয়াল, তা কিন্তু নয়। আগেও এমন অনেক হয়েছে, যে খেলোয়াড় পছন্দ করেও কোনো না কোনো কারণে দলে টানতে পারেনি রিয়াল। কারা তাঁরা? এমন কয়েকজনের নাম একনজরে দেখে নেওয়া যাক!
নেইমার
নেইমারের প্রতি রিয়ালের ‘টান’ আজকের নয়। ২০০৬ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে রিয়ালের হয়ে ‘ট্রায়াল’ দিয়েছিলেন নেইমার। তখন তাঁর বাবা ৬০ হাজার ইউরো দাবি করায় আর রিয়ালে যাওয়া হয়নি, লাভ হয়েছিল সান্তোসের। সান্তোস ছাড়ার সময়েও নেইমারের দরজায় কড়া নেড়েছেন ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। জানা গিয়েছিল, রিয়ালের হয়ে শারীরিক পরীক্ষাও দিয়েছিলেন এই ব্রাজিলিয়ান তারকা। লাভ হয়নি। শেষমেশ টাকার খেলায় জিতে যায় বার্সেলোনা। ২০১৬ সালে নেইমার যখন বার্সেলোনা ছাড়ার চিন্তা করছিলেন, তখনো পেরেজের সঙ্গে নেইমারের বাবার বৈঠক হয়েছিল বলে শোনা যায়। তখনো রিয়ালে না গিয়ে পিএসজিতে গিয়েছিলেন নেইমার।
ডিয়েগো ম্যারাডোনা
একবার নয়, দুই-দুইবার কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে দলে আনার ব্যাপারে অনেক দূর চলে গিয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ। ১৯৮২ সালে রিয়ালের কোচ হওয়ার পর বার্সেলোনা থেকে ম্যারাডোনাকে আনার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন আলফ্রেডো ডি স্টেফানো। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি, শেষমেশ আর্থিক কারণে পিছিয়ে আসতে হয়েছিল রিয়ালকে। ম্যারাডোনার মুখপাত্র সেবার বেশ কয়েকবার রিয়ালের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন।
১৯৮৬ সালে নাপোলি থেকে রিয়ালে ম্যারাডোনাকে আনার জন্য চেষ্টা করেছিলেন তৎকালীন রিয়াল সভাপতি র্যামন মেন্দোজা। রিয়াল তারকা হোর্হে ভালদানোর সঙ্গে ম্যারাডোনা নিজেই মেন্দোজার সঙ্গে দেখা করতে চলে এসেছিলেন, নিজেই প্রস্তাব দিয়েছিলেন রিয়ালে খেলার। আর্জেন্টাইন পত্রিকা এল পাইসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মেন্দোজা জানিয়েছিলেন, ‘ও তখন নাপোলিতে ছিল, রিয়ালে আসার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিল। ও আমাকে বেশ কিছু শর্ত দেয়। ইমেজ স্বত্ব, বেতন-বোনাস মিলিয়ে অনেক কিছু চেয়ে বসে আমার কাছে। তখন সে প্রস্তাব আমার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।’
দাভিদ ভিয়া
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো আর কাকার পাশাপাশি করিম বেনজেমা নন, আসার কথা ছিল স্প্যানিশ স্ট্রাইকার দাভিদ ভিয়ার। ২০০৯ সালে ভিয়াকে দলে টানার ব্যাপারে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল রিয়াল। কিন্তু ভ্যালেন্সিয়ার নতুন মালিক রিয়ালের কাছে ভিয়াকে বিক্রি করতে চাননি। রিয়ালের ক্ষতিই লাভ হয়ে দেখা দিয়েছিল বার্সেলোনার কাছে। পরের বছর ভিয়াকে ঠিকই দলে টেনেছিল তারা। তবে ভিয়ার জায়গায় করিম বেনজেমাকে পেয়ে রিয়ালের যে খুব বেশি ক্ষতি হয়েছে, সেটাও কিন্তু বলা যাবে না!
ফ্রাঙ্ক রিবেরি
ভালো খাবারের স্বাদে ভুলে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে কেউ যে ক্লাবে থেকে যেতে পারেন, সেটা দেখিয়েছিলেন ফরাসি উইঙ্গার ফ্রাঙ্ক রিবেরি। এমবাপ্পেকে না হয় দলে রাখার জন্য আকাশছোঁয়া বেতন-বোনাস দেওয়া লাগছে পিএসজির। রিবেরিকে ধরে রাখার জন্য অত কিছু করতে হয়নি বায়ার্নকে। এক বেলা সুস্বাদু খাবারেই কাজ হয়ে গিয়েছিল। রিয়াল মাদ্রিদ ভুলে বায়ার্ন মিউনিখেই থেকে যেতে মনস্থির করেছিলেন রিবেরি। ৮ কোটি ইউরো দাম নিয়ে ধরনা দিয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ-চেলসি। জার্মান সংবাদমাধ্যম ‘বিল্ড’-এর কাছে ২০১৬ সালে তিনি এ নিয়ে বলেছিলেন, ‘তারা (রিয়াল) ও চেলসি ৮ কোটি ইউরোর প্রস্তাব দিয়েছিল। আমার এজেন্ট মাদ্রিদের সঙ্গে কথা বলেছিল। তখন ভেবেছিলাম মাদ্রিদে গেলেই ভালো থাকব।’
বাকিটা শুনুন হোয়েনেসের মুখেই, ‘২০১০ সালে রিবেরির সঙ্গে বায়ার্নের সঙ্গে প্রায় চুকেবুকে গিয়েছিল। ওর এজেন্ট তাকে রিয়াল মাদ্রিদে প্রায় বিক্রিই করে দিয়েছিল। আমরা সে সময় ওকে এবং ওর স্ত্রী ওয়াহিবাকে একদিন রাতের খাবার খেতে বাসায় দাওয়াত দিই। সুশি ওর স্ত্রীর (ওয়াহিবা) জন্য হালাল খাবার রান্না করেছিল। দারুণ এক সন্ধ্যা কাটানোর পর মাঝরাতের দিকে হঠাৎ ওয়াহিবা বলল “ফ্রাঙ্ক, আমরা মিউনিখেই থাকছি!’”
দাভিদ দা হেয়া
২০১৫-১৬ মৌসুমের শুরু থেকেই গুঞ্জন উঠছিল, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের স্প্যানিশ গোলকিপার দাভিদ দা হেয়া রিয়ালে চলে যেতে পারেন। মৌসুমের প্রথম কয়েকটি ম্যাচে যখন সুস্থ থাকার পরও দা হেয়াকে দর্শক হয়ে থাকতে হলো, সেই গুঞ্জনের পালে আরও জোর হাওয়া লাগল। ওদিকে দলবদলের সময়ও শেষ হয়ে আসছিল। পরশু ব্রিটিশ ও স্প্যানিশ গণমাধ্যম দাবি করল, দা হেয়ার জন্য ৩ কোটি ৬০ লাখ ইউরো খরচ করবে রিয়াল। উল্টো দিকে রিয়ালের কোস্টারিকান গোলকিপার কেয়লর নাভাস যাচ্ছেন ইউনাইটেডে। সব পক্ষের জন্যই মধুরেণ সমাপয়েৎ বলেই মনে করা হচ্ছিল।
কিন্তু হিসাব-নিকাশ উল্টে যেতে সময় লাগেনি। দা হেয়াকে নিবন্ধন করাতে গিয়েই হয় যত ঝামেলা। স্প্যানিশ-ব্রিটিশ প্রচারমাধ্যমে ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে তোলপাড়। দুই ক্লাবও তখন নীরব। পরে রিয়াল মাদ্রিদ এক বিবৃতিতে দাবি করে, ডি গিয়াকে না আনার দোষটা ইউনাইটেডেরই। নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে তারা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠায়নি ফ্যাক্সে।
রিয়ালের কথা অনুযায়ী, দা হেয়ার ব্যাপারে দুই ক্লাবের মধ্যে দর-কষাকষি শুরু হওয়ার পর ইউনাইটেড দাবি তোলে, দা হেয়ার বদলে অর্থের সঙ্গে তাদের নাভাসকেও চাই। রিয়াল তা মেনে নেওয়ায় ইউনাইটেডকে চুক্তির কাগজপত্র পাঠায়। কিন্তু রিয়ালের দাবি অনুযায়ী, ইউনাইটেড ফিরতি কাগজপত্র পাঠাতে প্রায় আট ঘণ্টা দেরি করে ফেলে, সেখানে নতুন আরও কিছু ছোটখাটো শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। রিয়াল তাতেও সম্মতি জানিয়ে দুই খেলোয়াড়ের সই নিয়ে কাগজপত্র পাঠায়। কিন্তু ইউনাইটেড এরপর সই করে যখন পাঠিয়েছে, দলবদলের চূড়ান্ত সময়সীমার পর দুই মিনিট পার হয়ে গেছে!এভাবেই দা হেয়াকে হারায় রিয়াল। ওদিকে রিয়ালে থেকে তিনটি চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতেন নাভাস।
আর্লিং হরলান্ড
ম্যানচেস্টার সিটিতে যাওয়ার আগে রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গেও আলোচনায় বসেছিলেন নরওয়েজিয়ান স্ট্রাইকার আর্লিং হরলান্ড। এমবাপ্পেকে দলে টানার কারণে দুজনকে একই সঙ্গে আনা যাবে না, সেটা ভেবে হরলান্ডের প্রতি রিয়ালই শেষমেশ আগ্রহ দেখায়নি।
রুড খুলিত
নেদারল্যান্ডসের এই তারকা ফুটবলারকে পাওয়ার জন্য ডাচ ক্লাব পিএসভি আইন্দহোভেনের সঙ্গে চুক্তি প্রায় হয়েই গিয়েছিল রিয়ালের। শেষ মুহূর্তে বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে এসি মিলান নিয়ে যায় এই ইউরোজয়ী খেলোয়াড়কে।
ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যান
১৯৯২ সালে কোচ লিও বেনহ্যাকার জার্মান স্ট্রাইকার ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যানকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে গিয়েছিলেন। ইন্টার মিলানের সঙ্গে রিয়ালের কথাবার্তাও প্রায় পাকা হয়ে গিয়েছিল। বেনহ্যাকারের কথামতো রিয়ালে যাওয়ার টিকিটও কেটে ফেলেছিলেন ক্লিন্সম্যান। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ভাবনায় বদল আসে রিয়ালের। সভাপতি মেন্দোজা জানিয়ে দেন, ক্লিন্সম্যানকে দলে আনা হচ্ছে না। পরের মৌসুমের শুরুতে বেনহ্যাকারকে ছাঁটাই করা হয়, দলে নতুন স্ট্রাইকার হিসেবে আনা হয় ইভান জামোরানোকে।
থিয়েরি অঁরি
তখন মোনাকো মাতাচ্ছেন অঁরি। অন্যান্য বড় ক্লাবের মতো অঁরির দিকে নজর পড়েছিল রিয়ালেরও। সভাপতি লরেঞ্জো সাঞ্জ অঁরির মুখপাত্রের সঙ্গে কথাবার্তা বলে চুক্তির বিষয় পাকা করে ফেলেছিলেন। অতি উৎসাহী হয়ে সাঞ্জ নিজেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, আগামী পাঁচ-ছয় বছরের জন্য রিয়ালে খেলবে অঁরি। কিন্তু অঁরির মুখপাত্র মিশেল বাসিলেভিশের সঙ্গে রিয়ালের এমন চুক্তি মেনে নেয়নি মোনাকো, ফুটবল মুখপাত্রদের সংগঠনও বাসিলেভিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। যে কারণে অঁরি শেষমেশ মোনাকোর সঙ্গে চুক্তি নবায়ন করে থেকে যান।
স্টিভেন জেরার্ড
ম্যারাডোনার মতো লিভারপুলের এই কিংবদন্তিকেও দুবার চেয়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ। একবার ২০০৫ সালে, একবার ২০১০। জেরার্ডের প্রতি জোসে মরিনিওর অনুরাগের কথা আজকের নয়। মরিনিওই ২০১০ সালে রিয়ালের মাঝমাঠে চেয়েছিলেন জেরার্ডের উপস্থিতি। কিন্তু লিভারপুলের দাবিদাওয়ার কাছে হার মানে রিয়াল। তিরিশ পেরোনো এক মিডফিল্ডারের জন্য ৩ কোটি ৮০ লাখ পাউন্ডের পাশাপাশি আলভারো আরবেলোয়া, রুবেন দে লা রেড ও হাভি গার্সিয়ার মতো তিনজন খেলোয়াড়কে ছেড়ে দিতে রাজি হয়নি রিয়াল। সতীর্থ জেমি ক্যারাঘারের ‘দ্য গ্রেটেস্ট গেম’ পডকাস্টে নিজেই এই কথা স্বীকার করেন জেরার্ড।
প্যাট্রিক ভিয়েরা
২০০৪ সালে আর্সেনালকে অপরাজিত লিগ চ্যাম্পিয়ন করার পেছনে অধিনায়ক প্যাট্রিক ভিয়েরার অবদান ছিল অনেক বেশি। সেটা দেখেই কি না, ফরাসি এই মিডফিল্ডারকে দলে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন তৎকালীন রিয়াল কোচ আন্তোনিও কামাচো। কিন্তু স্বদেশি সতীর্থ ক্লদ ম্যাকেলেলে রিয়ালে নিজের যোগ্য সম্মান পাননি দেখে নিজেও রিয়ালে দাম পান কি না, সে ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন এই মিডফিল্ডার। যে কারণে একদম শেষ মুহূর্তে রিয়ালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করেন ভিয়েরা।
ফ্রান্সেসকো টট্টি
এএস রোমার এই কিংবদন্তি ফরোয়ার্ডকে নেওয়ার জন্য কম চেষ্টা করেনি রিয়াল। টট্টি নিজেই স্বীকার করেছেন, রিয়ালে যাওয়ার ব্যাপারে ৮০ ভাগ নিশ্চিত ছিলেন তিনি। কিন্তু ওই যে, ২০ ভাগ সময় মনটা খুঁতখুঁত করছিল যে! শেষমেশ রোমার প্রতি তাঁর ভালোবাসা, সমর্থকদের আবেগ, পরিবার—সবকিছুর কারণে রোমাতে থেকে যান এই ইতালিয়ান ফরোয়ার্ড।
হোয়াকিন
রিয়াল বেতিসের এই উইঙ্গারকে কেনার জন্য ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছেন ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। লাভ হয়নি। বেতিসের সভাপতি কোনোভাবেই রিয়ালের কাছে হোয়াকিনকে ছাড়তে রাজি হননি।