২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

এবার ইরান–যুক্তরাষ্ট্র ‘যুদ্ধে’ কী অপেক্ষায়?

১৯৯৮ বিশ্বকাপে যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি হয়েছিল ইরানছবি: ফিফা

বলা হয়, বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে সেটাই রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে উত্তপ্ত ম্যাচ।
কোন ম্যাচ, তা বলার আগে একটু গৌরচন্দ্রিকা দিয়ে রাখা ভালো।

প্রায় ৪০ বছরের রাজনৈতিক বৈরী সম্পর্ক ও পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে বিরোধ একপাশে সরিয়ে কাতার বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি হবে ইরান। কাল বিশ্বকাপের দলগুলোর ড্র–তে একই গ্রুপে (বি) পড়েছে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র।

চাই কি, একই গ্রুপে আছে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র ইংল্যান্ডও। এই গ্রুপে ইউরোপিয়ান প্লে–অফ থেকে উঠে আসবে আরও একটি দল।

কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় বি গ্রুপে সবার নজর থাকবে যুক্তরাষ্ট্র–ইরান ম্যাচে। ডেট লাইন ২৯ নভেম্বর—দোহার আল থুমামা স্টেডিয়ামে মুখোমুখি হবে দুই দল। রাজনৈতিকভাবে এই দুটি দেশের মধ্যে বৈরী সম্পর্কের বরফ এখনো গলেনি।

কে জানে, দোহার ম্যাচের আগেই হয়তো নতুন করে আবার লেগে যেতে পারে! কূটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হওয়ায় এর আগে সামরিক বাহিনী নিয়েও শক্তির লড়াই করেছে দুই দেশ।

১৯৯৮ বিশ্বকাপের সে ম্যাচে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থকেরা আনন্দ ভাগ করে নেন
ছবি: ফিফা

২০১৫ সালে ইরান ও বিশ্বের রাজনৈতিক পরাশক্তিদের মধ্যে যে পারমাণবিক চুক্তি হয়েছিল, তা পুনঃস্থাপনের চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন। এই চুক্তি পুনরায় কার্যকর হলে ইরানের পারমাণবিক পরীক্ষার ব্যাপ্তি কমে আসবে, হস্তক্ষেপ করার সুযোগ থাকবে পশ্চিমা বিশ্বের।

কিছু প্রতিবন্ধকতারও সৃষ্টি হবে। বিনিময়ে ইরানের ওপর থেকে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, যেসব নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটির অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে ইরাক ও সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর ওপর হামলার দায়ে ইরানকে অভিযুক্ত করেছে ওয়াশিংটন। ২০২০ সালে তো প্রায় যুদ্ধ লেগেই গিয়েছিল দুটি দেশের মধ্যে। ইরানের এক উচ্চপদস্থ জেনারেলকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র।

আরও পড়ুন

এর জবাবে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর ওপর মিসাইল হামলা চালায় ইরান।
এমন বৈরী সম্পর্কের পরও কিন্তু রসিকতা হচ্ছে। বিশ্বকাপের ড্রয়ে দুই দল এক গ্রুপে পড়ার পর মজা করছে ওয়াশিংটনের কূটনৈতিকপাড়া।

ক্রাইসিস গ্রুপ ইরানের প্রকল্প পরিচালক আলী ভায়েজ টুইট করেন, ইরানের বিপক্ষে ম্যাচ সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের একটি দলকে সম্ভাব্য সংঘর্ষ এড়ানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ম্যাচ ড্র হলে মীমাংসা এবং জার্সি বিনিময়ে নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন হবে কি না, এসব ঠিক করতে কাজ করছে দলটি।

মাঠে ফুল নিয়ে ঢুকেছিল ইরানের খেলোয়াড়েরা
ছবি: টুইটার

ওয়াশিংটনে ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসিসের (এফডিডি) মূল চিন্তক বেহনাম বেন তালেবলু মনে করেন, এই ম্যাচ সামনে রেখে বাইডেন প্রশাসনের উচিত ইরানের মেয়েদের পাশে দাঁড়ানো। গত মাসে মাশহাদ শহরে ইরানের নারীদের ফুটবল স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ফিফা অবশ্য ইরানকে বলেছে, মেয়েদের স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে দেওয়ার সময়টা এখনই।

দুই দলের কোচরা অবশ্য এসব নিয়ে ভাবছেন না। রাজনীতিকে এক পাশে সরিয়ে তাঁরা এটাকে স্রেফ একটা ম্যাচ হিসেবেই দেখছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কোচ গ্রেগ বেরহল্টার বলেছেন, দিন শেষে এটা স্রেফ একটা ফুটবল ম্যাচ, যেখানে ন্যায়সঙ্গত শক্ত লড়াইয়ের মাধ্যমে বন্ধুত্ব হতে পারে।

ইরান গত বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেলেও যুক্তরাষ্ট্র পায়নি। ইরান অবশ্য কখনো বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব টপকে যেতে পারেনি।

ইরানের কোচ দ্রাগান স্কোচিচও রাজনৈতিক বৈরী সম্পর্ককে এক পাশে সরিয়ে রাখছেন, ‘ফুটবল ছাড়া আমি আর অন্য কিছু নিয়ে ভাবছি না। আমি বিশ্বাস করি, ফুটবল ভালো সম্পর্ক তৈরিতে সাহায্য করে। লোকে খেলাধুলায় এটাই দেখতে চায়।’

আরও পড়ুন

বিশ্বকাপে এর আগে একবারই ইরানের মুখোমুখি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৯৮ ফ্রান্স বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে ইরানের কাছে ২–১ গোলে হেরেছিল যুক্তরাষ্ট্র—এ ম্যাচকেই বলা হয় বিশ্বকাপ ফুটবলের ইতিহাসে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে উত্তপ্ত ম্যাচ। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘গার্ডিয়ান’ সেই ম্যাচ নিয়ে ২০১৮ বিশ্বকাপের আগে এক প্রতিবেদনে শিরোনাম করেছিল ‘গ্রেট শয়তান ১–২ ইরান’।

দুটি দেশের রাজনৈতিক বৈরী সম্পর্ক বোঝাতে শিরোনামে যুক্তরাষ্ট্রের জায়গায় ওই নাম ব্যবহার করা হয়। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে ইরানের কোচ জালাল তালেবির স্মৃতিচারণায় করা হয়েছিল সেই প্রতিবেদন।

যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান কোচ বেরহল্টার সেই ম্যাচের স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘মনে আছে। আমি একটা ডাচ টিভিতে ধারাভাষ্য দিয়েছিলাম। সেবারই প্রথম ওদের মুখোমুখি হই। তখন রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত সম্পর্কের মধ্যে ম্যাচটি হয়েছিল।’

১৯৯৮ বিশ্বকাপে এফ গ্রুপে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গী হয় ইরান। দুটি দলের মধ্যে ম্যাচ নিয়ে তখন মার্কিন ফুটবল ফেডারেশনের প্রধান বলেছিলেন, ‘মাদার অব অল ম্যাচ’। ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট শাহ প্রশাসন ইরানের শাসনক্ষমতা হারালে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হতে শুরু করে।

আরও পড়ুন

লিঁওতে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচে ফিফা মিডিয়া কর্মকর্তা ছিলেন ইরানি বংশোদ্ভূত মেহরদাদ মাসৌদি। ‘ফোর ফোর টু’–তে তাঁর স্মৃতিচারণা—প্রথম সমস্যা ছিল, ইরান বি দল এবং যুক্তরাষ্ট্র এ দল। ফিফার নিয়ম অনুযায়ী ম্যাচপূর্ব হাত মেলানোর আনুষ্ঠানিকতায় বি দল এগিয়ে গিয়ে এ দলের সঙ্গে হাত মেলাবে। কিন্তু ইরানের প্রধান নেতা খামেনি তাঁর খেলোয়াড়দের স্পষ্ট বলে দেন, আমেরিকানদের কাছে যাওয়া যাবে না।

ম্যাচ শেষে হাতও মেলান দুই দলের খেলোয়াড়েরা
ছবি: টু্ইটার

মেহরদাদ মাসৌদি পরে বলেকয়ে যুক্তরাষ্ট্রের খেলোয়াড়দের রাজি করান। ব্রাড ফ্রিডেল–ট্যাব রামোসরাই এগিয়ে গিয়ে হাত মেলান ইরানের খেলোয়াড়দের সঙ্গে। তবে এটাই প্রধান সমস্যা ছিল না। একটি সন্ত্রাসী সংগঠন ম্যাচের ৭ হাজার টিকিট কিনে গ্যালারিতে প্রতিবাদ কর্মসূচির পরিকল্পনা করেছিল।

ইরাকের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের মদদপুষ্ট মুজাহেদিন খালেক নামের সেই সংগঠন বহির্বিশ্বে ইরানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে চেয়েছিল। মাসৌদি জানান, ম্যাচে টিভি ক্যামেরাম্যান ও ফটোসাংবাদিকদের বলে দেওয়া হয়েছিল, বিতর্কিত ব্যানারগুলো যেন এড়িয়ে যাওয়া হয়।

আরও পড়ুন

গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে আরও তথ্য পেয়েছিল ফিফা। সেই সন্ত্রাসবাদী সংগঠন মাঠেও ঢোকার পরিকল্পনা করেছিল। প্রতিহত করতে এস্তাদে গারল্যান্ড স্টেডিয়ামে মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত দাঙ্গা পুলিশ। ইরান ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট শান্তির প্রতীক সাদা গোলাপ নিয়ে মাঠে ঢুকতে বলেছিলেন তাঁর দলের খেলোয়াড়দের।

ম্যাচ শুরুর আগে দুই দল একসঙ্গে ছবিও তোলে। ম্যাচটি ইরানের কাছে রাজনৈতিক কারণের বাইরেও ঐতিহাসিক—বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে সেটাই প্রথম জয় ইরানের। সেটাও ‘শত্রু’ যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে হওয়ায় ইরানের সমর্থকদের উৎসবটা ছিল বিশ্বকাপ জয়ের মতোই।

আরও পড়ুন

মাসৌদির স্মৃতিচারণা—‘বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাওয়ার পর উৎসব করেছিল গোটা ইরান। তেহরানের রাস্তায় লোকজন নেচেছেন, মদপান করেছেন খোলা রাস্তায়, নারীরাও স্কার্ফ খুলে ফেলেন। নিরাপত্তাবাহিনী কিছুই বলেনি। কারণ, তারাও আনন্দ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে হারানোর পর ঠিক এই আনন্দই ফিরে এসেছিল ইরানে।’
ইরানের কাছে হারে সেবার গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিশ্চিত হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের।

তবে হারলেও আসল কথাটা বলেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্ডার জেফ আগোস, ‘রাজনীতিবিদেরা গত ২০ বছরে যা যা করতে পারেননি, আমরা ৯০ মিনিটে তা করে দেখিয়েছি।’ সেটা কী? খেলা শুরুর আগে যুক্তরাষ্ট্রের খেলোয়াড়দের সাদা গোলাপ উপহার দিয়েছিলেন ইরানের খেলোয়াড়েরা। গ্যালারিতেও হাত মিলিয়েছেন দুই দলের সমর্থকেরা।

এ তো সামান্য একটা গোলাকার বলের কাছে রাজনীতিবিদদের হার! এবার কী নিয়ে আসবে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান ম্যাচ?