আমাদের শ্রদ্ধা নিন, হে অগ্রজ!
রূপচাঁদা-প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কারে ২০১৮ সালে আজীবন সম্মাননা পেলেন ফুটবল ব্যক্তিত্ব গোলাম সারোয়ার টিপু।
গোলাম সারোয়ার টিপু ব্যাপারটিকে দেখেন একটু অন্যভাবে। রূপচাঁদা-প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা পেয়ে নিজের প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েও দিলেন সেটি। ‘আজীবন সম্মাননা’ এই শব্দ দুটির মধ্যেই কেন যেন একটা বিদায়ী রাগিণী বাজতে থাকে। সোজাসাপটা কথা বলতে চিরদিন অভ্যস্ত টিপু মাইক্রোফোন হাতে নিয়েই বললেন, ‘এই পুরস্কার মানেই কেন যেন মনে হয় তোমার দিন শেষ। বিদায়ের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু কর।’ কিন্তু সেই সঙ্গে এটিও বললেন, তাঁর আজীবনের সব অর্জনের দারুণ এক উদ্যাপন এই সম্মান।
কিছুটা রসিকতাও করলেন। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকে বললেন, সম্মাননার যে আর্থিক দিকটি আছে, সেটি গোপন রাখাই বোধ হয় ভালো ছিল। ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকার রূপসী বাংলা বলরুমে কিছুটা উৎকণ্ঠা। টিপু অর্থসংক্রান্ত ব্যাপারটি গোপন রাখতে বললেন কেন! পরক্ষণেই সবাইকে হাসির স্রোতে ভাসিয়ে তাঁর উত্তর, ‘বন্ধু প্রতাপ শংকর হাজরার কাছ থেকে একবার ভারতীয় মুদ্রায় ১৭০০ রুপি ধার নিয়েছিলাম। সেটি এত দিন ফেরত দিচ্ছিলাম না। এখন আমার হাতে এই চেক দেখে সে তো আমাকে এসে ধরবে। দে, আমার টাকা। ভালো টাকাই তো পাচ্ছিস!’
রূপচাঁদা-প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কারের আনুষ্ঠানিকতার সবচেয়ে আবেগঘন মুহূর্ত এই ‘আজীবন সম্মাননা’। খেলার মাঠে প্রায় গোটা জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া একজন মানুষ যখন এই পুরস্কার হাতে নেন, তখন তাঁর চোখে-মুখে থাকে একধরনের পরিতৃপ্তি। দৃপ্ত পদক্ষেপে সেই মানুষটি যখন মঞ্চের দিকে এগিয়ে যান, তখন নিশ্চয়ই তাঁর চোখের সামনে ভেসে ওঠে খেলোয়াড়ি জীবনের বর্ণিল সেই দিনগুলো।
পুরস্কার হাতে নেওয়ার সময় গোটা হলরুম যখন দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে তাঁকে অভিনন্দিত করে, তখন কেবল সেই প্রবীণ ক্রীড়াবিদ নন, উপস্থিত দর্শকদের মধ্যেও অনেকে অলক্ষ্যে চোখের জল মোছেন। যৌবনে যে মানুষটি মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, বয়সের ভারে তিনি হয়তো ন্যুব্জ। কিন্তু তাঁর ভেতর একধরনের দেখিয়ে দেওয়ার আনন্দ—নাহ্ খেলায় খেলায় জীবনের সেরা সময়টা পার করে দিয়ে খুব ভুল করিনি। তাঁর স্ত্রী, পুত্র-কন্যারাও আবেগাপ্লুত। মানুষকে এতটা সম্মান দেয় সবাই!
বিশেষ করে তাঁর উত্তরসূরিদের জন্যও এই মুহূর্তটা বিশেষ। এটা আরও বেশি অনুপ্রাণিত করে এখনকার ক্রীড়াবিদদের। দেশের জন্য নিজেকে নিংড়ে দিলে শেষ পর্যন্ত এমন সম্মান আমিও পাব—এই প্রত্যয় জন্ম নেয়। ভালোবাসা থেকে উত্তরসূরিরা শ্রদ্ধা জানায়, ‘আমাদের শ্রদ্ধা নিন, হে অগ্রজ!’
গোলাম সারোয়ার টিপুর বেলায় সবকিছু একটু অন্য রকম হলো। একসময়ের মাঠ কাঁপানো ফুটবলার, জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক কোচ ছিলেন তিনি। খেলেছেন পাকিস্তান জাতীয় দলে। আবাহনী-মোহামেডান, দেশের দুই দর্শকপ্রিয় ক্লাবই তাঁর ক্রীড়াশৈলিতে ধন্য। মঞ্চে এসে নিজের বক্তৃতায় কোনো আবেগ-টাবেগের মধ্যে গেলেন না। বরং নিজের ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটালেন। কৃতজ্ঞতা জানালেন সবাইকে তাঁর মতো করেই।
কীভাবে ফুটবলার হয়ে উঠেছিলেন টিপু? সেই গল্পটাও অনন্য। চাচার সঙ্গে খেলা দেখতে গিয়েছিলেন ঢাকা স্টেডিয়ামে। সেই পঞ্চাশের দশকে। কিন্তু অবাক হলেন, মাঠ কোথায়? চারদিকে যে টিনের বেড়া। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকতেই অবাক। এমন চমৎকার মাঠ! কী সবুজ। এই মাঠেই খেলা হয়। সেদিন থেকেই মন ঠিক করে ফেললেন, ফুটবলারই হতে হবে। হলেনও।
পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল দলে যে কজন বাঙালি ফুটবলার খেলেছেন, টিপু তাঁদের অন্যতম। ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে তিনি পাকিস্তান দলের হয়ে ইরান, তুরস্ক, সোভিয়েত ইউনিয়ন, নেপাল আর ভারত সফর করেন। তুরস্কের আরসিডি আর ইরানে ফ্রেন্ডশিপ ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলেছেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে আসামের গুয়াহাটিতে সর্বভারতীয় বরদুলই ট্রফিতে ঢাকা একাদশের হয়ে খেলেন। খেলেছেন বেশ কয়েকটি আগা খান গোল্ডকাপে।
১৯৮০ সালে কোচ হিসেবে আত্মপ্রকাশ তাঁর। মোহামেডান দিয়ে শুরু। ১৯৮২ থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন দলের কোচের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ’৮২ দিল্লি এশিয়ান গেমসে ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের সহকারী কোচ। ১৯৮৪–তে এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে জাতীয় দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কোচ ছিলেন ১৯৮৬ সালে সিউল এশিয়ান গেমসেও। ১৯৮৯ ইসলামাবাদ সাফ গেমসে ম্যানেজার ছিলেন। জাতীয় দলের দায়িত্বে ছিলেন ১৯৯৭ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বেও। ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি জাতীয় দলের দায়িত্ব পালন করেছেন বিভিন্ন সময়ে।
এমন অনেক অর্জন যাঁর, তাঁকে এমন সম্মাননা জানিয়ে ধন্য রূপচাঁদা ও প্রথম আলো। এই সম্মাননা গোলাম সারোয়ার টিপুর মতো ব্যক্তিত্বকে এই প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়াও এক উপলক্ষ। বাংলাদেশের খেলাধুলার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তিনি তাঁর অর্জন নিয়েই।