আয়ের কথা ফাঁস করায় মামলা করতে যাচ্ছেন মেসি
৫৫ কোটি ৫২ লাখ ৩৭ হাজার ৬১৯ ইউরো।
৫ হাজার ৭০২ কোটি ৮১ লাখ ৮৭ হাজার টাকার বেশি।
আগামী জুনে বার্সেলোনার সঙ্গে চুক্তি শেষ হয়ে যাচ্ছে মেসির। যে চুক্তি নবায়ন করা না করা নিয়েই উত্তেজিত ফুটবল বিশ্ব। চুক্তি নবায়ন না করা মানেই পেশাদার ফুটবলে মেসির গায়ে বার্সেলোনা ভিন্ন অন্য কোনো ক্লাবের জার্সি গায়ে চাপানো। ২০১৭ সালে সর্বশেষ বার্সেলোনার সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন মেসি। সে চুক্তিতেই মেসির পেছনে চার বছরে ৫৫ কোটি ৫২ লাখ ৩৭ হাজার ইউরোর অঙ্কটা খরচ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বার্সেলোনা।
কাতালান পত্রিকা এল মুন্দো সে চুক্তির কথা সবার সামনে নিয়ে এসেছে। এত দিন মেসির বেতন কত, সেটা নিয়ে আভাসে একটা অঙ্ক বলতেন সবাই। করসহ সে অঙ্কটা ১০০ মিলিয়ন বা ১০ কোটি ইউরো বলেই ভাবা হতো। কিন্তু মেসির বেতন বাবদ বার্সেলোনার খরচ যে আরও বেশি, সে খবরও সে সুবাদেই জানা গেছে। এমনকি ক্রীড়াজগতে এত বড় অঙ্কের চুক্তি হয়নি কখনো। চরম গোপনীয় এ তথ্য ফাঁস করে দেওয়ায় এখন এল মুন্দোর বিরুদ্ধে মামলা করতে যাচ্ছেন মেসি।
ফুটবলে সবচেয়ে বেশি বেতন মেসি পান, এটা সবার জানা। এই বেতনকে ঘিরে মনোমালিন্যে রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়ে জুভেন্টাসে গেছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। মেসির সঙ্গে হরদম তাঁর তুলনা হয়, কিন্তু বেতনে তাঁর অর্ধেকও পান না, এটা মেনে নিতে পারেননি রোনালদো। তবে মেসির বেতনের অঙ্কটা সবার অজানা ছিল। কারণ, চুক্তি গোপনীয়। একজন খেলোয়াড় একটি ক্লাব থেকে কত বেতন পান, এটা কখনোই কাউকে জানানো হয় না। আকারে–ইঙ্গিতে একটি কাছাকাছি অঙ্ক প্রকাশিত হতে পারে। কিন্তু একদম একক, দশকের অঙ্ক মিলিয়ে তাঁর আয় বা সুযোগ-সুবিধার কথা জানা সম্ভব নয়।
২০১৭ সালে মেসির নবায়ন করা চুক্তির তথ্যও কোনো পত্রিকা পাওয়ার কথা নয়। এ তথ্য মাত্র চারটি পক্ষের কাছে থাকার কথা। মেসির নিজের কাছে এ চুক্তির খুঁটিনাটি থাকবে, বার্সেলোনার কাছে এই কাগজপত্র থাকবে। সে সঙ্গে লা লিগা ও মেসির আইনজীবীদের কাছেই এ কাগজপত্র আছে। এল মুন্দো যে কাগজ হাতে পেয়েছে, সেটাকে ভুয়া বলে অভিযোগও তোলা হয়নি ক্লাব ও মেসির পক্ষ থেকে। বরং তাদের প্রতিক্রিয়াই নিশ্চিত করেছে, প্রকাশিত তথ্যগুলো সঠিক। এর ফলে একটি প্রশ্নও উঠে গেছে, এ গোপন তথ্য তাহলে ফাঁস করল কারা?
মেসি ও তাঁর আইনজীবীদের দিকে আঙুল তোলার সুযোগ নেই। এমন এক তথ্য ফাঁস হলে মেসির কোনো লাভ নেই। বরং অনেক সমর্থকের চোখেই তাঁর ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে এমন ঘটনায়। বার্সেলোনা আর্থিক দৈন্যের মধ্যে যাচ্ছে। কদিন আগেই জানা গেছে, ১২০ কোটি ইউরো দেনার মধ্যে আছে বার্সেলোনা। এ সময় মেসির জন্য প্রতি মৌসুমে প্রায় ১৪ কোটি ইউরো খরচের অঙ্কটা অনেক প্রশ্ন তুলে দেয়। তাই সন্দেহের আঙুল শুধু লা লিগা ও বার্সেলোনার দিকেই যায়।
স্প্যানিশ লিগ কর্তৃপক্ষ নিয়ে বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদের অনেক ক্ষোভ থাকতে পারে। তাই বলে কোনো ক্লাবের গোপন নথি ফাঁস করে দেওয়ার মতো কোনো কাণ্ড লা লিগা কর্তৃপক্ষ করবে, এমন অভিযোগ কোনো কড়া সমালোচকও করবেন না। ওদিকে কয়েক বছর ধরেই মেসির ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে জোসেপ মারিয়া বার্তোমেউ ও তাঁর বোর্ড। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাধিক অ্যাকাউন্ট সৃষ্টি করে মেসির বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো হয়েছিল। বার্সেলোনা সমর্থকদের কাছে মেসিকে খলনায়ক বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। সে চেষ্টা ধরা পড়ে গেছে। মেসির সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল বার্তোমেউর। পরে তো তাঁর প্রশাসনিক ব্যর্থতা নিয়ে বার্সেলোনা সমর্থকদের দাবির মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন বার্তোমেউ।
বার্তোমেউর জায়গায় আপৎকালীন দায়িত্ব পালন করছেন কার্লেস তুসকেতস। বার্তোমেউর আমলে আর্থিক দিক সামলানো এই কর্মকর্তা দায়িত্ব নিয়েই বলেছেন, মেসিকে যেতে না দিয়ে ভুল করেছে বার্সেলোনা। দেউলিয়া হতে বসা এক ক্লাবের জন্য মেসির বেতন কতটা ভারী হয়ে উঠছে, সেটাও বলেছেন তুসকেতস। এ নিয়ে সমালোচনা শুনলেও পিছপা হননি। নিজের মতে অনড় থেকেছেন। বলেছেন, ক্লাবের ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড় হলেও আর্থিক দিক থেকে বার্সেলোনার অন্যতম দুশ্চিন্তা হয়ে উঠছেন মেসি।
এমন সব কথাবার্তা বলে এমনিতেই মেসির বার্সেলোনা অধ্যায় শেষ করে আনার প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছেন তুসকেতস। এর মধ্যেই মেসির বেতনের খুঁটিনাটি প্রকাশিত হলো এল মুন্দোতে। সেখানে জানানো হয়েছে, ২০১৭ সালে চুক্তি নবায়ন করেই মেসি ১১ কোটি ৫২ লাখ ইউরো শুধু পেয়েছেন চুক্তিটা করার জন্য ভাতা হিসেবে। অবশ্য এ অর্থের বিনিময়ে মেসির ইমেজস্বত্বের একটা বড় অংশের নিয়ন্ত্রণও নিয়ে নেয় বার্সা।
এ ছাড়া চুক্তি থেকে মেসি ৭ কোটি ৭০ লাখ ইউরো পাওয়ার কথা আনুগত্য ভাতা হিসেবে। প্রতি মৌসুমে বেতন ও বিভিন্ন শর্ত সাপেক্ষে ভাতা বাবদ মেসিকে ১৩ কোটি ৮০ লাখ দেওয়ার চুক্তি করেছিল ক্লাব। সেই সঙ্গে এক মৌসুমে ৬০ ভাগ ম্যাচ খেলা, চ্যাম্পিয়নস লিগে একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত ওঠা, লা লিগা, কোপা দেল রে ও ফিফা দ্য বেস্ট জয়ের বিভিন্ন শর্ত ছিল চুক্তিতে। সে অনুযায়ী আরও ৭ কোটি ২০ লাখ ইউরো ভাতা পাওয়ার কথা ছিল মেসির। এর মধ্যে অনেক শর্তই পূরণ হয়নি। আর করোনার পর গত বছর বেতনের একটা নির্দিষ্ট অংশ কমিয়েছিলেন মেসি। ফলে চুক্তির সম্পূর্ণ অর্থ পাবেন না মেসি।
তবু এভাবে মেসির উচ্চ বেতনের কথা প্রকাশ্যে আনা আর সেই সঙ্গে দুই দিন পরপর বার্সেলোনার আর্থিক সমস্যার কথা জানানোর ইঙ্গিতটা বুঝে নিতে সমস্যা হয় না। সমর্থকদের কাছে মেসির ভাবমূর্তি নষ্ট করে দেওয়া, যাতে মেসি ক্লাব ছাড়তে বাধ্য হন। ফলে চুক্তির কথা ফাঁসের পর থেকেই সন্দেহের তির ছুটছে বার্সেলোনার দিকে। আরও ভালো করে বললে, সাবেক সভাপতি বার্তোমেউ ও বর্তমানে ক্লাবের দায়িত্বে থাকা তাঁরই পরিচালকদের একজন তুসকেতসের দিকে।
ইএসপিএন বলছে, মেসি এই চুক্তির গোপন তথ্য ফাঁসের ঘটনায় মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। প্রথমে এল মুন্দোর বিপক্ষে মামলা করবেন। আর সেই সঙ্গে বার্সেলোনার যারা এটা ফাঁস করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও মামলা করবেন। এমন অবস্থায় নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়েছে বার্সেলোনা। এক বিবৃতিতে তথ্য ফাঁসের ব্যাপারে তাদের কোনো হাত নেই বলে জানিয়েছে কাতালান ক্লাব, ‘বার্সেলোনা ক্লাব ও খেলোয়াড় মেসির মধ্যকার চুক্তির যে তথ্য আজ এল মুন্দোতে প্রকাশিত হয়েছে, সে ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করছে ক্লাব। কারণ, এমন কিছু প্রকাশিত হলো, যা দুটি পক্ষের মধ্যে হওয়া গোপনীয় তথ্য ছিল। বার্সেলোনা এ নথি ফাঁস হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো দায় নিতে রাজি নয় এবং এমন তথ্য প্রকাশিত হওয়ার ফলে যদি কোনো ক্ষতি হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে এল মুন্দো পত্রিকার বিরুদ্ধে বার্সেলোনা যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেবে।’
বার্তোমেউর অধীন বার্সেলোনার সাবেক বোর্ড ও মেসির সম্পর্ক যেমন হয়ে উঠেছিল, তাতে এমন কথা অনেকের বিশ্বাস না-ও হতে পারে। গত মৌসুমে মেসি যখন দল ছাড়তে চেয়েছিলেন, তখন বার্তোমেউর বোর্ড থেকে চেষ্টা করা হয়েছিল সব দায় মেসির ঘাড়ে ফেলতে। বাধ্য হয়েই গোলডটকমে একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন মেসি। এমন অবস্থায় মেসি–সংক্রান্ত যেকোনো বিষয়েই যে ক্লাবকে সন্দেহ করা হবে, সেটা জানা আছে তাদের।
এ কারণেই বিবৃতিতে নিজেদের অবস্থান আরেকটু পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করেছে বার্সেলোনা, ‘এটা যদি লিওনেল মেসির ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা হয়ে থাকে, তবে তাঁর প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছে বার্সেলোনা। যে ক্লাবের সঙ্গে কাজ করে তিনি বিশ্ব ও ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন, সে ক্লাবের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নষ্ট করার এ চেষ্টার পর তাঁর পাশেই থাকবে ক্লাব।’
এ বিবৃতি দিয়েও মেসির মামলার হাত থেকে বাঁচতে পারবেন চুক্তি ফাঁস করার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি?