এপ্রিলের গরমেও তাঁর গায়ে জ্যাকেট কেন
‘বিশ্বাসে মেলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’—ধর্ম বা বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বহুল জনপ্রিয় এই আপ্তবাক্যের যৌক্তিকতা কতটুকু? সে তর্কে গেলেও বহুদূর যেতে হবে। সেটা থাক, আপাতত চোখ ফেরানো যাক শফিকুল ইসলামের (মানিক) দিকে।
‘বিশ্বাসে মেলায় বস্তু’ তত্ত্বে আস্থা রেখে দুই যুগ ধরে ফুটবল কোচিং করাচ্ছেন শফিকুল। সাফল্যের বিচারে দেশের অন্যতম সেরা ফুটবল কোচও বলা হয় জাতীয় দলের সাবেক এই ফুটবলারকে।
প্রিমিয়ার লিগের আটটি ক্লাবেই বিদেশি কোচ। বিদেশি মোহ কাটিয়ে সর্বশেষ দুই মৌসুম শফিকুলে আস্থা রেখেছে শেখ জামাল ধানমন্ডি। প্রতিদানটাও দিচ্ছেন দারুণভাবে। চলতি প্রিমিয়ার লিগে ১৪টি ম্যাচ খেলে এখনো অপরাজেয় শফিকুলের শেখ জামাল। এর আগে গত বছরে বাতিল হওয়া লিগেও নিজেদের শেষে চার ম্যাচে জিতেছিলেন, সেই চার ম্যাচও এর সঙ্গে হিসাবে ধরলে টানা অপরাজিত থাকার সংখ্যাটা দাঁড়ায় ১৮। অথচ দলটিতে জাতীয় দলের খেলোয়াড় একজনও নেই।
শেখ জামালের এই সাফল্যের পেছনে কোচিং ক্যারিশমা ও খেলোয়াড়দের দলগত দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কথাই সবার আগে আসবে। তবে সামনে চলে আসছে শফিকুল ইসলামের ‘বিশ্বাসে মেলায় বস্তু’ দর্শনও।
বৈশাখের দাবদাহ চলছে। গায়ে জামা রাখাই কষ্ট। এই গরমে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে কারও গায়ে বা হাতে শীতের জ্যাকেট দেখলে অবাক না হয়ে পারা যায় না! সেই কাজই ষোলো আনা ভক্তি নিয়ে করে চলেছেন জাতীয় দলের সাবেক কোচ।
জানুয়ারির শীতে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে চট্টগ্রাম আবাহনীকে ২-১ গোলে হারিয়ে প্রিমিয়ার লিগ শুরু করেছিল শেখ জামাল। স্বাভাবিকভাবে সেদিন শীতের পোশাক গায়ে চাপিয়ে মাঠে এসেছিলেন শফিকুল। গত বুধবার প্রিমিয়ার লিগের দ্বিতীয় পর্বে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রকে ২-১ গোলে হারিয়ে টানা ১৪ ম্যাচ অপরাজিত থাকার কীর্তি যখন গড়ছেন, তখন এপ্রিলের গরমে টেকা দায়। কিন্তু আবহাওয়া বদলালেও বদলায়নি শফিকুলের পোশাক।
এপ্রিলের গরমের কাছে হার না মেনে খুশিমনে গায়ে চাপিয়ে নিচ্ছেন শীতের জ্যাকেটটি। তাঁর বিশ্বাস, সাফল্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পোশাকসহ আনুষঙ্গিক যাবতীয় কার্যক্রম।
লিগের প্রথম ম্যাচে যে কেডস, ট্রাউজার, টি–শার্ট, জ্যাকেট ও ক্যাপ পরেছিলেন শফিকুল, ১৪ ম্যাচেই গায়ে সে পোশাকই ছিল।
কেন? কারণটা শফিকুল জানালেন এভাবে, ‘লিগের প্রথম ম্যাচে যে পোশাক পরেছিলাম, রেজাল্ট যত দিন ভালো হবে, সেটিই থাকবে। তাই গরমের মধ্যেও জ্যাকেট। সেটা গায়ে না রাখতে পারলেও ডাগআউটে আমার সিটে থাকবে। সবারই একটা সুপারস্টিশন (কুসংস্কার) থাকে। নিজের মধ্যে একটা বিশ্বাস থাকে। এই বিশ্বাস আমার আল্লাহর প্রতিই। আর পোশাকের প্রতি আমার আস্থা। ফুটবলে ভাগ্য বলতে একটা কথা আছে। এটি মাঠেও হয়, মাঠের বাইরেও হয়। যখন দেখি এই ভাগ্য কোনো কিছুর মাধ্যমে আসে, তখন সেটির ওপর আস্থা রাখি।’
গায়ের পোশাক ছাড়াও জয়ের ম্যাচের কলম, হাতঘড়িসহ আস্থা রাখা হয় যাবতীয় ব্যবহারিক জিনিসের ওপর। বাদ যায় না যাতায়াতের পথও। যে রাস্তা দিয়ে মাঠে পৌঁছে ম্যাচ জেতা গেছে, পরের ম্যাচগুলোতে অনুসরণ করা হয় সে রাস্তা। মানিক বলছিলেন, ‘আমার সব কাজই এগুলোর অংশ। বাঁশি, স্টপওয়াচ, কলম—সবকিছুই। যানবাহন চলাচলের রাস্তাও। রেজাল্ট ভালো হলে ভাবি, এ রাস্তাই আমার জন্য ভালো। খারাপ হলে ধরে নিই, সেটি আমার জন্য মানানসই হয়নি।’
গত বছরের ফেব্রুয়ারির পর থেকে লিগে ১৮ ম্যাচে অপরাজিত শেখ জামাল। ১৩ জয়, ৫ ড্র। এবারের লিগে ১৪ ম্যাচের ৯টিতেই জিতেছে, ড্র বাকি ৫টি। এই ১৪ ম্যাচে গোল করেছে ৩৬টি, খেয়েছে ঠিক অর্ধেক—১৮টি।
কোচিং ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই এই সংস্কারগুলো মানেন শফিকুল। এর আগে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রের কোচ থাকাকালে নিটল টাটা লিগে অপরাজিত থেকে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল তাঁর দল। সেবার এক শার্ট-প্যান্ট পরেই পুরো টুর্নামেন্ট শেষ করেছিলেন শফিকুল, ‘একবার নিটল টাটা লিগে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। খুব সম্ভবত ২০০৩ সালে। সেবারও প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একই প্যান্ট–শার্ট পরেছি।’
দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে পরিবর্তন এলে ম্যাচের ফলাফলেও পরিবর্তন আসে বলে মনে করেন তিনি, ‘যখন মা বেঁচে ছিলেন, তাঁকে সালাম করে মাঠে যেতাম। কোনো সময় মা বাথরুমে গেল বা আমি তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে গিয়েছি...এ ছাড়া অনেক সময় আমিও হয়তো ভুল করে বসলাম, দেখা গেল কলম নিইনি বা চশমা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, পরে দেখা গেল সেদিন ম্যাচের ফলও খারাপ হয়েছে। অনেক ম্যাচে আমি এ রকমটা দেখেছি। খারাপ কিছু হলে আমি সেদিন লক্ষণ রেখে যাই। এই যে একটা বিশ্বাস ও আস্থা, এটা অনেক সময় কাজে দেয়।’
শফিকুলের অধীনে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রে দীর্ঘদিন খেলেছেন জাতীয় দলের সাবেক ডিফেন্ডার হাসান আল মামুন। বর্তমানে শফিকুলের অধীনেই শেখ জামালের সহকারী কোচের দায়িত্ব পালন করছেন ২০০৩ সাফজয়ী তারকা।
মুক্তিযোদ্ধায় খেলার সময়কার একটা অভিজ্ঞার কথা শোনালেন মামুন, ‘মাঠে যাওয়ার সময় বাসের মধ্যে একটা পিরিচ ভেঙে যায়। সেদিন তো ক্লাবের স্টাফকে খুব রাগারাগি। কিন্তু সে ম্যাচ আমরা জিতে যাওয়ায় পরের ম্যাচে সে একই জায়গা দিয়ে বাস যাওয়ার সময় ইচ্ছে করে পিরিচ ভাঙতে বলা হয়েছিল। এটা তাঁর বিশ্বাস। এটার প্রতি আমাদের সবারই সম্মান আছে।’ সেই বিশ্বাসের ফল যদি হয় এভাবে লিগে অপরাজিত থাকা, তাহলে তো ভালোই।
শেখ জামালের সাফল্যটা কেমন, সেটির বর্ণনাও একটু শুনে নিন। গত বছরের ফেব্রুয়ারির পর থেকে লিগে অপরাজিত শেখ জামাল। এ পথে ১৮ ম্যাচে ১৩ জয়, ৫ ড্র। এবারের লিগে ১৪ ম্যাচের ৯ টিতেই জিতেছে, ড্র বাকি ৫টি। হারিয়েছে মোহামেডান-সাইফ স্পোর্টিংকে, ড্র করেছে বসুন্ধরা-আবাহনীর সঙ্গে।
শুধু বসুন্ধরার সঙ্গে গোলশূন্য ড্র বাদ দিলে কোনো ম্যাচেই গোল না করে থাকেনি শফিকুলের দল। সব মিলিয়ে এই ১৪ ম্যাচে গোল করেছে ৩৬টি, খেয়েছে ঠিক অর্ধেক—১৮টি।
এ মুহূর্তে ১৪ ম্যাচে ৩২ পয়েন্ট নিয়ে লিগের পয়েন্ট তালিকার তিন নম্বরে শেখ জামাল। সমান ৩২ পয়েন্ট নিয়েই গোল ব্যবধানে এগিয়ে দুই নম্বরে আবাহনী, তবে তারা ম্যাচ খেলেছে একটি বেশি। শীর্ষে থাকা বসুন্ধরার পয়েন্ট ১৫ ম্যাচে ৪৩।
এবারের লিগে যে পাঁচ ম্যাচ ড্র করেছে শেখ জামাল, তার মধ্যে চারটিই এসেছে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে টানা চার ম্যাচে (আবাহনীর সঙ্গে ২-২, বসুন্ধরার সঙ্গে ০-০, এরপর উত্তর বারিধারা ও বাংলাদেশ পুলিশের সঙ্গে টানা দুটি ৩-৩ ড্র), সেগুলোর এক-দুটিতে একটু এদিক-ওদিক হলেই বসুন্ধরার সঙ্গে হয়তো এখনো শিরোপার লড়াইয়ে থাকত শফিকুলের দল।
তা হয়নি, তবে যা হয়েছে তাই–বা কম কী!