অর্থনীতি কেন ইংল্যান্ডের জয় চায়

ইংল্যান্ডের জয় চায় অর্থনীতিছবি: রয়টার্স

একটা সময় ইতালির সিরি ‘আ’ ছিল সবচেয়ে সফল ও জনপ্রিয় লিগ। বিশেষ করে ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ছিল সিরি ‘আ’র স্বর্ণদশক। এ সময়ের মধ্যে ইন্টার ও এসি মিলান তিনবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে। বিশ্বের সব তারকা খেলোয়াড়ের প্রধান গন্তব্য ছিল ইতালি। কাকা, জিদান বা কানাভারো সিরি ‘আ’তে খেলেই ইউরোপের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন। ইতালির সেই ফুটবল সাম্রাজ্যের পতন শুরু এরপর থেকে। এর বড় কারণ ছিল, দেশটির তীব্র অর্থনৈতিক সংকট। সে সময়ে ঋণে জর্জরিত ইউরোপের প্রধান দুটি দেশের একটি ছিল ইতালি, অন্যটি গ্রিস।

২০০৬ সালের বিশ্বকাপ শুরুর আগে ডাচ ব্যাংক এবিএন-আমরো ‘সকারনোমিকস–২০০৬’ নামে একটি নতুন ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। ২০০৬ বিশ্বকাপের আসর বসেছিল জার্মানিতে। তবে এবিএন-আমরোর পর্যবেক্ষণ ছিল, বিশ্বকাপ ইতালির ঘরে গেলে সেটাই হবে অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে লাভজনক। দেশটিতে তখনো তীব্র অর্থনৈতিক সংকট। বিশ্বকাপ জিতলে ইতালির ভোক্তা ও উৎপাদকেরা আস্থা ফিরে পাবেন, তাঁরা ব্যয় বাড়াবেন, এতে উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। এমনকি বিশ্বকাপ ইতালির ভাবমূর্তিও বাড়াবে, যা রপ্তানির জন্যও ভালো। সেবার ইতালি কিন্তু সেই চরম অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও বিশ্বকাপ জয় করে নেয়, যা দেশটির অর্থনীতির জন্য ভালো ফল নিয়ে এসেছিল।

ইউরোর বড় প্রভাব আছে অর্থনীতিতে।
ছবি: এএফপি

ফুটবলের অর্থনীতি

অর্থনীতির সঙ্গে ফুটবলের একটা সম্পর্ক আছে। আর এই দুইয়ে মিলে হয় সকারনোমিকস। অর্থনীতিবিদেরা বলে থাকেন, ফুটবলের একটি বড় ধরনের অর্থনৈতিক প্রভাব থাকে অর্থনীতিতে। যেকোনো বড় ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজনেই প্রভাব পড়ে একটি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে, শেয়ারবাজারে, আর্থিক খাতে, দৈনন্দিন কেনাবেচায়। আর যে দেশটি চ্যাম্পিয়ন হয়, সেই দেশের অর্থনীতি এগোয় তুলনামূলকভাবে দ্রুতগতিতে।

এবিএন–আমরোর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বিজয়ী দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গড়ে দশমিক ৭ শতাংশ হারে বাড়ে আর পরাজিত দেশের প্রবৃদ্ধি কমে দশমিক ৩ শতাংশ হারে। ১৯৭০ সালের পর থেকে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা গেছে মাত্র দুবার। যেমন ১৯৭৪ সালে জার্মানি এবং ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ জিতলেও তাদের অর্থনীতি নিম্নমুখী হয়েছিল। এর মধ্যে আর্জেন্টিনায় দেখা দেয় বড় ধরনের মন্দা। তখন অবশ্য দেশটির রাজনীতিই ছিল সংকটে। দুবারই রানার্সআপ ছিল নেদারল্যান্ডস। ১৯৮৮ সালে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর আমস্টারডাম স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক বেড়েছিল ২৯ শতাংশ। বলা হয়, বিজয়ী দেশের শেয়ারবাজারের উত্থান ঘটে গড়ে ১০ শতাংশ হারে আর পরাজিতদের কমে ২৫ শতাংশ।

পুরোটাই আসলে মনস্তাত্বিক বিষয়। তবে অর্থনীতিবিদেরা একে বলছেন, ‘ফিল গুড ফ্যাক্টর’। কারণ, যে দেশটি জয়ী হয়, সে দেশের ভোক্তারা খুশি থাকেন, বেশি ব্যয় করেন, পানশালা আর সুপারমার্কেটগুলোতে ভিড় বাড়ে, বিভিন্ন ধরনের স্যুভেনির ব্যবসা জমে ওঠে, পর্যটক বাড়ে। এসবেরই প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে।

ইউরো জিতলে সেটি প্রভাব ফেলে সংশ্লিষ্ট দেশের শেয়ারবাজারে
ছবি: এএফপি

অর্থনীতি এবার ইংল্যান্ডের পক্ষে

সেই ইতালি আবারও একটা বড় টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলছে। অথচ এবার সকারনোমিকস ইতালির হয়ে কথা বলছে না, বরং ইংল্যান্ডের পক্ষে। যেমন বিশ্বের অন্যতম বড় বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস এরই মধ্যে বলে দিয়েছে ইউরো এবার ইংল্যান্ডের। যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে স্বেচ্ছায় সরে গেছে ইংল্যান্ড, সেই ইউরোপের ফুটবলের সবচেয়ে বড় শিরোপা জয় ইংল্যান্ডের অর্থনীতিকে কিছুটা চাঙা করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বলে রাখা ভালো, গোল্ডম্যান স্যাকস বিশেষ এক মডেল অনুসরণ করে শুরু থেকেই পূর্বাভাস দিয়ে আসছে। যদিও তাদের প্রথম পূর্বাভাস ছিল বেলজিয়াম হবে চ্যাম্পিয়ন। দেশটি বাদ পড়ার পরপরই তারা ইংল্যান্ডের পক্ষে দাঁড়িয়েছে।

গত বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড সেমিফাইনালে খেলে। তখন বলা হয়েছিল, তারা যদি ফাইনালে যেত, তাহলে ব্রিটিশরা অতিরিক্ত ২৫৮ কোটি পাউন্ড ব্যয় করত, যা অর্থনীতিকে আরেকটু এগিয়ে নিত। শুধু সেমিফাইনালে যেতে পেরেছিল বলেই ২০০৮ সালে ইংল্যান্ডের অর্থনীতিতে অতিরিক্ত ১০০ কোটি পাউন্ড ব্যয় বেড়েছিল। উল্টো দিকে, ২০০৬ বিশ্বকাপে যখন পর্তুগালের কাছে হেরে ইংল্যান্ড বিদায় নেয়, সেই মাসে তাদের বিক্রি কমেছিল দশমিক ৩ শতাংশ।

ইউরোপের ১১টি শহরে হয়েছে এবারের ইউরো
ছবি: এএফপি

ইংল্যান্ডের ক্লাবগুলো শহরভিত্তিক। আর খেলাগুলো সাধারণত শনি ও রোববার হয়। দেখা গেছে, দল জিতলে সোমবার সেই শহরের উৎপাদনশীলতা বেড়ে যায়। যেমন লেস্টার সিটি ২০১৫ সালে প্রিমিয়ার লিগ জিতলে শহরটির অর্থনীতি চাঙা হয়েছিল, শহরের অর্থনীতিতে ১৪ কোটি পাউন্ড অতিরিক্ত যুক্ত হয়, আড়াই হাজার নতুন কর্মসংস্থানও তৈরি হয়।

এবার কী হবে? বিভিন্ন ব্রিটিশ গবেষণা সংস্থা ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, শুধু ইংল্যান্ডেই এবার খেলার টিকিট বিক্রি হবে ৩ কোটি ৭০ লাখ পাউন্ডের। আর খেলা দেখতে বসে খাওয়া বাবদ গড়ে তাঁরা খরচ করবেন ১০ পাউন্ড। এর বাইরে পাবের ভিড় তো রয়েছেই। বিজয়োৎসব করতে পাবে যাওয়া তাঁদের রীতি। বলা হচ্ছে, এবার কেবল পাবেই বিক্রি হবে ৭২ কোটি পাউন্ড।

ফুটবলের ইতিহাসে ইংল্যান্ডের একমাত্র সাফল্য ১৯৬৬ বিশ্বকাপ জয়। দেশটি কখনোই ইউরো জেতেনি। এবার জিতে গেলে ব্রিটিশদের উৎসব ও উচ্ছ্বাস কোন মাত্রায় যাবে, বলা মুশকিল। বড় টুর্নোমেন্ট জিতলে ইতালি কী করে সবার জানা, ইংল্যান্ড কী করে সেটা আসলে ৫৫ বছর ধরে কেউ জানেন না। সম্ভবত এবার সেটা দেখতেই সবাই ইংল্যান্ডের পক্ষে বাজি ধরছে।

তবে খেলার মাঠ আর অর্থনীতির সূচক সম্পূর্ণ আলাদা। আসল খেলা হবে ওয়েম্বলির মাঠেই। সেখানেই ঠিক হবে কাপ ঘরে ফিরবে, না রোমে চলে যাবে।