এতদিন পর জার্মানরা বুঝল ওজিলের সঙ্গে অন্যায় হয়েছে
শুধু তুরস্কের বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ানের সঙ্গে একটা ছবি। সেটি থেকেই কত বিতর্কই না হয়ে গেল! হলো কত শত সমালোচনা। বর্ণবাদী অভিযোগ উঠেছে। মেসুত ওজিল সেটা নিতে পারেননি। অপমানিত বোধ করেছেন, অভিমানে সরে গেছেন জার্মানি জাতীয় দল থেকে।
ঘটনাটার দুবছর হয়ে গেছে। এত দিন পর এসে জার্মান ফুটবল ফেডারেশনের (ডিএফবি) মনে হলো, ওজিলের সঙ্গে তখন অন্যায় করা হয়েছে। ভুলটা স্বীকার করে নিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন ফেডারেশনের মহাসচিব ফ্রাইডরিখ কার্টিস। সেসময় ওজিলের সঙ্গে অন্তত একবার দেখা করে কথা বলা উচিত ছিল বলে মনে হয়েছে কার্টিসের।
ঘটনাটা ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের আগে-পরে মিলিয়ে। বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে লন্ডনে এরদোয়ানের সঙ্গে ছবি তোলেন ওজিল ও জার্মানি জাতীয় দলে তাঁর সতীর্থ ইলকায় গুন্দোয়ান। ওজিল লন্ডনের ক্লাব আর্সেনালের খেলোয়াড়, গুন্দোয়ান ম্যানচেস্টার সিটির। জার্মানির জার্সিতে খেললেও দুজনেই তুরস্কের বংশোদ্ভূত। লন্ডনে আসা সেই তুরস্কেরই প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ছবি তোলা ছাড়া দুজনের আর কোনো উদ্দেশ্য হয়তো ছিল না। কিন্তু এরদোয়ান বিশ্ব রাজনীতিতে বিতর্কিত এক চরিত্র। তাঁর সঙ্গে ছবি তোলা স্বাভাবিকভাবেই ভালোভাবে নেননি জার্মানির অনেকে। ওজিল-গুন্দোয়ানের সঙ্গে ছবি সেবার নিজের নির্বাচনী প্রচারণায় কাজে লাগিয়ে ভোট অর্জনের চেষ্টা করেছেন এরদোয়ান, অভিযোগ এমনই।
গুন্দোয়ান সেই ছবি নিয়ে এত বিতর্ক দেখে ক্ষমা চেয়েছেন, পরিষ্কার করে জানিয়েছেন ছবিটির পেছনে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু ওজিল সব বিতর্ক থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখে চুপ হয়ে ছিলেন। সেটিই হয়তো ওজিলকে ঘিরে সংবাদমাধ্যমে-সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সমালোচনা বাড়িয়ে দেয়।
বিশ্বকাপের আগে অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে জার্মানির সমর্থকেরাই দুয়ো দেন ওজিলকে। বিশ্বকাপজুড়ে ওজিলের জাতীয় সংগীতের সময় ঠোঁট না নাড়ানো ছিল জার্মানিতে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে। বিশ্বকাপে সুইডেনের বিপক্ষে ম্যাচে তাঁকে একাদশে রাখেননি জার্মানি কোচ ইওয়াখিম লুভ, সেই ম্যাচে দলের এগারোজনই যে জাতীয় সংগীত গাইছেন সেটিও জার্মান ধারাভাষ্যকাররা বারবার বলছিলেন।
ওজিলের সমালোচনা আরও বেড়ে গেল বিশ্বকাপে জার্মানি হতশ্রী পারফরম্যান্সের পর। ২০১৪ বিশ্বকাপজয়ী জার্মানি সেবার গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয়। বিশ্বকাপের পর পুরো দলেরই কমবেশি সমালোচনা হয়েছে, কিন্তু বোর্ডে বা দলের কোচিং প্যানেলের কারও চাকরি যায়নি। মূল ‘বলির পাঁঠা’ বানানো হয় ওজিলকে। এত বছর জার্মানি দলের হয়ে খেলেছেন ওজিল, ২০১০ বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে খেলা ও ২০১৪ বিশ্বকাপ জেতা দলেও ছিলেন। অথচ রাশিয়া বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পর রব ওঠে, ওজিল এখনো পুরোপুরি জার্মানির হতে পারেননি, এখনো তুরস্কেরই রয়ে গেছেন। জার্মানির এক রাজনীতিবিদ ওজিলের তুরস্কের শেকড় টেনে বর্ণবাদী গালিও দিয়েছিলেন।
বিশ্বকাপ থেকে ফেরার পরই ডিএফবি ব্যবস্থাপক অলিভার বিয়েরহফের বিশ্বকাপের পর মনে হলো, এত বিতর্কের পর ওজিলকে বিশ্বকাপে নেওয়াই ঠিক হয়নি, ওজিলের বিতর্কের কারণে বিশ্বকাপে দলের মনঃসংযোগ ঠিক ছিল না। ডিএফবি সভাপতি রাইনহার্ড গ্রিন্ডেল ঘোষণা করেন, ওজিল কেন বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে এরদোয়ানের সঙ্গে ছবি তুললেন, জনসমক্ষে বিবৃতি দিয়ে সেটির ব্যাখ্যা দিতে হবে।
কদিন পর বিবৃতি দিলেন বটে ওজিল। তিন ভাগের সেই লম্বা বিবৃতিতে সব ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তবে বোমাও ফাটিয়েছেন। পাল্টা জবাব দিয়েছেন গ্রিন্ডেলসহ অনেককে। পাশাপাশি ঘোষণা করে দেন, এই বর্ণবাদী আচরণ আর অপমান সয়ে জার্মানির জার্সিতে আর খেলবেন না। এরদোয়ানের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ একটা দাতব্য অনুষ্ঠানে ছিল জানিয়ে নিশ্চিত করেছেন, সেখানে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল না। ‘জার্মান জার্সিটা আমি এত গর্ব আর রোমাঞ্চ নিয়ে পরতাম। কিন্তু এখন আর সেই অনুভূতি হয় না। যখন ডিএফবি-র উঁচু পদে থাকা কর্মকর্তারা আমার সঙ্গে এমন আচরণ করেন, আমার তুর্কি শেকড়কে অসম্মান করেন, ব্যক্তিস্বার্থে আমাকে ঘিরে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা ছড়ান...বলতে হয়, যথেষ্ট হয়েছে! এসবের জন্য আমি ফুটবল খেলি না। সব দেখে চুপচাপ কিছু না করে বসেও থাকব না আমি। বর্ণবাদ কখনোই মেনে নেওয়া যায় না’—অবসরের ঘোষণা জানানো বিবৃতিতে লেখেন ওজিল।
সেই ঘটনার প্রায় দুবছর পর এসে ডিএফবির মনে হচ্ছে, জার্মানি ভুল করেছে। ওজিলের সঙ্গে অন্যায় হয়েছে। বার্লিনে ডয়েচলান্ড স্টিফটাং ইন্টিগ্রেশন ফাউন্ডেশনে জার্মানির ফুটবল নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির ফ্রাইডরিখ কার্টিস ভুল স্বীকার করে নিয়ে বলেছেন, ‘ওজিলের ঘটনায় চারপাশে যা হয়েছে, সেসব সামলাতে ডিএফবি কিছু ভুল করেছে। আরও অনেক বিতর্কে আগুন লাগানোর কাজটা করেছে ওই ছবিটা। ওই সময়ে এত বর্ণবাদী অভিযোগের মধ্যে একটা বার খেলোয়াড়ের (ওজিল) সঙ্গে দেখা করা হয়নি আমাদের।’
জার্মানি জাতীয় দলে এখন অভিবাসী অনেক খেলোয়াড় দেখা গেলেও জার্মান ফেডারেশনে এই বৈচিত্র্যের রেশ নেই। জার্মানিতে সেদিকে তাকিয়ে কার্টিসের উপলব্ধি, ‘অঙ্গীভূতকরণ এত শুকনো একটা শব্দ! এখানে মূল ব্যাপারটা হচ্ছে একে অন্যকে সম্মানের চোখে দেখা।’