১৬ বছরের ইকুয়েডরিয়ান ফুটবলারকে কেন নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা দিচ্ছে চেলসি
লাতিন আমেরিকা থেকে তরুণ প্রতিভা খুঁজে বের করে নিয়ে আসা ইউরোপীয় ক্লাবগুলোর জন্য নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে ব্রাজিলিয়ান–আর্জেন্টাইনদের দিকেই বেশি চোখ থাকে ক্লাবগুলোর। তবে প্রতিভা খুঁজতে কলম্বিয়া, বলিভিয়া, ইকুয়েডরের মতো দেশগুলোর দিকেও চোখ থাকে তাদের।
গত আগস্টে ব্রিটিশ দলবদল ইতিহাসের রেকর্ড (১৩ কোটি ৩০ লাখ ইউরো বা প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা) গড়ে ইকুয়েডরিয়ান মিডফিল্ডার মইসেস কাইসেদোকে ব্রাইটনের কাছ থেকে কিনে নেয় চেলসি। তবে কাইসেদোর আগে ইকুয়েডরেরই আরেকজনকে ২ কোটি ইউরোয় (২৪০ কোটি টাকা) কিনে রেখেছে লন্ডনের ক্লাবটি।
সেই বিস্ময়বালকের নাম কেন্দ্রি পায়েজ, স্থানীয় লোকজন তাঁকে ইকুয়েডরের ‘নতুন রত্ন’ নামে ডাকেন। জাতীয় দলের সতীর্থ কাইসেদো ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হলেও পায়েজ একজন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। এ ছাড়া রাইট উইংয়ে খেলতেও পারদর্শী।
১৬ বছর বয়সী পায়েজ বর্তমানে খেলছেন স্বদেশি ক্লাব ইন্দেপেনদিয়েন্তেতে। চেলসি তাঁকে গত বছর কিনলেও এখনই দলটির হয়ে মাঠে নামা হচ্ছে না। চুক্তি অনুযায়ী, ১৮ বছর পূর্ণ হলে চেলসিতে যোগ দেবেন। সব ঠিক থাকলে ২০২৫ সালের জুলাইয়ে তাঁকে চেলসির জার্সিতে দেখা যাবে। সব মিলিয়ে অপেক্ষাটা এখনো প্রায় দেড় বছরের। তবে এখন থেকেই তরুণ পায়েজ ও তাঁর পরিবারকে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দিচ্ছে চেলসি।
কেন? ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ বলছে, সম্প্রতি ইকুয়েডরের কুখ্যাত এক মাদক কারবারি জেল থেকে পালানোর পর দেশটির অপরাধমূলক সংগঠনগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে অপহরণের ঘটনাও ঘটেছে। কদিন আগে ইকুয়েডরের রাষ্ট্রায়াত্ত টিভি চ্যানেল টিসিতে সরাসরি অনুষ্ঠান চলাকালে মুখোশ পরিহিত কয়েকজন বন্দুকধারী সেখানে হামলা চালায়। পরে অবশ্য পুলিশ বন্দুকধারীদের গ্রেপ্তার করে।
টিসি টেলিভিশন কার্যালয়ের অবস্থান ইকুয়েডরের বৃহত্তম শহর গুয়াইয়াকিলে। চেলসির বিস্ময়বালক পায়েজও পরিবারের সঙ্গে গুয়াইয়াকিলেই থাকেন। ইকুয়েডরে অস্থিরতা বেড়ে যাওয়ার খবর কানে আসতেই পায়েজ ও তাঁর পরিবারের জন্য ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে চেলসি। কাইসেদোর পরিবারও একই ধরনের নিরাপত্তা পাচ্ছে। দুই পরিবারের সঙ্গে ক্লাব কর্তৃপক্ষ নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, পায়েজকে কেন বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম তরুণ প্রতিভা মনে করা হচ্ছে? উত্তরটা জানতে হলে কয়েক মাস আগে ফিরে যেতে হবে। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে একগাদা রেকর্ড করেছেন পায়েজ, এর মধ্যে একটি রেকর্ডে প্রয়াত কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনার পরেই আছে তাঁর নাম।
গত বছরের মার্চে অনূর্ধ্ব–১৭ কোপা আমেরিকা (দক্ষিণ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপ) দিয়ে সবার নজরে আসেন পায়েজ। ব্রাজিলের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ৮৫ মিনিট পর্যন্তও ইকুয়েডর ছিল ২–০ ব্যবধানে পিছিয়ে। এরপরই ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেন পায়েজ। ৮৭ মিনিটে রেয়েসের যে গোলে ইকুয়েডর ব্যবধান কমায়, সেই গোলে আক্রমণের সুর বেঁধে দিয়েছিলেন পায়েজ। এরপরও ব্রাজিল জয় থেকে নিশ্বাস দূরত্বে ছিল। কিন্তু যোগ করা সময়ে নিজেদের অর্ধ থেকে বল নিয়ে পায়েজ যে দৌড় দেন, সেটা তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। এরপর তাঁর অবিশ্বাস্য এক রক্ষণচেরা পাস থেকে গোল করেন সতীর্থ হেরেমি দে হেসুস। পায়েজের বদান্যতায় ঘুরে দাঁড়ানোর অদম্য গল্প লেখে ইকুয়েডর। ম্যাচ শেষ হয় ২–২ সমতায়।
অনূর্ধ্ব-১৭ কোপা আমেরিকায় পায়েজের অসাধারণ পারফরম্যান্স ইকুয়েডরের ফুটবলসংশ্লিষ্টদের নজরে এলে শেষ মুহূর্তে অনূর্ধ্ব–২০ বিশ্বকাপের দলে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০২৩ সালে যুব বিশ্বকাপের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়ও ছিলেন ১৬ বছর বয়সী পায়েজ। মাঠেও আস্থার প্রতিদান দিয়ে গড়েন আরেক বিশ্ব রেকর্ড। ফিজির বিপক্ষে ইকুয়েডরের ৯–০ ব্যবধানের জয়ে প্রথম গোলটি করেন পায়েজ, হয়ে যান যুব বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা।
এমন এক প্রতিভাকে নিশ্চয়ই জাতীয় দল থেকে বেশি দিন দূরে রাখা যায় না। তাঁকে দূরে রাখতে পারেননি ইকুয়েডর জাতীয় দলের কোচ ফেলিক্স সানচেজও। গত বছরের জুনেই পায়েজকে দলে নেন সানচেজ। তবে অভিষেক হয় আরও তিন মাস পর, সেপ্টেম্বরে। জাতীয় দলের জার্সি প্রথমবার গায়ে জড়িয়েই গড়েন আরেক রেকর্ড। মাত্র ১৬ বছর ১৩১ দিন বয়সে ইকুয়েডরের হয়ে খেলতে নেমে হন দেশটির ফুটবল ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় আর দক্ষিণ আমেরিকান অঞ্চলে সবচেয়ে কম বয়সীর তালিকায় দ্বিতীয়। পায়েজের ওপরে শুধু ম্যারাডোনা, যিনি ১৬ বছর ১১৮ দিন বয়সে আর্জেন্টিনার জার্সিতে প্রথমবার খেলতে নেমেছিলেন।
ইকুয়েডরের হয়ে অভিষেক ম্যাচটা দারুণ এক অ্যাসিস্টে রাঙিয়েছেন পায়েজ। উরুগুয়ের বিপক্ষে তাঁর বাড়ানো বল থেকে গোল করেই ইকুয়েডরকে ২–১ ব্যবধানের জয় এনে দেন ফেলিক্স তোরেস। ঠিক এক মাসের মধ্যে নিজেকে অন্য রকম এক উচ্চতায় নিয়ে যান পায়েজ। ২০২৬ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে বলিভিয়ার বিপক্ষে করেন ম্যাচ জেতানো গোল, যেটা জাতীয় দলের হয়ে তাঁর প্রথম। এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণ আমেরিকান অঞ্চলের (কনমেবল) বিশ্বকাপ বাছাইয়ে সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা (১৬ বছর ১৬১ দিন) বনে যান। ভেঙে দেন ১৯৮৯ সালে প্যারাগুয়ের স্ট্রাইকার গুস্তাভো নেফফার রেকর্ড (১৭ বছর ৩২১ দিন)।
এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, চেলসি কেন ১৬ বছরের কিশোরকে সর্বস্ব দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা করছে!