জার্মানির বিদায়ে কেন অবাক হওয়ার কিছু নেই
গ্যারি লিনেকার বলেছিলেন কথাটা—‘ফুটবল এমন একটা খেলা, যেখানে ২২ জন একটা বলের পেছনে দৌড়ায়, কিন্তু দিন শেষে জেতে জার্মানি।’ কথাটা একটা সময় ফুটবলপ্রেমীদের বিশ্বাসেই পরিণত হয়েছিল। তাঁদের কয়েকটি প্রজন্ম যে জার্মানিকে কদাচিৎ হারতে দেখেছেন। কঠিন পরিস্থিতিতে জিতে বেরিয়ে যাওয়াটাকে অভ্যাসেই পরিণত করেছিল জার্মানি।
ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, জার্ড মুলার, কার্ল হেইঞ্জ রুমেনিগে, লোথার ম্যাথাউস, ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যান, রুডি ফোলার, অলিভার বিয়েরহফ, মাইকেল বালাক, ফিলিপ লাম, বাস্তেইন শোয়েনস্টাইগার—জার্মান ফুটবলে বিজয়ী সব মুখ। চারটি বিশ্বকাপ জেতা এই দলটা–ই এবারসহ টানা দুইবার বিদায় নিল বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকে! জার্মানির বিদায় ফুটবলপ্রেমীদের অবাক করেছে সন্দেহ নেই। কিন্তু সত্যিই কি জার্মানির এই বিদায় অবাক করার মতো? বাস্তবতা কিন্তু বলছে অন্য কথা।
বিশ্লেষকদের মতে, জার্মানির এবারের বিদায় সত্যিকার অর্থেই হয়তো অনেককে অবাক না–ও করতে পারে।
এবারের বিশ্বকাপে জার্মান দলের রক্ষণভাগ কী ভালো ছিল? একটি হিসাব মেলানো যাক। গত বছর বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে লিখটেনস্টাইনের বিপক্ষে ৯–০ গোলে জেতার পর সবশেষ ১০টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে জার্মানি ১৫ গোল হজম করেছে। শেষ তিনটি ম্যাচে তারা গোল খেয়েছে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে। ‘ক্লিনশিট’ রাখতে পেরেছে ইসরায়েল ও ওমানের বিপক্ষে।
রয়টার্স জানাচ্ছে, গবেষণা প্রতিষ্ঠান নিয়েলসেন গ্র্যাসেনতে কিছুদিন আগেই বিশ্বকাপ থেকে জার্মানির বিদায়ের শঙ্কা ৪১ শতাংশ বলে জানিয়েছিল। বিশ্বকাপের প্রতিটি ম্যাচেই জার্মানির রক্ষণভাগকে নড়বড়ে মনে হয়েছে। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে জাপানের বিপক্ষে সেটি প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল। কাল কোস্টারিকার বিপক্ষেও সেটি দেখা গেল। নিকলাস সুলে কোস্টারিকার একটি ক্রস ক্লিয়ার করতে গিয়ে বড় বিপদ ডেকে এনেছিলেন।
গোলবারে অভিজ্ঞ ও বিশ্বের সেরা গোলকিপার ম্যানুয়েল নয়্যার ছিলেন। তিনি বারবার দলকে বিপদ থেকে বাঁচিয়েছেন। কাল কোস্টারিকার বিপক্ষে ম্যাচের প্রথমার্ধে কেশের ফুয়েরের গোলের কাছ থেকে মারা একটি শট ফিস্ট করে বারের ওপর দিয়ে বের করে দেন। বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচেই নয়্যার অনেকবারই ত্রাণকর্তা হয়েছেন জার্মান রক্ষণের বিভিন্ন ভুলের মুখে।
কোস্টারিকার বিপক্ষে ম্যাচে জার্মানির বড় ব্যবধানে জেতার সুযোগ ছিল। স্পেন তো এই দলকেই ৭–০ গোলে হারিয়েছিল। কোচ হানসি ফ্লিক ম্যাচের আগেই বড় ব্যবধানে জেতার বিকল্প নেই বলেই জানিয়েছিলেন। কাল কোস্টারিকার জালে ৪ গোল দিলেও জার্মানদের ডুবিয়েছে তাদের রক্ষণই।
প্রথমার্ধে সার্জ নাবরির গোলে এগিয়ে থাকলেও দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই জার্মানি গোল হজম করে। সেখানে নয়্যারের কিছুই করার ছিল না। কেন্দাল ওয়াস্তনের হেড ফিরিয়ে দিলেও ফিরতি বলে গোল করেন ইয়েলৎসিন তেহেদা। দ্বিতীয় গোলটিও প্রায় একই রকম। হুয়ান পাবলো ভারগাসের হেড নয়্যার ফেরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেও সেটি শেষ অবধি তাঁর হাতে লেগে গোলে ঢুকে যায়।
এ তো গেল রক্ষণের কথা।
এবারের জার্মান দল একজন স্কোরারের অভাব দারুণভাবে অনুভব করেছে। মিরোস্লাভ ক্লোসা ও মারিও গোমেজের পর সে ধরনের গোল স্কোরার জার্মানি দলে আর দেখা যাচ্ছে না। ২০১৮ সালে আগাগোড়া সেন্টার ফরোয়ার্ড না খেলিয়ে ‘ফলস নাইন’ তত্ত্ব চালু করা হয় জার্মান দলে। কিন্তু সেবারই প্রথমবারের মতো প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল জার্মানিকে। হারতে হয়েছিল মেক্সিকো ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে। ১৯৩৮ সালের পর সেটিই ছিল গ্রুপ পর্ব থেকে জার্মানির প্রথম বিদায়।
কাতার বিশ্বকাপে ফ্লিক জার্মানির আক্রমণভাগও ব্যর্থ। জাপানের বিপক্ষে প্রচুর গোলের সুযোগ তৈরি করলেও যোগ্য গোলস্কোরের অভাবটা সেদিন প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল। যদিও এই ফুলক্রগ স্পেনের বিপক্ষে সমতাসূচক গোল করে জার্মানির মুখ বাঁচিয়েছিলেন দ্বিতীয় ম্যাচে।
কিন্তু কালকের ম্যাচে প্রথম একাদশে ছিলেন না ভেরডার ব্রেমেনের এই স্ট্রাইকার। অথচ ফ্লিক জানতেন কোস্টারিকার বিপক্ষে ম্যাচটিতে গোল করতে হবে যতটা সম্ভব বেশি। স্পেনের বিপক্ষে গোল করা ফরোয়ার্ডকে তিনি কেন শুরু থেকে খেলালেন না, সেটি এক রহস্য। ব্যাপারটা সবাইকে অবাক করেছে নিশ্চিতভাবেই। সার্জ নাব্রি, জামাল মুসিয়ালা ও টমাস মুলার কাল প্রচুর গোলের সুযোগ নষ্ট করেছেন। দুর্ভাগ্যও ছিল। বিরতির পর মুসিয়ালা ও আন্টনিও রুডিগারের শট কোস্টারিকার পোস্টে লেগে প্রতিহত হয়।
ফুলক্রগকে মাঠে নামানোর পর জার্মানির আক্রমণের ধার অনেক বেড়েছিল। কাইল হাভার্টজের দ্বিতীয় গোলটিতে সহায়তা ফুলক্রগেরই। জার্মানির চতুর্থ গোলটি তাঁরই। কিন্তু ততক্ষণে জার্মানদের যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়েই গেছে।