আদ্রিয়ানের গল্পটা রূপকথাকেও হার মানায়
>মাত্র দশ দিন আগেও কোনো 'চাকরি' ছিল না আদ্রিয়ানের। স্প্যানিশ এই গোলরক্ষক আদৌ শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবল খেলতে পারবেন কি না, সন্দেহ ছিল। মাত্র দশ দিনের ব্যবধানে লিভারপুলের সেই স্প্যানিশ গোলরক্ষকই এখন উয়েফা সুপার কাপ বিজয়ী!
জীবনের মোড় কীভাবেই না বদলে যায়! আদ্রিয়ানকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন! দশ দিন আগেও তাঁর চাকরি-বাকরি কিছুই ছিল না। অথচ লিভারপুলের দ্বিতীয় গোলরক্ষক হিসেবে দলে যোগ দেওয়ার এক সপ্তাহের মাথাতেই নতুন দলকে জেতালেন ইউরোপীয় শিরোপা, উয়েফা সুপার কাপ!
কে এই আদ্রিয়ান? দশ দিন আগে জিজ্ঞেস করলে একদম পাঁড় ফুটবল ভক্ত ছাড়া হয়তো কেউ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতেন না। তাও একটু পরিচয় দেওয়া যাক।
স্পেনের গোলরক্ষক তিনি। ইকার ক্যাসিয়াস, ভিক্টর ভালদেস, ডেভিড ডে গিয়া, পেপে রেইনা এমনকি কেপা আরিজাবালাগার যুগে কখনো স্পেনের জাতীয় দলে কল্কে পাননি। স্পেনের আন্দালুসিয়ায় জন্ম নেওয়া এই গোলরক্ষক ক্যারিয়ারের শুরুটা কাটিয়েছেন নিজ অঞ্চলের ক্লাব রিয়াল বেতিসেই। কিন্তু কখনই রিয়াল মাদ্রিদ বা বার্সেলোনার মতো নামীদামি স্প্যানিশ ক্লাবের নজরে পড়েননি। তবে স্পেনের বড় দলগুলোর নজরে না পড়লে কী হবে? ইংলিশ ওয়েস্ট হামের নজরে ঠিকই পড়লেন। ২০১৩ সালে ওয়েস্ট হামে যোগ দেওয়ার পর অর্ধযুগ থেকেছেন লন্ডনে। শেষ বছরটায় দলের মূল গোলরক্ষক থাকতে পারেননি। সোয়ানসি সিটি থেকে আসা পোলিশ গোলরক্ষক লুকাস ফাবিয়ানস্কির কাছে জায়গা হারিয়েছিলেন। ফাবিয়ানস্কিকে হারিয়ে ওয়েস্ট হামের মূল গোলরক্ষক আর হয়ে ওঠা হয়নি তাঁর। ওদিকে ওয়েস্ট হামের সঙ্গে চুক্তিও শেষ হয়ে যাচ্ছিল আদ্রিয়ানের। এই মৌসুমের শুরুতে ৩২ বছর বয়সী এই গোলরক্ষকের সঙ্গে নতুন চুক্তি করতে রাজি হয়নি ওয়েস্ট হাম। ফলাফল, গত জুন মাস থেকে আক্ষরিক অর্থেই 'বেকার' জীবন কাটাচ্ছিলেন এই তারকা। পেশাদার ক্যারিয়ারে কখনো কোনো ট্রফি না জেতা আদ্রিয়ান কি আদৌ আর কখনো কোনো ট্রফি জিতবেন, সৃষ্টি হয়েছিল ধোঁয়াশা। ট্রফি কি, আদৌ শীর্ষ কোনো লিগে ম্যাচ খেলবেন কি না, তিনি নিজেও জানতেন না।
কিন্তু তাও আশা হারাননি। যদি কেউ ডাক দেয়! যদি কোনো ক্লাব গোলরক্ষক হওয়ার চুক্তি নিয়ে আসে! ম্যাচ ফিট থাকতে হবে তো!
নিজের কাজটা তাই আদ্রিয়ান ঠিকই করেছেন চুপচাপ। কেউ ডাকুক বা না ডাকুক। শীর্ষ পর্যায়ের কোনো ক্লাবে জায়গা না পেয়ে স্পেনের ষষ্ঠ পর্যায়ে খেলা নিজের শহর আন্দালুসিয়ার ক্লাব ইউডি পিলাসের আধা-পেশাদার খেলোয়াড়দের সঙ্গে অনুশীলন করে নিজের ম্যাচ ফিটনেস ধরে রেখেছেন। শহরের পার্কে দেখা যেত, আপন মনে বল নিয়ে একা একা অনুশীলন করে যাচ্ছেন এই স্প্যানিশ তারকা। এর মধ্যে শোনা যাচ্ছিল, শীর্ষ পর্যায়ের ক্লাব রিয়াল ভায়াদোলিদ আগ্রহী তাঁকে দলে নেওয়ার ব্যাপারে। শেষমেশ সে চুক্তিটাও হয়নি।
ওদিকে টানা দুই বছর লিভারপুলের বেঞ্চে বসে থেকে থেকে অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন বেলজিয়ামের গোলরক্ষক সিমোন মিনিওলে। ব্রাজিল তারকা অ্যালিসন বেকারের জন্য খেলতে না পারা এই তারকা অবশেষে গত সপ্তাহে মাত্র আট মিলিয়ন পাউন্ডের বিনিময়ে যোগ দিয়েছেন নিজ দেশের ক্লাব ব্রুজেসে। ফলে লিভারপুলেরও একটা বিকল্প গোলরক্ষকের দরকার পড়েছিল।
ডাক পড়ল আদ্রিয়ানের। ইংলিশ লিগে প্রতিনিয়ত অবনমনের শঙ্কায় থাকে ওয়েস্ট হাম থেকে ইউরোপসেরা লিভারপুল - আদ্রিয়ান যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপকে হ্যাঁ বলতে একদমই সময় নেননি। লিভারপুলের নতুন 'দ্বিতীয়' গোলরক্ষক হয়ে গেলেন আদ্রিয়ান।
কিন্তু এখানেই যদি কাহিনি শেষ হয়ে যেত, তাহলে আর এই স্প্যানিশ গোলরক্ষকের কাহিনিটা রূপকথা হলো কীভাবে?
ইংলিশ লিগের এই মৌসুমের প্রথম ম্যাচে গত সপ্তাহে নরউইচ সিটির সঙ্গে চোটে পড়লেন দলের মূল গোলরক্ষক অ্যালিসন। দলের মূল গোলরক্ষক হওয়ার সুযোগ তখন আদ্রিয়ানের সামনে। মুহুর্মুহু করতালিতে অ্যানফিল্ডের নতুন 'সন্তান' কে গোলবারের নিচে বরণ করে নিল লিভারপুলের সমর্থকেরা। ম্যাচ শেষে জানা গেল, চার থেকে আট সপ্তাহ পর্যন্ত মাঠের বাইরে থাকা লাগবে অ্যালিসনের। অর্থাৎ এখন আদ্রিয়ানই লিভারপুলের মূল গোলরক্ষক!
ফলে সুপার কাপেও মূল একাদশে আদ্রিয়ানই নেমেছিলেন। দুর্দান্ত কিছু শট ঠেকিয়ে চেলসিকে শেষ পর্যন্ত জয়বঞ্চিত রেখেছেন। ম্যাচ নিয়ে গেছেন পেনাল্টি শুটআউটে। আর সেখানেই হলো আদ্রিয়ান-গাথার নাটকীয় পরিসমাপ্তি!
ম্যাচের একদম শেষ পেনাল্টি শটটা নিতে এসেছিলেন চেলসির তরুণ স্ট্রাইকার ট্যামি আব্রাহাম। পেনাল্টি বক্সের মধ্যে এই আব্রাহামকেই ফেলে দেওয়ার মাশুল কিছুক্ষণ আগে দিয়েছিলেন আদ্রিয়ান, পেনাল্টিতে গোল খেয়ে। স্প্যানিশ গোলরক্ষকের মাথায় প্রতিশোধের কোনো চিন্তা ঘুরছিল কী না কে জানে!
পা দিয়ে দুর্দান্ত ভাবে আব্রাহামের পেনাল্টিটা ঠেকিয়ে দিলেন আদ্রিয়ান। আর তাতেই সুপার কাপের শিরোপা জেতা নিশ্চিত হয়ে গেল লিভারপুলের। মাত্র দশ দিন আগেও যে আদ্রিয়ানের চাকরিই ছিল না, সে আদ্রিয়ানই লিভারপুলের সুপার কাপ জয়ের নায়ক! ক্যারিয়ারের প্রথম ট্রফি জেতার স্বপ্নটাও পূরণ হলও এভাবেই!
কে বলে রূপকথা শুধু বইয়ের পাতাতেই থাকে?