কে জিতবে ইউরো? প্রশ্নটা আসলেই প্রায় ১০০ কোটি টাকার। ইউরোর চ্যাম্পিয়ন দল ১ কোটি ইউরো পাবে, বাংলাদেশি মুদ্রায় সেটা তো প্রায় ১০০ কোটি টাকাই। সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু হবে ১১ জুন, শেষ হবে আগামী ১১ জুলাই। ইউরোয় অংশ নিতে যাওয়া ২৪টি দলের খুঁটিনাটি জেনে নিলে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সহজ হতে পারে আপনার জন্য।
একেকটা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আসে আর ইংল্যান্ডের শিরোপা জয়ের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়তো সবচেয়ে বেশিই হয়। এবারের ইউরোতেও তাঁর ব্যতিক্রম হচ্ছে না। টুর্নামেন্টের অন্যতম শক্তিশালী শিরোপাপ্রত্যাশী দলের ছোট্ট তালিকায়ও অনেকে নাম রাখছেন ইংল্যান্ডের। ১৯৯৬ ইউরোর সেমিফাইনালে ওঠা দলটাকে নিয়ে এবার আলোচনার কারণও আছে। বেশ কিছু তরুণ প্রতিভাবান খেলোয়াড় নিয়ে ইউরোয় যাচ্ছে ইংল্যান্ড। একই কোচের অধীনে সর্বশেষ বিশ্বকাপে চতুর্থ স্থান অর্জন করেছিল ইংলিশরা, সেটাও আশার পালে হাওয়া দিচ্ছে।
দল: ইংল্যান্ড
ফিফা র্যাঙ্কিং: ৪
দলে আছেন যাঁরা
গোলরক্ষক
ডিন হেন্ডারসন (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড), জর্ডান পিকফোর্ড (এভারটন), স্যাম জনস্টন (ওয়েস্ট ব্রমউইচ অ্যালবিওন)
সেন্টারব্যাক
হ্যারি ম্যাগুয়ার (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড), জন স্টোনস (ম্যানচেস্টার সিটি), কনর কোডি (উলভারহ্যাম্পটন ওয়ান্ডারার্স), টায়রন মিংস (অ্যাস্টন ভিলা), বেন হোয়াইট (ব্রাইটন)
রাইটব্যাক/রাইট উইংব্যাক
কাইল ওয়াকার (ম্যানচেস্টার সিটি), কিয়েরান ট্রিপিয়ের (আতলেতিকো মাদ্রিদ), রিস জেমস (চেলসি)
লেফটব্যাক/ লেফট উইংব্যাক
বেন চিলওয়েল (চেলসি), লুক শ (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড)
সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার/ ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার
জর্ডান হেন্ডারসন (লিভারপুল), ডেকলান রাইস (ওয়েস্ট হাম ইউনাইটেড), ক্যালভিন ফিলিপস (লিডস ইউনাইটেড)
অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার
জুড বেলিংহাম (বরুসিয়া ডর্টমুন্ড), মেসন মাউন্ট (চেলসি)
উইঙ্গার/ ওয়াইড মিডফিল্ডার
রহিম স্টার্লিং (ম্যানচেস্টার সিটি), ফিল ফোডেন (ম্যানচেস্টার সিটি), জ্যাক গ্রিলিশ (অ্যাস্টন ভিলা), জেডন সানচো (বরুসিয়া ডর্টমুন্ড), মার্কাস রাশফোর্ড (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড), বুকায়ো সাকা (আর্সেনাল)
স্ট্রাইকার
হ্যারি কেইন (টটেনহাম হটস্পার), ডমিনিক কালভার্ট-লুইন (এভারটন)
কোচ
গ্যারেথ সাউথগেট
অধিনায়ক
হ্যারি কেইন
ইউরোয় সেরা সাফল্য
সেমিফাইনাল (১৯৯৬)
গ্রুপে প্রতিপক্ষ
ক্রোয়েশিয়া (১৩ জুন)
স্কটল্যান্ড (১৮ জুন)
চেক প্রজাতন্ত্র (২২ জুন)
শক্তি
একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে ইংল্যান্ডের যে সোনালি প্রজন্ম এসেছিল, এবারের দলটা অন্তত প্রতিভার দিক দিয়ে সেই দলের কাছাকাছি। দলের অভিজ্ঞ খেলোয়াড়েরা ছাড়া এবার প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলতে আসা ফোডেন, মাউন্ট, গ্রিলিশ, সাকা, বেলিংহাম, সানচো, ফিলিপস, রাইস, জেমস, চিলওয়েল, ডিন হেন্ডারসন—প্রত্যেকেই আছেন দুর্দান্ত ফর্মে। এক বছর ইউরো পেছানোয় তাঁদের জন্য সুবিধাই হয়েছে বরং। বেশ কিছু পজিশনে অসাধারণ কিছু খেলোয়াড়ের ছড়াছড়ি দলটায়।
চোটের কারণে ট্রেন্ট অ্যালেক্সান্ডার-আরনল্ড না খেললেও রাইটব্যাক হিসেবেই দলে আছেন আতলেতিকোর হয়ে লিগ জেতা কিয়েরান ট্রিপিয়ের, চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী রিস জেমস ও ইংলিশ লিগজয়ী কাইল ওয়াকার। লেফটব্যাকেও একই অবস্থা। লুক শ আর চিলওয়েল দুজনই আছেন অসাধারণ ফর্মে। উইঙ্গার বা ইনসাইড ফরোয়ার্ড হিসেবে ফোডেন, মাউন্ট, সানচো, সাকা, স্টার্লিং, রাশফোর্ড, গ্রিলিশরা সাউথগেটকে মধুর সমস্যায়ই ফেলবেন। স্ট্রাইকে কেইনের বিকল্প হিসেবে আছেন ডমিনিক কালভার্ট-লুইন, প্রিমিয়ার লিগের সদ্য শেষ হওয়া মৌসুমে লিগের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার ছিলেন তিনি।
দুর্বলতা
কিছু কিছু পজিশনে ইংল্যান্ডের যেমন প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের শেষ নেই, কিছু কিছু জায়গায় আবার দুর্বলতাও আছে অনেক। গোলকিপার হিসেবে কে খেলবেন, এখনো নিশ্চিত নয়। পিকফোর্ডের ওপর সাউথগেটের ভরসা থাকলেও কখনোই অত ভালো কিপার ছিলেন না এভারটনের এই খেলোয়াড়। তাঁর জায়গায় এবার যাঁকে খেলানো হতে পারে, সেই ডিন হেন্ডারসনও অনভিজ্ঞ।
মাঝমাঠে খেলোয়াড়শূন্যতা ভোগাতে পারে দলটাকে। জর্ডান হেন্ডারসন, ডেকলান রাইস ও কালভিন ফিলিপস ছাড়া এমন কেউ নেই, যিনি আক্রমণের চিন্তা ভুলে মাঝমাঠে থেকেই খেলা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। ট্রেন্ট অ্যালেক্সান্ডার-আরনল্ডের না থাকাটাও চিন্তার কারণ হতে পারে সাউথগেটের জন্য। আক্রমণাত্মক রাইটব্যাক হিসেবে লিভারপুলের এই তারকার মতো কার্যকর খেলোয়াড় এই স্কোয়াডে নেই তেমন।
হ্যারি ম্যাগুয়ার খেলতে না পারলে সাউথগেট ইংল্যান্ডের রক্ষণকে কীভাবে খেলান, সেটাও দেখার বিষয়।
সম্ভাব্য একাদশ ও খেলার কৌশল (৪-৩-৩/৩-৪-৩)
একসময় ৪-৪-২ ছকের বাইরে নড়তে চাইত না ইংল্যান্ড। খেলোয়াড়ের বৈশিষ্ট্য, মান যা-ই হোক না কেন, সবাইকে ঠেসেঠুসে ৪-৪-২ ছকে ঢুকিয়ে খেলানোর চেষ্টা করা হতো। যে কারণে আগে স্টিভেন জেরার্ড, পল স্কোলস, ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ড, ডেভিড বেকহাম, মাইকেল ওয়েন, ওয়েইন রুনি, জন টেরি, রিও ফার্ডিনান্ডের মতো খেলোয়াড় থাকার পরও কিছুই জেতেনি ইংল্যান্ডের সোনালি প্রজন্ম।
গ্যারেথ সাউথগেট ছক ও কৌশল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে অনেক বেশি আগ্রহী। গত বিশ্বকাপেই যেমন, ইংল্যান্ড সেমিফাইনালে উঠেছিল ৩-৫-২ ছকে খেলে। উইঙ্গার রহিম স্টার্লিংকে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলানো, রাইটব্যাক কাইল ওয়াকারকে রাইট সেন্টারব্যাক হিসেবে খেলানো, সেবার এমন অনেক কিছু করেছেন সাউথগেট। এবারও তাঁর ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না।
বিশ্বকাপের পর ৪-৩-৩ ছকেই মূলত খেলিয়েছেন দলকে। এর পেছনে মূল কারণ, দলে প্রতিভাবান আক্রমণাত্মক খেলোয়াড়দের উপস্থিতি। নির্ভরযোগ্য কেইন, স্টার্লিং, রাশফোর্ড তো আছেনই, এবার দুর্দান্ত ফর্ম দেখিয়ে দলে জায়গা করে নিয়েছেন জ্যাক গ্রিলিশ, ফিল ফোডেন, মেসন মাউন্ট, জেডন সানচো, ডমিনিক কালভার্ট-লুইনরা। ফলে সাউথগেটকে এমন এক ছকের ওপর ভরসা করতে হচ্ছে, যেখানে বেশি আক্রমণাত্মক খেলোয়াড় খেলানো যায়।
কিন্তু সাউথগেট ৪-৩-৩ ছকে দলকে খেলাতে পারবেন কি না, সেটা নির্ভর করছে মিডফিল্ডার জর্ডান হেন্ডারসন ও সেন্টারব্যাক হ্যারি ম্যাগুয়ারের ওপর। দুজনই মোটামুটি চোটাক্রান্ত। হেন্ডারসন তা–ও একটু সুস্থ হয়ে খেলা শুরু করেছেন, ম্যাগুয়ার কখন মাঠে নামতে পারবেন, সেটা নিয়ে সাউথগেট নিজেও নিশ্চিত নন। এই দুজন না থাকলে রক্ষণভাগকে বাড়তি নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আবারও ৩-৪-৩ ছকে ফিরতে পারেন সাউথগেট। দলে বেশ কিছু ডিফেন্ডার আছেন, যাঁরা ক্লাবের কারণে ৩-৪-৩ বা ৩-৫-২ ছকগুলোয় খেলে অভ্যস্ত—উলভারহ্যাম্পটনের কনর কোডি, চেলসির রিস জেমস, বেন চিলওয়েল, আতলেতিকোর কিয়েরান ট্রিপিয়ের, ব্রাইটনের বেন হোয়াইট প্রমুখ। টায়রন মিংসের মতো বাঁ পায়ের সেন্টারব্যাকও আছে এই দলে, ফলে সাউথগেট চাইলেই ম্যাগুয়ারের অভাব পূরণ করার জন্য ৩-৪-৩ ছকে ফিরতে পারেন।
৩-৪-৩ ছকে খেললে সাউথগেটের স্বভাব হলো সাধারণত দুজন সেন্ট্রাল ও ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার নিয়ে খেলা। সে ক্ষেত্রে হেন্ডারসন সুস্থ থাকলে তাঁর সঙ্গে খেলবেন ওয়েস্ট হামের ডেকলান রাইস। হেন্ডারসন খেলতে না পারলে ১৭ বছরের জুড বেলিংহাম নয়, বরং অপেক্ষাকৃত অভিজ্ঞ লিডস ইউনাইটেডের কালভিন ফিলিপসের ওপরেই ভরসা রাখবেন সাউথগেট।
আক্রমণভাগে এক হ্যারি কেইন ছাড়া কারোর জায়গা নিশ্চিত নয়। দুই উইং/ ইনসাইড ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলার জন্য ফোডেন, মাউন্ট, গ্রিলিশ, সাকা, রাশফোর্ড, সানচো, স্টার্লিং সবাই লড়বেন। সাধারণত গোলকিপার হিসেবে এভারটনের জর্ডান পিকফোর্ডের ওপর সাউথগেটের ভরসা থাকলেও গত দেড় বছরে পিকফোর্ডের বাজে ফর্ম আর ডিন হেন্ডারসনের উত্থান সিদ্ধান্ত বদল করে দিতে পারে।
গোটা স্কোয়াডের এই অননুমেয়তাই সাউথগেটের সবচেয়ে বড় শক্তি।
‘বড় ম্যাচ খেলার সময় আমাদের মানসিকতা ইতিবাচক রাখতে হবে। আমরা জানি আমরা চাইলেই বড় দলগুলোর চিন্তার কারণ হতে পারি। আমাদের এমন কিছু খেলোয়াড় আছেন, যাঁরা গোল করতে পারেন। আমরা যদি খুব বেশি গোল না খাই, তাহলে ভালো করার সম্ভাবনা আছে।’
প্রত্যাশা ও বাস্তবতা
রক্ষণভাগ তুলনামূলকভাবে বয়সী হলেও, মাঝমাঠ ও আক্রমণভাগে অপেক্ষাকৃত কম বয়সী ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়েরা অভিজ্ঞতার দিক দিয়েও নবীন। এই স্কোয়াড নিয়ে ট্রফির আশা করা বাড়াবাড়ি। নকআউট রাউন্ডে সাউথগেটের অধীনে কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে এখনো বড় কোনো পরাশক্তিকে হারাতে পারেনি ইংল্যান্ড। এবারও না হারাতে পারলে দ্বিতীয় রাউন্ড বা কোয়ার্টারেই যাত্রা শেষ হয়ে যেতে পারে তাঁদের।