এতটাও ঠুনকো হতে পারে জীবন!
জীবন ঠুনকো। নিশ্বাসের বিশ্বাস নেই। এক মুহূর্ত পরও যে সুন্দর পৃথিবীকে দু চোখ ভরে দেখার সুযোগ থাকবে, তা নিশ্চয়তা দিয়ে কে দিতে পারে! কিন্তু এতটাও ঠুনকো কি হতে পারে জীবন, যতটা মোহামেদ আহমেদ আতাউয়ির ছিল?
পৃথিবীতে জন্ম নেওয়া সব প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ নিতে হয়, তাই বলে এমন মৃত্যু হয়তো কেউই চান না। রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়েছিলেন আতাউয়ি, হঠাৎ একটা গুলি এসে লাগল তাঁর মাথায়। এক মাসের মতো পাঞ্জা লড়েছেন যমদূতের সঙ্গে। কিন্তু গতকাল হার মেনে নিতে হলো তাঁকে। জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি রেখাটায় পথ চলতে চলতে অবশেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন আতাউয়ি। অথচ বয়স কতই বা হয়েছিল তাঁর? সামনের মাসে ৩৩-এ পা দেওয়ার কথা ছিল!
আতাউয়ি ফুটবলার, খেলতেন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে। ২০১১ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে লেবানন জাতীয় দলের জার্সিতে তিনটা ম্যাচও খেলেছেন। ক্রীড়াজগতে তাই শোকের ছায়া ফেলেছে তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যু। কিন্তু খেলোয়াড় হওয়া-না হওয়ায় কী যায়-আসে? এমন মৃত্যু যে অনেক প্রশ্ন তুলে রেখে যায়।
প্রশ্নগুলো ওই অঞ্চলের দেশগুলোর সংস্কৃতি নিয়ে। আতাউয়ির মতো এমন বেঘোরে মৃত্যু হয়তো লেবানন-আফগানিস্তানের মতো দেশগুলোতে বিরল নয়। সেখানে সংস্কৃতিটাই এমন যে, রাস্তায় চলার পথে বেমক্কা গুলি এসে মাথায়-হাতে-পায়ে লাগাটা বিচিত্র কিছু নয়। কারও জন্মদিন? ফাঁকা বাতাসে গুলি ছোড়া হচ্ছে। বিয়ে? সেখানেও বাতাসে গুলি! রাজনৈতিক নেতা বক্তৃতা দিতে উঠেছেন বা দিয়ে নামছেন? বাতাসে গুলি! এমনকি কারও মৃত্যুর পরও তাঁকে সম্মান জানাতে গুলি ছোড়া হচ্ছে বাতাসে। কারও গায়ে লাগছে কি না, সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে কে!
আতাউয়ির বেলায়ও ঘটনাটা এমনি। গত ২১ আগস্টের ঘটনা। বাড়ির পাশের রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়েছিলেন, পাশের এলাকায় মৃত্যুর ‘উৎসব’ পালন হচ্ছিল গুলি ছুড়ে। গত ৪ আগস্ট বৈরুতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে প্রাণ হারানো একজনের শেষকৃত্য চলছিল। মৃত্যুর শোক না বলে উৎসব বলার কারণ? ওই যে, বাতাসে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়া। ধারণা করা হচ্ছে, তার একটি এসে লাগে আতাউয়ির মাথায়। যদিও তদন্তে সরাসরি ওই অনুষ্ঠান থেকে আসা গুলিই আতাউয়ির মাথায় লেগেছে বলে এখনো প্রমাণ হয়নি। হাসপাতালে নিবিড় পরিচর্যায় ছিলেন। মাসখানেকের যন্ত্রণার শেষটা হলো তাঁর চিরবিদায়ে।
আতাউয়ি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকেই লেবাননে এভাবে খোলা বাতাসে ফাঁকা গুলি ছোড়ায় নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি ওঠে সরকারের কাছে। লেবাননের প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন কাল আতাউয়ির মৃত্যুর খবরের পর টুইট করেছেন, ‘লেবাননে অনেক তরুণ মারা যাচ্ছে শুধু এই কারণে যে, অনেকেই জানে না তাদের দায়িত্বজ্ঞানহীন কাণ্ড কী বিপদ ডেকে আনে! জাতীয় দলের খেলোয়াড় মোহামেদ আতাউয়িকেও এভাবে মারা যাওয়া একজন হতে হলো, এটা দুঃখজনক।’ আতাউয়ির মৃত্যুর পেছনে এলোপাতাড়ি গুলি যারা ছুড়েছিলেন, তাদের শাস্তি দেওয়া হবে বলেও ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আউন।
আতাউয়ির পরিবারও বিচার চাইছে। যদিও এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। এই বিতর্ক আর বিচার প্রার্থনার ও বিচারের প্রতিশ্রুতির মধ্যে আতাউয়ির মর্মান্তিক মৃত্যুর শোক চাদর বিছিয়েছে লেবাননের ক্রীড়াঙ্গনে। তাঁর শেষ ক্লাব আনসার টুইটারে লিখেছে, ‘গভীর দুঃখ ও বেদনায় আনসার ক্লাবের বোর্ড ক্লাবটির সন্তানদের একজন মোহামেদ আতাউয়ির মৃত্যুতে শোক জানাচ্ছে। শুধু ওর পরিবারই ওকে হারায়নি, ক্লাবেরও বড় ক্ষতি ওর চলে যাওয়া। ক্লাবের সমর্থকদের হৃদয়ে ও সব সময় বিশেষ জায়গা নিয়ে ছিল। সমর্থকেরা ওকে দেখত খুবই সুরুচিপূর্ণ একজন নেতা হিসেবে যে কিনা ক্লাবটাকে অনেক কিছু দিয়েছে।’