বিদায় ‘সম্রাট’ বেকেনবাওয়ার
গ্যারি লিনেকার বলেছিলেন, ফুটবল এমন একটা খেলা, যেখানে ২২ জন একটা বলের পেছনে দৌড়ায়, কিন্তু দিন শেষে জার্মানি জেতে। লিনেকারের কথাটা একটু ঘুরিয়ে এখন বলা যায়, ফুটবল এমন বৈশ্বিক খেলা, যেখানে একজন ‘সম্রাট’ ছিলেন এবং গতকাল রাতে তাঁর মহাপ্রস্থানের পর...। বাকিটা একটু অন্যভাবে বলা উচিত।
লিনেকার যে সময় এই মন্তব্য করেছিলেন (১৯৯০ বিশ্বকাপ ফাইনাল), জার্মানি তখন অজেয়। হারের আগে হার না–মানা এক দল। আর সেই মানসিকতা যিনি রোপণ করেছিলেন, তিনিই সেই সম্রাট, তিনিই সেই নক্ষত্র। যেহেতু নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়, তাই মৃত্যুর কাছে তাঁর ‘হার’ শুধু জার্মানির নয়, হার এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেরই!
...আর কেউ জার্মান ফুটবলকে তাঁর মতো এতটা পূর্ণতা দেননি।
বেকেনবাওয়ার শুধু জার্মানির কিংবদন্তি নন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘এক্স’-এ ইংরেজ কিংবদন্তি লিনেকারের লেখা কথাগুলোতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার, ‘ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারের মৃত্যুর খবর শুনে খুব দুঃখ লাগছে। আমাদের খেলার অন্যতম সেরাদের একজন। কাইজার (সম্রাট) ছিলেন ফুটবলারদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর, যিনি (খেলার) লাবণ্য ও আকর্ষণ দিয়ে সবকিছুই জিতেছেন।’
ফুটবলে প্রায় সবকিছু জিতে নেওয়া সেই ‘কাইজার’, জার্মান ফুটবলের সোনার ছেলে বেকেনবাওয়ার আর নেই। তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে গতকাল (স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা ১২ মিনিট) বিবৃতিতে বলা হয়, ‘খুব দুঃখের সঙ্গে আমরা ঘোষণা করছি, বাবা ও স্বামী ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার গতকাল ঘুমের মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে মারা গেছেন। এ সময় পরিবার তাঁর পাশে ছিল।’ ৭৮ বছর বয়সে মৃত্যুর সময় চার সন্তান ও স্ত্রী হেইডিকে রেখে গেছেন বেকেনবাওয়ার।
বেকেনবাওয়ার জার্মান ফুটবলের কতখানি, সেটা উয়েফার ‘এক্স’ পোস্ট থেকে বুঝে নেওয়া যায়, ‘...আর কেউ জার্মান ফুটবলকে তাঁর মতো এতটা পূর্ণতা দেননি।’
জার্মানির শেষ সম্রাটের প্রসঙ্গে সবাই ইতিহাস ধরে দ্বিতীয় উইলহেমের নামই বলবেন। কিন্তু জার্মান ফুটবল এর কোনো সমর্থককে প্রশ্নটি করলে উত্তর আসবে, কে আবার বেকেনবাওয়ার!
খেলোয়াড়, কোচ এবং অধিনায়ক হিসেবে তাঁর অবদান পেলে-ম্যারাডোনার মতোই এক পাল্লায় ওজন করা হয়। আশি ও নব্বই দশকে বাংলাদেশের ফুটবলমোদীদের মধ্যে পেলে ও ম্যারাডোনার পাশাপাশি তাঁর নামটাই উচ্চারিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি।
খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে পৃথিবীতে যে তিনজন ব্যক্তি বিশ্বকাপ জিতেছেন, বেকেনবাওয়ার তাঁদের একজন। দিদিয়ের দেশম ও মারিও জাগালো বাকি দুই। শুধু দেশম ও বেকেনবাওয়ারই অধিনায়ক হিসেবে জিতেছেন বিশ্বকাপ। শুধু কি তা–ই, ইউরোপের ক্লাব ফুটবলে সত্তর দশকে বায়ার্ন মিউনিখও সেরা হয়ে উঠেছিল বেকেনবাওয়ারের স্পর্শধন্য হয়ে। টানা তিনবার করে ইউরোপিয়ান কাপ (চ্যাম্পিয়নস লিগ) ও বুন্দেসলিগা জয়ের পাশাপাশি দুবার ইউরোপের বর্ষসেরাও ‘কাইজার’।
সম্রাটদের চলনে-বলনে যে আভিজাত্য, বেকেনবাওয়ারের খেলায় তা অনূদিত হতো। জার্মানির শেষ সম্রাটের প্রসঙ্গে সবাই ইতিহাস ধরে দ্বিতীয় উইলহেমের নামই বলবেন। কিন্তু জার্মান ফুটবলের কোনো সমর্থককে প্রশ্নটি করলে উত্তর আসবে, কে আবার বেকেনবাওয়ার! সেই তিনিও চলে গেলেন ঘুমের ঘোরে কাউকে কিছু টের না পাইয়ে, হয়তো মারিও জাগালোর ডাক পড়েছিল। গত শুক্রবার জাগালোও তো পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। প্রথম খেলোয়াড় ও কোচ হিসেবে বিশ্বকাপজয়ীর সেখানে হয়তো একা একা ভালো লাগছিল না। সেজন্যই বুঝি ‘দ্বিতীয়’কে ডেকে নিলেন!
বেকেনবাওয়ারও সেই ডাকে সাড়া দেওয়ায় একটি বৃত্ত পূরণ হলো—ফুটবল ইতিহাসে গুণমানে ও সাফল্যে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি কুড়োনো ‘ত্রিরত্নে’র কেউই আর বিশ্বসংসারে রইলেন না। ২০২০ সালের নভেম্বরে গেলেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা, গত বছর ডিসেম্বরে পেলে, আর এ বছরের শুরুতে বেকেনবাওয়ার। অন্যলোকের দুর্দান্ত আক্রমণাত্মক জুটি!
চাইলে ববি চার্লটনকেও জুড়ে নিতে পারেন। চার্লটন তো গত অক্টোবর থেকেই পেলে-ম্যারাডোনাদের সঙ্গী। একটা প্রশ্ন কিন্তু উঠতেই পারে। বেকেনবাওয়ার তো ডিফেন্ডার, তাহলে আক্রমণভাগে...? কাইজারের শ্রেষ্ঠত্বও লুকিয়ে এর উত্তরে।
জার্মানির সম্রাট দ্বিতীয় লুডভিগের মতোদেখতে হওয়ায় এক সাময়িকী বেকেনবাওয়ারের নাম দিয়েছিল ‘কাইজার।’ বল পায়ে বেকেনবাওয়ার যেন তার সেরা অনুবাদ! রেশমি সব স্পর্শ এবং দাপুটে। খেলাটাকে বুঝে নিতেন দাবার ছকের মতো। বল নিয়ন্ত্রণে আভিজাত্যের চূড়ান্ত প্রকাশ। অনেকে বলেন, ফুটবলের ‘সুইপার’ বা ‘লিবেরো’ পজিশন তাঁর-ই মস্তিষ্কপ্রসূত।
তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির অধিনায়ক হিসেবে ১৯৭৪ বিশ্বকাপজয়ী বেকেনবাওয়ার কোচের ভূমিকায় ১৬ বছর পর ইতালির মাটিতে (১৯৯০) জিতেছেন বিশ্বকাপ। ১৯৭৭ সালে জাতীয় দল ছাড়ার আগে খেলেছেন ১০৩ ম্যাচ। ১৪ গোল দিয়ে তাঁকে বিচার করলে ভুল হবে। বেকেনবাওয়ার সর্বকালের অন্যতম সেরার সংক্ষিপ্ত তালিকায়ও অনেক উঁচুতে থাকবেন সেটি স্পষ্ট ১৯৯০ বিশ্বকাপে পশ্চিম জার্মানির অধিনায়ক লোথার ম্যাথিউসের কথায়, ‘এই আঘাত অনেক গভীর। জানতাম ফ্রাঞ্জের শরীর তেমন ভালো নেই। তার মৃত্যু ফুটবল ও জার্মানির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। তিনি ছিলেন অন্যতম সেরা কোচ ও খেলোয়াড় এবং সেটি মাঠের বাইরেও...একজন ভালো বন্ধু আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তাকে মিস করব, আমরা সবাই মিস করব।’
জাতীয় দলে অভিষেক ২০ বছর বয়সে, সুইডেনের বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে। ১৯৮৪ সালে পেশাদার ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন। তার আগে পেলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলও মাতিয়েছেন নিউইয়র্ক কসমসের হয়ে। কোচিংয়ের অভিজ্ঞতা ছিল না, তবু সে বছরই পশ্চিম জার্মানির কোচ হন এবং দুই বছর পরই বিশ্বকাপের ফাইনালে। সেবার হারলেও চার বছর পর নাম লেখালেন কোচ ও খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপজয়ী অমরদের তালিকায়।
বেকেনবাওয়ারের তাই শুধু দেহত্যাগই ঘটল। ফুটবল যত দিন, বেকেনবাওয়ারও তত দিন—সেটি বুঝে নিতে পারেন অ্যাডিডাস ফুটবলের এক্স পোস্টে, ‘বেকেনবাওয়ার ছিলেন ফুটবলের একজন কবি। এই সুন্দর খেলায় নিপুণ শিল্পকর্মের সঙ্গে রোমান্টিক সব সুতা যোগ করেছেন।’
সেসব সুতার বুনিয়াদ না থাকলে তো ফুটবলই থাকবে না। বেকেনবাওয়াররা তাই অমর। ‘সম্রাট’কে বিদায় জানানো তো এক অর্থে ধৃষ্টতাই!