মেসির আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে জায়গা করে নিয়েছেন আগেই, গতকাল রাতে জায়গা নিশ্চিত হয়েছে রোনালদোর পর্তুগালের। দুজনেরই শেষ বিশ্বকাপ। মেসি-রোনালদোর শেষ, বলতেই কেমন একটা টান লাগে না বুকে?
পেগাসাস আর এরিয়নের গল্প এটা। এই গল্প গ্রিক পুরাণ থেকে তাদের বাস্তবে হাজির হওয়ার।
একদিকে পেগাসাস, যে উড়তে জানে। এমন এক ঘোড়া, যার দৌড়ানোর দরকারই পড়ে না। প্রকৃতির অকৃপণ দান তাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে গেছে। বিশ্বাসের সীমা ছাড়িয়ে তার পথপানে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকাই সাজে। তাকে অনুকরণের জো নেই কারও। স্বর্গ-মর্ত্যে অমন একজনই।
ওদিকে এরিয়ন। প্রথম দর্শনে আর দশটা ঘোড়া থেকে পার্থক্য করার উপায় নেই। পেগাসাসের ডানা তার নেই। দুজোড়া পা-ই সম্বল। তাকে অনুকরণ তো বটেই, ছাড়িয়ে যাওয়ারও স্বপ্ন দেখা যায়। কিন্তু এ যে ঘোরতর বিভ্রম, সে বার্তা ক্ষণিক পরেই মেলে। তার নাগাল পাওয়ার ক্ষমতা নেই কারও। উড়তে জানে না, তবু অদ্বিতীয় বলে দাবি তোলার অধিকার এরিয়নেরও।
তখন দিন অন্য রকম।
পায়ের ছন্দ মন ভোলায়, অপ্রাপ্তির আক্ষেপ তখনো মন মেদুর করে। আলতো এক স্পর্শ দেখে দিন পার হয়। দুরন্ত, দুর্বার গোলা মাসের পর মাস মন দোলায়। ফুটবল তখনো মর্ত্যের মানুষের, ‘যন্ত্র’ গালিটা শুধু জর্মনদের কপালে জোটে।
তখন আবির্ভাব দুজনের। একজন জন্মেছেন ক্লাসের প্রথম বেঞ্চের কোনায় বসবেন বলে, আরেকজন রাজ্যের দুষ্টুমি সেরে সে আসনে বসার জন্য তার সঙ্গে তর্কে জড়ান। তখন ফিফা ০৮–এর দিন।
একদিকে লিওনেল মেসি। যাঁর পায়ের জাদু প্রকৃতিদত্ত, সে সঙ্গে নিষ্ঠা আর একাগ্রতা অনন্য উচ্চতায় তুলে নিয়েছে তাঁকে। ওদিকে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। হ্যাঁ, প্রতিভা আছে কিন্তু সে প্রতিভার ছটায় অন্তত চোখ ঝলসে যায় না। কিন্তু নিবেদন, পরিশ্রম, আত্মবিশ্বাস আর হার না–মানা মানসিকতার কল্যাণে তাঁকেও ধরা দিয়েছে কল্পনাতীত সাফল্য। অনন্য শব্দটা তাঁর বেলায়ও খাটে।
এমন একজনের দেখাই বহু জীবনে মেলে না। তেমন দুজন হাজির এক সময়ে। এক আকাশে দুই সূর্য হয়ে জ্বলেছেন। তাতে কারও ঔজ্জ্বল্যে ঘাটতি পড়েনি। বরং একে অন্যের জ্বালানি হয়েছেন।
এ দুজনকে একসঙ্গে খেলতে দেখার স্বপ্ন কে দেখেনি?
ইএ স্পোর্টসের বিখ্যাত ভিডিও গেম তখনো এতটা বুদ্ধিমান হয়নি। এক ফুটবলারকে অন্য জায়গায় নিয়ে গেলেই তার মাথা খারাপ হয়ে যেত। তাই পছন্দের দুই খেলোয়াড় মাঠের এক অংশে থাকলেই সর্বনাশ, তাদের একসঙ্গে নামানোটা হয়ে উঠত ‘পাপ’। তখনো মাঠের ডান দিকে দেখা যেত ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে। লিওনেল মেসি তো শুরু থেকেই তা–ই। তাই এ দুজনকে একসঙ্গে খেলানোর স্বপ্নটা বাস্তবের মতো ভিডিও গেমেও কঠিন ছিল।
ফিফা-০৮ কাজটা একটু সহজ করল। মেসি-রোনালদো তখনো ডান দিকে। তবে মেসি রাইট ফরোয়ার্ড আর রোনালদো রাইট মিডফিল্ডার। দলবদলের ঝক্কিটা সামলে নিতে পারলেই কেল্লা ফতে।
পর্দায় ইচ্ছা পূরণ হয়, বাস্তবে তা হওয়ার নয়। একজনের গায়ে নীল-মেরুনের ভালোবাসা, অন্যজন লাল। সে লাল আভিজাত্যের সাদা বনে গেল আর তাতে আমাদের না সাধ মিটিল, না আশা পুরিল। ভাগ্যিস তবু ফুরিয়ে যায়নি কিছুই।
নিজেরা জ্বলজ্বল করেছেন, সে আলোয় আলোকিত আমরা। একজন পেগাসাস হয়ে উড়ছেন, দেবালয়েও উঁকিঝুঁকি মারছেন। অন্যজন এরিয়নের মতো দুর্বার, যাত্রাপথে স্ফুলিঙ্গ ফোটান। আর আমরা ভাগ হতে থাকি। কেউ ওঁর ডানায় চড়ে স্বপ্ন দেখি, কেউ এঁর পথের ধুলা কপালে মাখি।
এরপর দিন বিস্বাদের।
একের প্রেমে মজে অন্যে কালি লেপার। ভালোবাসার মানে যে বিদ্বেষ নয়, তা ভুলে যাওয়ার।
স্বপ্ন বোনায় ব্যস্ত তাঁরা, আমরা তেতো স্বাদ ছড়াই। গোলের পর গোল, চুরমার রেকর্ডের পর রেকর্ড। অবিশ্বাসের মাত্রা ছাড়ে, ছাড়ে বিদ্বেষ আর বিভেদেরও। একে চূড়ায় তুলি, টেনেহিঁচড়ে ধুলায় মিশাই ওকে। একজন ছেলেভোলানো হাসিতে বিতর্ক এড়ান, আরেকজন অহমের চাহনিতে নিজের দাবি জানান। আর আমরা ভাগ হতে থাকি, দূরত্ব বাড়ে আরও। পেগাসাসের ডানাতেও খুঁত খুঁজে নিই, এরিয়নের গতির ছন্দেও ভ্রু কুঞ্চিত করি।
কখনো এই পক্ষের ঢাল জাভি-ইনিয়েস্তা, ওদিকে ওজিল-মদরিচ-ক্রুস। পারলে জাভি-ইনিয়েস্তাকে ছাড়া জেতানোর চ্যালেঞ্জ, ওদিকে মদরিচ-ক্রুসদের ছাড়া চূড়ায় ওঠার আহ্বান। সর্বকালের সেরা গোলের পুনর্জন্মেও কারও মন ভরে না, মাধ্যাকর্ষণকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাতাসে দ্বিচক্রযান চালানোর মুহূর্তেও কারও প্রশস্তি ছোটে না।
ক্লাবের প্রতি ভালোবাসাও অনেকের চোখে দুর্বলতা, নতুন চ্যালেঞ্জ নেওয়াও ঘোর অর্থলিপ্সা। তাঁরা আমাদের সাধ মেটান, ক্ষুধাও বাড়ান। অকল্পনীয়তেও আর সুখ জাগে না, জাদুতেও মায়া জাগে না। আরও চাই, আরও চাই, আরও চাই!
অতঃপর দিন হাহাকারের।
ভক্তের রেষারেষি চলতে থাকে, শ্রান্তি পেয়ে বসে তাঁদের। আমরা দ্বন্দ্বে জড়াই, ক্লেদ বাড়াই, তর্কের নেশায় মাতি। তারার দীপ্তি কমতে থাকে। তাঁরা দল পাল্টান, রূপ বদলান, আমরা ভোল পাল্টাই না। এমন দুজনকে একসঙ্গে দেখার সৌভাগ্যে আপ্লুত হই না। একের শৌর্যে মুগ্ধ হলেও যে অন্যের ডানার আলোকচ্ছটা কমে না, সে বোধ জাগে না। কারও ছন্দের স্তুতিতে অন্যের ভাগে কম পড়ে, সে ভ্রান্তি ঘোচে না। ভালোবাসা পেতে এসে তাই অকারণ ঘৃণাও জোটে তাঁদের।
না, মিথ্যা বলা হয়েছিল। এ গল্প পেগাসাস আর এরিয়নের নয়। কল্পকথা আর লোকমুখে হাজার বছরের উপস্থিতি তাদের অমরত্ব দিয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী কাটিয়ে দিয়েও তাদের ডানায় অবসাদ জমে না, খুরে ক্লান্তির ছাপ মেলে না। হয়তো লোকচক্ষুর আড়ালে, তবু তারা যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী তেমনই থাকবেন, যেমনটা ছিলেন জন্মলগ্ন থেকে। একজন অক্লান্ত ঢঙে, আপন মনে মেঘ থেকে মেঘে রংধনুর আলপনা গায়ে মাখবে। অন্যজন অলিম্পাস থেকে হিমালয়ময় ছুটে বেড়াবে, মারে নস্ট্রাম আর অতলান্তের তফাত ঘোচাবে ইচ্ছা হলেই।
তাদের ভাবনায় জেমসের হাহাকারের রেণু কখনো ভাসবে না...
‘অস্তাচলে সূর্য ডুবে গেলে
ফিরিয়ে তাকে কি আনা যায়’
মেসি-রোনালদো বহুদিন ভুলিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু মায়ার বিভ্রম একসময় কাটে, আমরা অবাক হই তাঁদের ক্লান্তি দেখে। প্রত্যাশার চাপ আর অহমের ভারে দিন দিন ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে কাঁধ দুটো। না দেখার ভানেও তা আর আড়ালে হারায় না।
দেড় যুগ তাঁরা আলো ছড়িয়েছেন, আমরা তাতে উচ্ছ্বাসে ভেসেছি, উন্মাতাল হয়েছি। কিন্তু দিন শেষে ক্লান্তি সূর্যকেও পেয়ে বসে, ডুব দিতে হয় তাকে। এক আকাশে জ্বলা দুই সূর্যের শেষ আলোটুকু এখনো গোধূলি রাঙাচ্ছে। ভক্তের ভেদাভেদের বাড়াবাড়িটা সয়েই শেষবারের মতো আলো ছড়াচ্ছেন।
দপ করে নিভে যাওয়ার আগে কি বোধোদয় হবে আমাদের? এমন দুজনের প্রাপ্যটা কি বুঝিয়ে দিতে পারব আমরা?