স্বপ্ন পূরণের সহযাত্রী পেয়ে গেছেন মেসি
কালচিন শহরের সেই ছোট্ট ছেলেটার স্বপ্ন ছিল, সে লিওনেল মেসির সঙ্গে একদিন দেখা করবে, একটা ছবি তুলবে, অটোগ্রাফ নেবে।
১২ বছর বয়সেই ছেলেটার সেই স্বপ্ন সত্যি হয়েছিল। মেসির সঙ্গে ছেলেটার একটি ছবি পরশু রাত থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ১০ বছর আগে যখন সেই ছবি তোলা হয়, তত দিনে অবশ্য ছেলেটার স্বপ্ন আরও বড় হয়ে গেছে। আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে মেসির সঙ্গে খেলার স্বপ্নও দেখতে শুরু করেছে সে।
হুলিয়ান আলভারেজের এই স্বপ্নটাও অপূর্ণ থাকেনি। গত বছর জুনেই বিশ্বকাপ বাছাইয়ের এক ম্যাচে বদলি নেমে মেসির সঙ্গে খেলার স্বপ্নপূরণ হয়ে যায় তাঁর। আর্জেন্টিনা দলে গত এক-দেড় দশকে এমন কত খেলোয়াড়ই তো এসেছেন, আবার চলেও গেছেন। মেসির সঙ্গে খেলেছেন, এটাই হয়তো তাঁদের কারও কারও জীবনে বলার মতো সবচেয়ে দারুণ গল্প। কিন্তু আলভারেজ নিজের গল্পটা শুধু ওইটুকুতেই শেষ করতে চাননি।
স্কুল ছুটির পর বড় ভাইদের সঙ্গে মাঠে খেলতে যেতেন পাঁচ-ছয় বছরের যে ছেলেটা, ফুটবলের সঙ্গে তাঁর সখ্য আরও ছোটবেলা থেকে। বল পায়ে রেখে এমনভাবে দৌড়াতেন আলভারেজ, মনে হতো দুই পা নয়, মাকড়সার মতো আট পা দিয়ে খেলছেন। বল ছুটতই না! এই দেখেই বড় ভাই আলভারেজকে ডাকতে শুরু করেন ‘এল আরানিতা’ নামে, যার মানে ‘ছোট মাকড়সা’। এমনও হয়েছে, শনি-রোববার তাঁর বড় ভাইয়েরা বিকেলে যে মাঠে খেলতে যেতেন, সেখানে ম্যাচ পরিচালনা করতে আসা রেফারিরা জিজ্ঞেস করতেন, ‘আজ কি ওই ছেলেটা খেলবে? ওই ছোট মাকড়সাটা?’
সেই ছেলেটা দিনে দিনে বড় হয়েছেন, নামটাও বদলে ‘এল আরানিতা’ থেকে ‘এল আরানা’ হয়েছে। ‘ছোট মাকড়সা’ নয়, শুধুই ‘মাকড়সা’। নিজের শহরের ক্লাব আতলেতিকো কালচিনে খেলতে খেলতেই ডাক পেয়েছে আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় দুই ক্লাবের একটি রিভারপ্লেট থেকে। ২০১৬ সালে রিভারপ্লেটের বয়সভিত্তিক দলে যোগ দেওয়া আলভারেজ মূল দলে আসেন ২০১৮ সালে। এর সাত বছর আগেই অবশ্য স্পেনে গিয়ে রিয়াল মাদ্রিদে ট্রায়াল দিয়ে টিকে যান আলভারেজ। কিন্তু তখন ফিফার আইন ছিল ১৬ বছরের নিচে কোনো বিদেশি ফুটবলারের সঙ্গে চুক্তি করা যাবে না। রিয়ালেও তাই যাওয়া হয়নি আলভারেজের।
রিয়াল মাদ্রিদ যাঁকে পায়নি, তাঁকে শেষ পর্যন্ত পেয়েছে ম্যানচেস্টার সিটি। এই বছর জুলাইয়ে সিটির হয়ে খেলতে ইউরোপে পাড়ি জমান আলভারেজ। তত দিনে আলভারেজ আর্জেন্টিনার নতুন সম্ভাবনাময় হিসেবে খ্যাতি কুড়িয়েছেন, কোপা লিবার্তাদোরেসে রিভারপ্লেটের হয়ে এক ম্যাচে ৬ গোল করে সাড়া ফেলেছেন, অভিষেক হয়ে গেছে জাতীয় দলেও।
অনেক দিন ধরেই আর্জেন্টিনা এমন একজনকে খুঁজছিল, যিনি মেসি বা অন্য কারও বানিয়ে দেওয়া গোলগুলো ঠিকঠাক জালে পাঠাবেন। গঞ্জালো হিগুয়েইন হবেন না। এই বিশ্বকাপে সেই দায়িত্বটা প্রথমে পেয়েছিলেন লাওতারো মার্তিনেজ। কিন্তু সৌদি আরবের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে তিনি এত মিস করলেন যে বোঝা গেল, লাওতারোকে দিয়ে হবে না। হুলিয়ান আলভারেজ মঞ্চে এলেন সেই সুযোগে। নিজে গোল করেন, আবার করাতেও পারেন। নিখাদ স্ট্রাইকার বা উইঙ্গার, আক্রমণভাগের যেকোনো জায়গাতেই খেলতে পারেন।
গ্রুপে পোল্যান্ডের বিপক্ষে যে ম্যাচে জয় ছাড়া অন্য কিছু ভাবার সুযোগ ছিল না আর্জেন্টিনার, ওই ম্যাচে প্রথম গোল পান আলভারেজ। শেষ ষোলোতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পান দ্বিতীয়টা। প্রত্যাশা বেড়ে যায় এরপরই, হয়ে যান স্ট্রাইকার হিসেবে একাদশে আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনির প্রথম পছন্দ।
গোলের জন্য কখন কোথায় থাকতে হবে, সেটা তো জানেনই, মেসির অবিশ্বাস্য পাস থেকে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে নিজের দ্বিতীয় গোলটা করে সেটার প্রমাণও দিয়েছেন। তবে তার আগে ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে ম্যারাডোনার সেই ‘ওয়ানম্যান শো’ মনে করিয়ে দেওয়া প্রথম গোলটা করে বুঝিয়েছেন তিনি একাই যথেষ্ট যেকোনো রক্ষণ ওলট-পালট করে দিতে।
যে কারণে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচসেরার পুরস্কার পাওয়ার পর মেসিও বলেছেন, এই পুরস্কারটা আসলে আলভারেজের প্রাপ্য। এমন দিনের অপেক্ষাতেই তো ছিলেন আলভারেজ।
বিশ্বকাপে আর একটা ম্যাচ বাকি আর্জেন্টিনার। মেসিরও। পুরো ক্যারিয়ারে অজস্র ট্রফি জিতেছেন আর্জেন্টাইন জাদুকর, অধরা শুধু এই ট্রফিটাই। মেসি ছুটছেন তাঁর সেই স্বপ্নের পেছনে।
একসময় মেসির সঙ্গে একটা ছবি তুলতে পারাই ছিল যাঁর স্বপ্ন, এখন সেই ছেলেটাই মেসির স্বপ্নপূরণের সহযাত্রী।