একরোখা ‘কবি’ আমোরিমে কি ফিরবে ইউনাইটেডের ভাগ্য
ওমর বেরাদা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের নতুন প্রধান নির্বাহী। গত সোমবার স্থানীয় সময় সকালবেলা এরিক টেন হাগকে কোচ পদ থেকে ছাঁটাই করে তিনি লিসবনের বিমান ধরেন। সেখানে পর্তুগিজ ক্লাব স্পোর্টিং লিসবনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বেরাদা কোনো রাখঢাক রাখেননি। লিসবনের কর্মকর্তাদের সরাসরি তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য জানান। স্পোর্টিং লিসবনের কোচ রুবেন আমোরিমকে চায় ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এবং সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
গল্পের বাকিটা আপনার জানা। আমোরিম ইউনাইটেডের কোচ হতে চাইলেও ইংলিশ ক্লাবটিকে অনুরোধ করেছিলেন, মৌসুমের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করা যায় কি না। কিন্তু ইউনাইটেড একমুহূর্ত দেরিও চায়নি। ‘হয় এখন, নয় তো কখনোই না’—বলে দিয়েছিল আমোরিমকে। এরপর ৩৯ বছর বয়সী এই পর্তুগিজ আর অন্য কিছু ভাবেননি। পর্তুগালের আর্থিক নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান সিএমভিএমকে স্পোর্টিং জানিয়েছে, ১ কোটি ১০ লাখ ইউরোয় আমোরিমকে নিজেদের করে নিয়েছে ইউনাইটেড।
বাগ্পটু এবং শব্দের ওপর দারুণ দখল থাকায় আমোরিমকে পর্তুগাল জাতীয় দলে ‘কবি’ বলে ডাকতেন রোনালদো। কবিরা সাধারণত একটু উদাসীন হলেও পর্তুগিজ সাংবাদিক মার্কাস আলভেজের ভাষায়, ফুটবলের এই ‘কবি’ তাঁর অধীনে ‘অপেশাদার আচরণ সহ্য করেন না।’
তবে অদৃশ্য খরচ আছে আরও। আমোরিমের বেতন, স্পোর্টিংয়ে তাঁর কোচিং স্টাফ থেকে দু-একজনকে আনার খরচ ও সেসব সহকারীর বেতন এবং টেন হাগের মেয়াদ পূর্তির আগেই তাঁকে ছাঁটাই করায় দেওয়া জরিমানার বেশ বড় অঙ্কের অর্থ পরিশোধ এখনো বাকি ইউনাইটেডের। এক অর্থে এসব তো এক আমোরিমকে উড়িয়ে আনার মোট খরচই। প্রশ্ন হলো, ইউনাইটেডের ফুটবল অপারেশনসের দায়িত্বে থাকা ইনেওস গ্রুপ এর আগে ক্লাবের খরচ কমাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও আমোরিমের মধ্যে কী এমন দেখেছে, যে তাঁকে উড়িয়ে আনতে এতটা পাগলপারা? কোচদের জগৎ বিচারে এত অল্প বয়সী আমোরিমের মধ্যে কী এমন দেখেছে ইউনাইটেড?
কিছু খুচরো গল্প শুনুন। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর বয়স ৩৯ বছর, আমোরিমেরও তা–ই। দুজনে একসময় পর্তুগাল জাতীয় দলে সতীর্থ ছিলেন। বাগ্পটু এবং শব্দের ওপর দারুণ দখল থাকায় আমোরিমকে পর্তুগাল জাতীয় দলে ‘কবি’ বলে ডাকতেন রোনালদো। কবিরা সাধারণত একটু উদাসীন হলেও পর্তুগিজ সাংবাদিক মার্কাস আলভেজের ভাষায়, ফুটবলের এই ‘কবি’ তাঁর অধীনে ‘অপেশাদার আচরণ সহ্য করেন না।’ ঘাড়ের রগও সম্ভবত দু-একটি এদিক-সেদিক। মানে, নিজে যা ভালো বোঝেন, সেটার ওপরই আস্থা রাখেন। এ নিয়েও মজার এক গল্প আছে।
২০১৭ সালে বুট তুলে রাখার পরের বছর পর্তুগালে তৃতীয় বিভাগের দল কাসা পিয়ার কোচের দায়িত্ব নেন আমোরিম। প্রথম দুই ম্যাচই হারায় আমোরিমের আত্মসম্মানে আঘাত লাগে। ঘোষণা দেন, তৃতীয় ম্যাচটি হারলে কোচিংয়ের দায়িত্ব ছাড়বেন। সেই তৃতীয় ম্যাচে সাহসী এক পদক্ষেপও নেন আমোরিম। রক্ষণভাগে খেলান তিনজন। ওই ম্যাচে ৪-০ গোলে জয়সহ টানা ৮ ম্যাচ জেতে কাসা পিয়া। তবে আসল পরিবর্তনটা হয় আমোরিমের মাথায়।
তিন ধরে বলেছি, আমি (স্পোর্টিংয়ে) মৌসুমের শেষ পর্যন্ত থাকতে চাই। কিন্তু আমাকে বলা হয়েছে, এটা সম্ভব নয়। এখন না হলে আর কখনোই না। ম্যানচেস্টার বিকল্প খোঁজা শুরু করবে। মনস্থির করে সিদ্ধান্ত নিতে তাই তিন দিন সময় পেয়েছি, যেটা আমার জীবন আমূল পাল্টে দিল।রুবেন আমোরিম, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কোচের দায়িত্ব নেওয়ার পর
ইউরোপিয়ান ফুটবলবিশেষজ্ঞ গিয়েম বালাগের ভাষায়, ‘সে ঘোষণা দিয়েছিল তৃতীয় ম্যাচ হারলে দায়িত্ব ছেড়ে দেবে। (তৃতীয়) পরের ম্যাচে ছক পাল্টে প্রথমবারের মতো ব্যাক থ্রি (রক্ষণে তিনজন) খেলায়। কৌশলটি কাজে লাগে এবং তার পর থেকে সে অপরাজিত ছিল ক্লাবে। যে ধরনের ফুটবল সে খেলাতে চায়, তা খুঁজে পাওয়ার আস্থাও জন্মায় তার নিজের মধ্যে।’
সেই আস্থাটা হলো, ব্যাকলাইনে তিনজন খেলানোর ওপর বদ্ধমূল বিশ্বাস জন্ম নেয় তাঁর। একটা উদাহরণ দেওয়া যায়। অপ্টার হিসাব অনুযায়ী, পর্তুগিজ লিগ ও চ্যাম্পিয়নস লিগ মিলিয়ে মোট ১৪৩ ম্যাচে ডাগআউটে দাঁড়িয়েছেন আমোরিম। এর মধ্যে ব্যাকলাইনে তিনজন খেলিয়েছেন ১৪৩ ম্যাচেই!
কাসা পিয়ায় ফেরা যাক। সেখানে কোচের দায়িত্ব নিলেও ওই পর্যায়ের ম্যাচের জন্য পর্তুগিজ ফুটবল ফেডারেশন অনুমোদিত কোচিংয়ের কাগজপত্র তাঁর ছিল না। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ডাগআউটে দাঁড়িয়ে একটি ম্যাচে কোচিং করানোয় তাঁকে এক বছরের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় এবং কাসা পিয়ার ৬ পয়েন্ট কেটেও রাখা হয়। পরে নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ কমালেও ছয় মাসের মধ্যে ক্লাবটির কোচের দায়িত্ব ছেড়ে দেন আমোরিম। কাসা পিয়ার সেবার শিরোপা জয়ও তিনি দেখতে পারেননি। কিন্তু পেছনে ফিরে তাকানোর সময় তাঁর ছিল না।
এক কোটি ইউরোয় স্পোর্টিং কী পেয়েছে শুনুন—আমোরিম আসার আগে ১৮ বছর লিগ জেতেনি স্পোর্টিং। তাঁকে কোচ বানানোর পর স্পোর্টিং পর্তুগালের শীর্ষ লিগ জিতেছে দুবার। এই মৌসুমেও পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে স্পোর্টিং। এবার বলুন তো, ইউনাইটেডের মরিয়া হয়ে উঠবে না কেন?
আমোরিম জোসে মরিনিওর গুণমুগ্ধ। ফেনারবাচের বর্তমান কোচকে তাঁর ‘মেন্টর’ও বলতে পারেন। ২০১৮ সালে মরিনিও ইউনাইটেডের কোচ থাকতে তাঁর অধীনে হাই পারফরম্যান্স ফুটবলে কোচিং কোর্স করেন। কিছু সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ইউনাইটেডে এসে তখন সাত দিন মরিনিওর সংস্পর্শে ছিলেন আমোরিম। কী ভাগ্য, এর ছয় বছর পরই তিনি ইউনাইটেডে মরিনিওর জায়গা নিতে যাচ্ছেন! পর্তুগিজ ক্লাব বেলেনেনেস ও বেনফিকায় খেলার সময় কোচ হোর্হে জেসুস দ্বারাও প্রভাবিত হন আমোরিম। সে যাহোক, আমোরিমের কাসা পিয়া ছাড়ার পরের গল্পটা আরও রোমাঞ্চকর।
২০১৯ সালে পর্তুগিজ ক্লাব ব্রাগার রিজার্ভ দলের দায়িত্ব নিয়ে ৮ ম্যাচের ৭টিতে জেতেন এবং তিন মাস পরই তাঁকে মূল দলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৩ ম্যাচে ১০ জয়—এই ছিল ব্রাগার মূল দলের হয়ে তাঁর পারফরম্যান্সের খতিয়ান। এর মধ্যে বেনফিকার মাঠে গত ৬৫ বছরের মধ্যে ব্রাগা প্রথম জয় পাওয়ার পর আমোরিমের ওপর নজর পড়ে ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোর। ব্রাগার মূল দলের কোচের দায়িত্ব নেওয়ার সময় প্রিমেরা লিগে অষ্টম অবস্থানে ছিল ক্লাবটি। আমোরিম তাদের তৃতীয় স্থানে তুলে মৌসুম শেষ করেন। জিতেছেন পর্তুগিজ কাপও। আর বেনফিকার বিপক্ষে জয়ের পাশাপাশি স্পোর্টিং, পোর্তোর বিপক্ষেও জেতেন আমোরিম, স্পোর্টিংয়ের বিপক্ষে জেতেন দুটি ম্যাচ। এরপরই আমোরিমের ওপর নজর পড়ে পর্তুগালের অন্যতম ধনী ক্লাবটির।
২০২০ সালের মার্চে এক কোটি ইউরোয় তারা দলে ভেড়ায় আমোরিমকে। এই এক কোটি ইউরোয় স্পোর্টিং কী পেয়েছে শুনুন—আমোরিম আসার আগে ১৮ বছর লিগ জেতেনি স্পোর্টিং। তাঁকে কোচ বানানোর পর স্পোর্টিং পর্তুগালের শীর্ষ লিগ জিতেছে দুবার। এই মৌসুমেও পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে স্পোর্টিং। এবার বলুন তো, ইউনাইটেডের মরিয়া হয়ে উঠবে না কেন?
কৌশলগত দিক থেকে আমোরিম এই মুহূর্তে ইউরোপে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত কোচদের একজন। একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। গত মৌসুমে লিভারপুল, বার্সেলোনা, বায়ার্ন মিউনিখ ও ওয়েস্ট হামের কোচ পদে আমোরিমকে ঘিরে জোর গুঞ্জন শোনা গেছে। রক্ষণভাগে তিনজন খেলানোর নীতি অটল থাকার জন্যই নাকি আমোরিমের ভাগ্যে লিভারপুলের কোচ হওয়ার শিকে ছেঁড়েনি।
কারণ আছে আরও। ‘টোয়েন্টি ওয়ান ফার্স্ট গ্রুপ’ নামে খেলাধুলার একটি কনসালট্যান্সি ফার্ম আছে। জাতীয় দল ও ক্লাবগুলোর কোচ খোঁজায় সাহায্য করে এই প্রতিষ্ঠান। সে জন্য বিশ্বের বিভিন্ন জায়গার মোট ২৫ হাজার কোচের একটি বৈশ্বিক র্যাঙ্কিং চালু করেছে তারা। এই র্যাঙ্কিংয়ের মাধ্যমে কোচদের উন্নতি-অবনতির ব্যাপারটি বোঝা যায়। সেখানে শীর্ষ দশে ইয়ুর্গেন ক্লপ, আর্নে স্লট, জাবি আলোনসো, মিকেল আরতেতা ও পেপ গার্দিওলাদের রাজত্ব। কিন্তু এই মৌসুমে কোচদের সেই র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে কে জানেন? আমোরিম! এই প্রতিষ্ঠানের মতে, কৌশলে অতটা নমনীয় না হয়েও খেলোয়াড়দের মানের উন্নতি ঘটিয়েছেন আমোরিম, ক্লাবের পারফরম্যান্সের উন্নতি ঘটেছে পারিশ্রমিকের তুলনায়।
ইউনাইটেডে আমোরিমের চ্যালেঞ্জও ঠিক এখানেই। প্রিমিয়ার লিগ টেবিলে ১৪তম স্থানে ধুঁকছে ইংল্যান্ডের শীর্ষ লিগে সর্বোচ্চ ২০ বারের চ্যাম্পিয়নরা। এখান থেকে ক্লাবকে টেনে তুলতে হবে। কোথায়? ২০১৩ সালে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন অবসর নেওয়ার বছর সর্বশেষ লিগ জিতেছিল ইউনাইটেড। ক্লাবটিকে সেই চূড়ায় তুলতে হবে আমোরিমকে। ফার্গির প্রস্থানের পর আমোরিমের আগ পর্যন্ত স্থায়ী কোচ পদে পাঁচজন বদল করেও অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি ইউনাইটেড। অনেকের মতেই, ফার্গির পর ইউনাইটেডের কোচ পদে আমোরিমই সেরা নিয়োগ। কারণ?
কৌশলগত দিক থেকে আমোরিম এই মুহূর্তে ইউরোপে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত কোচদের একজন। একটি উদাহরণ দেওয়া যায়। গত মৌসুমে লিভারপুল, বার্সেলোনা, বায়ার্ন মিউনিখ ও ওয়েস্ট হামের কোচ পদে আমোরিমকে ঘিরে জোর গুঞ্জন শোনা গেছে। রক্ষণভাগে তিনজন খেলানোর নীতি অটল থাকার জন্যই নাকি আমোরিমের ভাগ্যে লিভারপুলের কোচ হওয়ার শিকে ছেঁড়েনি। ইউনাইটেডে তাঁর ভাগ্য খুলল নাকি তাঁকে পেয়ে ইউনাইটেডেরই ভাগ্য খুলল, সেটি সময় হলে বোঝা যাবে। তবে ২০১৪ সালে লুই ফন গালের অধীনে সর্বশেষ ব্যাকলাইনে তিনজন খেলানো ইউনাইটেডকে আমোরিমের কৌশলের সঙ্গে মানিয়েও নিতে হবে।
শুরুটা অবশ্য তেমন হলো না। ইউনাইটেডের ‘এখন, না হলে কখনোই নয়’ শর্তে আসতে হলো আমোরিমকে। বাকিটা শুনুন তাঁর মুখেই,‘তিন ধরে বলেছি, আমি (স্পোর্টিংয়ে) মৌসুমের শেষ পর্যন্ত থাকতে চাই। কিন্তু আমাকে বলা হয়েছে, এটা সম্ভব নয়। এখন না হলে আর কখনোই না। ম্যানচেস্টার বিকল্প খোঁজা শুরু করবে। মনস্থির করে সিদ্ধান্ত নিতে তাই তিন দিন সময় পেয়েছি, যেটা আমার জীবন আমূল পাল্টে দিল।’
রসিকতা করে কেউ কেউ বলতে পারেন, প্রতিশোধ নিতে আমোরিমের এখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে পাল্টে দেওয়ার পালা!