কে জিতবে ইউরো? প্রশ্নটা আসলেই প্রায় এক শ কোটি টাকার। ইউরোর চ্যাম্পিয়ন দল ১ কোটি ইউরো পাবে, বাংলাদেশি মুদ্রায় সেটা তো প্রায় এক শ কোটি টাকাই। সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু হবে ১১ জুন, শেষ ১১ জুলাই। ইউরোতে অংশ নিতে যাওয়া ২৪টি দলের খুঁটিনাটি জেনে নিলে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সহজ হতে পারে আপনার জন্য।
গত বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে শেষ ম্যাচের পর জিয়ানলুইজি বুফনের সেই কান্না কে ভুলতে পারে? খুব করে চেয়েছিলেন আরেকটি বিশ্বকাপ খেলতে। ইতালিয়ান ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই তারকার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। যে দলের জার্সিতে জ্বলজ্বল করছে বিশ্বজয়ের চার-চারটি স্মারক, সেই দলই গত বিশ্বকাপ খেলতে পারেনি। অতিরক্ষণাত্মক ফুটবল, কোচের সাবধানী কিন্তু ছন্নছাড়া কৌশলই কাল হয়েছিল ইতালির জন্য।
কিন্তু রবের্তো মানচিনির অধীনে এই ইতালি? সে দুঃস্বপ্নকে মাটিচাপা দিয়ে এসেছে বহু আগেই। দুই বছর ধরে একটা ম্যাচেও না–হারা ইতালির লক্ষ্য এখন ইউরোজয়। সে লক্ষ্যেই ২৬ সদস্যের দল ঘোষণা করেছেন ইন্টার মিলান, লাৎসিও ও ম্যানচেস্টার সিটির সাবেক এই কোচ। কেমন হয়েছে দলটা?
দল: ইতালি
ফিফা র্যাঙ্কিং: ৭
ইউরোতে সেরা সাফল্য
চ্যাম্পিয়ন (১৯৬৮)
গ্রুপে প্রতিপক্ষ
তুরস্ক (১১ জুন)
সুইজারল্যান্ড (১৬ জুন)
ওয়েলস (২০ জুন)
কোচ
রবের্তো মানচিনি
অধিনায়ক
জর্জো কিয়েল্লিনি
যাঁরা আছেন দলে
গোলরক্ষক: জিয়ানলুইজি দোন্নারুমা (এসি মিলান), অ্যালেক্স মেরেত (নাপোলি), সালভাতোরে সিরিগু (তোরিনো)
সেন্টারব্যাক: জর্জো কিয়েল্লিনি (জুভেন্টাস), লিওনার্দো বোনুচ্চি (জুভেন্টাস), ফ্রান্সেসকো আসেরবি (লাৎসিও), আলেসান্দ্রো বাস্তোনি (ইন্টার মিলান), রাফায়েল তোলয় (আতালান্তা)
রাইটব্যাক/রাইট উইংব্যাক: আলেসান্দ্রো ফ্লোরেঞ্জি (এএস রোমা), জিওভান্নি দি লরেঞ্জো (নাপোলি)
লেফটব্যাক/লেফট উইংব্যাক: এমারসন পালমিয়েরি (চেলসি), লিওনার্দো স্পিনাৎসোলা (এএস রোমা)
সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার/ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার: জর্জিনিও (চেলসি), নিকোল বারেল্লা (ইন্টার মিলান), মার্কো ভেরাত্তি (পিএসজি), মানুয়েল লোকাতেল্লি (সাসসুয়োলো), ব্রায়ান ক্রিস্তান্তে (এএস রোমা), মাত্তেও পেসিনা (আতালান্তা)
অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার: লরেঞ্জো পেল্লেগ্রিনি (এএস রোমা)
উইঙ্গার/ওয়াইড মিডফিল্ডার: ফেদেরিকো কিয়েসা (জুভেন্টাস), লরেঞ্জো ইনসিনিয়া (নাপোলি), ফেদেরিকো বের্নার্দেসকি (জুভেন্টাস), দমেনিকো বেরার্দি (সাসসুয়োলো)
স্ট্রাইকার: আন্দ্রেয়া বেলোত্তি (তোরিনো), চিরো ইম্মোবিলে (লাৎসিও), জিয়াকোমো রাসপাদোরি (সাসসুয়োলো)
শক্তি
রক্ষণভাগের হোক, বা মাঝমাঠের—মাঝের জায়গাটাই দলের সবচেয়ে শক্তির জায়গা। বুফন চলে যাওয়ার পর কী হবে, এ নিয়ে কোচকে কোনো চিন্তা করতে দেয়নি জিয়ানলুইজি দোন্নারুমার অবিশ্বাস্য উত্থান। বয়স মাত্র ২২, এর মধ্যেই পেশাদার ফুটবলে অর্ধযুগ পেরিয়ে এসেছেন, লিগে খেলে ফেলেছেন দুই শতাধিক ম্যাচ।
মানচিনি ঠিক আমার মতোই চিন্তা করে। দল ও দলের খেলোয়াড়দের মূল্যবোধ বোঝার জন্য ও চিন্তাধারা অনেকটা আমার মতোই।
সেন্ট্রাল ডিফেন্সে এখনো সদা সতর্ক প্রহরীর দায়িত্ব পালন করেন জুভেন্টাসের দুই—জর্জো কিয়েল্লিনি ও লিওনার্দো বোনুচ্চি। তাঁদের বিকল্প হিসেবে যাঁদের নেওয়া হয়েছে, প্রত্যেকেই যোগ্য। দুর্দান্ত ট্যাকলিং আর নিচ থেকে নিখুঁত লং পাস দেওয়ার জন্য ইন্টার মিলানের লিগজয়ী সেন্টারব্যাক বাস্তোনি মনে করিয়ে দেন তরুণ বোনুচ্চিকে। ক্যানসারকে পরাজিত করে ফুটবলে ফিরে আসা আসেরবি কয়েক বছর ধরেই লাৎসিও রক্ষণভাগের সেরা তারকা। ওদিকে কয়েক মৌসুম ধরে আতালান্তার উত্থানের পেছনে রাফায়েল তোলয়ের ভূমিকাও ফেলে দেওয়ার মতো নয়।
ইতালির মাঝমাঠে আছেন ভেরাত্তি, জর্জিনিও, বারেল্লা, পেসিনা, লোকাতেল্লি, পেল্লেগ্রিনির মতো দুর্দান্ত টেকনিক্যাল ক্ষমতাসম্পন্ন ফুটবলার। আগে ইতালি বলতেই যেমন রক্ষণাত্মক এক দলের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠত, মানচিনি এসে সেই ধারা বদলেছেন দারুণভাবে। আর কোচ এই আধুনিক দর্শক বাস্তবায়ন করতে পারছেন, হাতের কাছে এমন দুর্দান্ত কুশলী কিছু মিডফিল্ডারের উপস্থিতিতে।
দুর্বলতা
দুই বছর ধরে যে দল একটা ম্যাচও হারে না, সে দলের দুর্বলতা খুঁজে বের করা একটু কঠিনই বটে। তা–ও এই দলের কোনো খামতি থেকে থাকলে সেটা লেফটব্যাক পজিশনে। লেফটব্যাক এমারসন পালমিয়েরির মান নিয়ে প্রশ্ন নেই, কিন্তু বাকিদের সঙ্গে তুলনা করতে একটু পিছিয়েই থাকবেন চেলসির এই লেফটব্যাক।
ক্রমাগত চোটের কারণে ক্লাবের মূল একাদশে বেন চিলওয়েল ও মার্কোস আলোনসোর কাছে জায়গা হারিয়েছেন। একই সমস্যা জর্জো কিয়েল্লিনিরও। এক যুগ ধরে ইতালি রক্ষণের অবিচ্ছেদ্য অংশ এই তারকা এখন বুড়িয়ে গেছেন, গতিশীল ফরোয়ার্ডের সঙ্গে তেমন পেরে ওঠেন না। কিয়েল্লিনিকে মূল একাদশে রেখে হাইলাইন রক্ষণ নিয়ে খেলা ইতালির জন্য চিন্তার কারণ হতে পারে।
ইতালির মূল স্ট্রাইকার হিসেবে খেলবেন তোরিনোর আন্দ্রেয়া বেলোত্তি বা লাৎসিওর চিরো ইম্মোবিলে। ক্লাব ক্যারিয়ারে দুজনই বছরের পর বছর ধরে গোলবন্যা বইয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সেই ফর্মটা ধরে রাখতে পারেন না সেভাবে। এই কারণে দুজনের কেউই মানচিনির মূল স্ট্রাইকার হিসেবে জায়গা পাকা করতে পারেননি। লেফট উইঙ্গার হিসেবে লরেঞ্জো ইনসিনিয়ার যোগ্য বিকল্পও নেই। কিয়েসা, বেরার্দি, বের্নার্দেসকি—সবাই ডান দিকে খেলতেই স্বচ্ছন্দ।
সম্ভাব্য একাদশ ও খেলার কৌশল (৪-৩-৩)
মানচিনি থিতু হয়েছেন ৪-৩-৩ ছকে। আক্রমণে যে ছক ৪-৩-৩ থাকলেও, রক্ষণের সময় ৪-১-৪-১ ছকে রূপ দেন।
গোলকিপার দোন্নারুমার সামনে বোনুচ্চি-কিয়েল্লিনি, দুই ফুলব্যাক হিসেবে ফ্লোরেঞ্জি-এমারসন, তিন মিডফিল্ডার হিসেবে ভেরাত্তি, জর্জিনিও ও বারেল্লার খেলার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। রক্ষণের একটু ওপরে থেকে ওপরে নিখুঁত পাস পাঠানো দায়িত্ব জর্জিনিওর। জর্জিনিওর না খেললে সে জায়গায় সেনসির খেলার কথা থাকলেও চোটের কারণে খেলছেন না ইন্টার মিডফিল্ডার। তাঁর জায়গায় ডাকা হয়েছে আতালান্তার মাত্তেও পেসিনাকে। জর্জিনিওর এক পাশে খেলা বারেল্লা এই দলের ইঞ্জিন। এই মিডফিল্ডার প্রায়ই ওপরে উঠে ছদ্ম প্লে-মেকারের ভূমিকা পালন করেন।
জর্জিনিওর আরেক পাশে খেলবেন মার্কো ভেরাত্তি। ক্যারিয়ারের শুরুতে বল পায়ে দুর্দান্ত এই মিডফিল্ডারকে আন্দ্রেয়া পিরলোর সঙ্গে তুলনা দেওয়া হলেও ক্যারিয়ার যত এগিয়েছে, তত দেখিয়েছেন, চাইলে ডি-রসি কিংবা গাত্তুসো হওয়ার সামর্থ্যও আছে তাঁর। আক্রমণের সময়ে দুই উইঙ্গার কিয়েসা আর ইনসিনিয়া প্রথাগত উইঙ্গারের ভূমিকা পালন করেন না। স্ট্রাইকারকে মাঝে রেখে একটু পেছনে ভেতরে ঢুকে গিয়ে হাফস্পেস বরাবর ঘোরাঘুরি করতে থাকেন। সাইডলাইনে ফেলে আসা জায়গাটায় তখন ওপরে উঠে ‘কাভার’ করেন দুই ফুলব্যাক।
প্রত্যাশা ও বাস্তবতা
অন্ততপক্ষে ২০ ম্যাচ ম্যানেজার ছিলেন, ইতালি দলের এমন কোচদের মধ্যে মানচিনির জয়ের হার সবচেয়ে বেশি। বাছাইপর্বের ১০ ম্যাচেই জিতিয়েছেন দলকে। মানচিনির অধীনে ২০১৯ সাল থেকে ১৮ ম্যাচ অপরাজিত ইতালি। এমন রেকর্ড যে দলের, সে দল শিরোপা ছাড়া অন্য কিছু ভাববে কেন? ১৯৬৮ ইউরোর সাফল্যের পুনরাবৃত্তি তাই এবারও করতে চায় তারা। ইতালির শক্তিশালী স্কোয়াড ও কোচের ক্ষুরধার মস্তিষ্ক সে আশা ও বাস্তবতার পালে হাওয়াও দিচ্ছে অনেক।