পেনাল্টি মিসের ব্যাখ্যায় বিজ্ঞান কী বলে

পেনাল্টি মিস করেছেন হ্যারি কেইনছবি: রয়টার্স

টাইব্রেকারে পেনাল্টি শুটআউট! সবাই বলেন ভাগ্যপরীক্ষা। ১২০ মিনিটের চেষ্টাতেও যে ম্যাচের ফল হয় না, কয়েক মিনিটের পরীক্ষাতেই সে ম্যাচের জয়ী দল নির্ধারণ করা হয়। কারও কারও কাছে পেনাল্টি তাই নির্মম। এই তো গতকাল রাতে বিশ্বকাপের শেষ আটে দুটি ম্যাচেরই ভাগ্য নির্ধারিত হলো পেনাল্টি শুটআউটে। একটিতে ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরেছে ব্রাজিল এবং অন্যটিতে আর্জেন্টিনার কাছে হেরে বিদায় নিশ্চিত হয়েছে নেদারল্যান্ডসের।

টাইব্রেকারে একটি শটেই ভেঙে চুরমার হতে পারে কোনো দলের স্বপ্ন। এমন পরিস্থিতিতে যখন একজন খেলোয়াড় পেনাল্টি নিতে যান কিংবা পেনাল্টি মিস করেন, তখন তাঁর কেমন অনুভূতি হয়? ‘আমি অনুভব করছিলাম যেন নৈঃশব্দ্যের ভেতর দিয়ে পৃথিবীর শেষ প্রান্তের দিকে হেঁটে যাচ্ছি’—১৯৯০ বিশ্বকাপে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে টাইব্রেকারে শট নিতে যাওয়ার সময় এমনটাই মনে হয়েছিল ইংল্যান্ডের মিডফিল্ডার ক্রিস ওয়াডলের। তাঁর পেনাল্টি মিসেই সেদিন হেরে শেষ চার থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল ইংল্যান্ডকে।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন হচ্ছে, পেনাল্টি মিসের ব্যাখ্যায় বিজ্ঞান কী বলে? পেনাল্টি মিসের ঘটনাটা মূলত পায়ে ঘটে না, ঘটে মস্তিষ্কে। আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেজ এবং ক্রোয়াট গোলরক্ষক দমিনিক লিভাকোভিচের মতো গোলরক্ষককে কৃতিত্ব দেওয়ার পরও এমন কিছু বিষয় যা বিবেচনায় নেওয়ার মতোই।

পেনাল্টি মিস করেছিলেন লিওনেল মেসিও
ছবি: রয়টার্স

নেদারল্যান্ডসের ইউনিভার্সিটি অব টোয়েন্টের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যাথমেটিকস ও কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগ এ নিয়ে একটি গবেষণা চালিয়ে পেনাল্টি মিসের কার্যকারণ নির্ণয়ের চেষ্টা করেছে। ফ্রন্টিয়ার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাটিতে তারা বলেছে, পেনাল্টি নেওয়ার উদ্বেগে খেলোয়াড়দের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (মস্তিষ্কের একটি অংশ, যা মনোযোগ ও আবেগের মতো বিষয়কে প্রভাবিত করে) এতটাই সক্রিয় থাকে, যা খেলোয়াড়দের পেনাল্টি মিসের দিকে চালিত করে।

এটি আসলে কীভাবে কাজ করে? এটি মূলত মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাজে ভূমিকা রাখে। এটি অধিক সক্রিয় থাকার অর্থ, যে কাজ খেলোয়াড়েরা করতে যাচ্ছেন, তা নিয়ে তাঁরা অনেক বেশি চিন্তা করছেন। কিন্তু এটা কেন খারাপ? গবেষণাটি বলছে, অতিরিক্ত চিন্তা করার বদলে ‘অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের নিজেদের সহজাত সক্ষমতার ওপর অধিক নির্ভর করা উচিত’।


ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনুশীলন করে খেলোয়াড়েরা যে কাজ সহজেই করতে পারেন, তা হলো চাপের মধ্যে নিজের কাজটাই স্বাভাবিকভাবে করে আসা। গবেষণায় আরও বলা হয়, ‘বাঁ টেম্পোরাল কর্টেক্সকে অধিক সক্রিয় রেখে অভিজ্ঞ খেলোয়াড়েরা মূলত নিজেদের সহজাত দক্ষতাকে অবহেলা করে এবং পরিস্থিতি নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করে, যা খেলোয়াড়দের মনোযোগে চিড় ধরানোর সম্ভাবনাকেও অনেকে বাড়িয়ে দেয়।’

আরও পড়ুন

গবেষণাটি দেখিয়েছে, শুধু ফুটবল খেলোয়াড়েরাই এতে ভোগেন না; বাস্কেটবল, টেনিস, দাবা ও গলফ খেলোয়াড়েরাও চাপের মুখ এ উদ্বেগে ভুগে থাকেন। তবে সিদ্ধান্তের মুহূর্তে স্বাভাবিক থাকতে না পারা ব্যতিক্রম কোনো ঘটনা নয়, বরং নিয়ম।

২২ জন মানুষের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে মূলত গবেষণাটি সম্পন্ন করা হয়েছে। যেখানে ১০ জন ছিলেন নারী, যাঁদের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। অংশগ্রহণকারীদের ১০ জন আবার নিয়মিত ফুটবল খেলে থাকেন। তবে অন্যদের খেলাধুলার তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না।

গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা পেনাল্টি নেওয়ার সময় বিশেষ হেলমেট পরিধান করেছেন, যেটি বিশেষ আলোর মাধ্যমে মস্তিষ্কের কার্যকলাপকে তুলে ধরে। যেখানে আলাদা আলাদা পরিস্থিতিতে সবাই ১৫টি করে পেনাল্টি শট নেয়। এসব পেনাল্টি নেওয়া হয় মূলত গোলরক্ষক ছাড়া (কম চাপের মধ্যে), একজন অপেশাদার গোলরক্ষককে দিয়ে (সাধারণ চাপের মধ্যে) এবং একজন প্রতিযোগিতামূলক গোলরক্ষককে রেখে (অধিক চাপের মধ্যে)।

চাপ বাড়াতে শেষ রাউন্ডে সেরা স্কোরারের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছিল। তবু গবেষকেরা স্বীকার করেছেন, এ নিরীক্ষা পেশাদার খেলোয়াড়েরা বাঁচামরার লড়াইয়ে যে চাপে থাকেন, তার কাছাকাছিও নয়। আর সেটি যদি হয় বিশ্বকাপের নকআউট রাউন্ডের ম্যাচে, তবে তো কথাই নেই।