আর্জেন্টিনার ম্যাচে পেনাল্টি নিয়ে বিতর্ক—বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
ইতালির রেফারি দানিয়েল অরসাতো পেনাল্টির বাঁশি বাজানোর পর থেকেই বিতর্ক হচ্ছে। ওটা কি পেনাল্টি ছিল? আর্জেন্টিনা ৩-০ গোলে ক্রোয়েশিয়াকে হারিয়ে বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার পরও সেই বিতর্ক থামেনি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্নটা ভাসছে। বিশেষজ্ঞরা যে যাঁর মতো করে ব্যাখ্যা করছেন। ম্যাচ শেষে ক্রোয়েশিয়ার কোচ জ্লাতকো দালিচ অবশ্য এ নিয়ে কোনো বিতর্কে যাননি। স্পষ্ট করে বলেছেন, পেনাল্টি নিয়ে তাঁর ‘কোনো অভিযোগ নেই।’ কিন্তু তবু কি বিতর্ক থেমেছে?
না। আর্জেন্টিনা কাল রাতে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে দুর্দান্ত খেলেছে। নিঃশর্ত হার বলতে যা বোঝায়—ক্রোয়েশিয়া সেভাবেই হেরেছে। এমন হারের পর পেনাল্টি নিয়ে অভিযোগ তোলাটা সম্ভবত সংগত মনে করেননি ক্রোয়াট কোচ।
তাই বলে সমর্থকের মুখ তো আর বন্ধ রাখা যায় না। ম্যাচটা যাঁরা দেখতে বসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সাবেক ফুটবলারের অভাব নেই। তাঁরাও তো দর্শক কিংবা ভক্ত। স্বাভাবিকভাবেই এই পেনাল্টি নিয়ে যে যাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছেন।
সবার আগে ঘটনাটায় একবার ফেরা যাক। ম্যাচের ৩২ মিনিটে মাঝমাঠ থেকে বাতাসে ভাসানো পাস বাড়ান এনজো ফার্নান্দেজ। দৌড়াতে থাকা আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড হুলিয়ান আলভারেজের ডান পাশে বল পড়ে তা সামনে চলে আসে।
আলভারেজ বলটা নিয়ে আরেকটু এগোনোর পর সামনে ছিলেন শুধু ক্রোয়েশিয়ার গোলকিপার ডমিনিক লিভাকোভিচ। তাঁর বাঁ পাশ দিয়ে বলটা চিপ করে জালে পাঠানোর চেষ্টা করেন আলভারেজ। বল শেষ পর্যন্ত জাল পর্যন্ত পৌঁছায়নি। ক্রোয়েশিয়ার সেন্টার ব্যাক দেয়ান লভরেন ‘ক্লিয়ার’ করেন। কিন্তু সর্বনাশ যা হওয়ার তার আগেই হয়ে যায়।
আলভারেজের ঠিক সামনেই ছিলেন লিভাকোভিচ। একদম শেষ মুহূর্তে আলভারেজ বাঁ দিক দিয়ে বের হয়ে তাঁকে এড়ানোর চেষ্টা করেও পারেননি। লিভাকোভিচের সঙ্গে সংঘর্ষে পড়ে যান। ক্রোয়েশিয়ার গোলকিপারও আঘাত পান। পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি অরসাতো। সিদ্ধান্ত ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি (ভিএআর) পর্যন্তও পৌঁছায়নি। মানে, মাঠের রেফারির এই সিদ্ধান্তে ভিএআর হস্তক্ষেপ করেনি।
সাধারণত, একটু সন্দেহ থাকলেও ভিএআর প্রযুক্তিকে এই বিশ্বকাপে মাঠের খেলায় বিশেষ করে অফসাইড নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে দেখা গেছে। কিন্তু কাল রাতে সেই পেনাল্টির সিদ্ধান্তে তেমন কিছুই দেখা যায়নি। স্পটকিক থেকে গোল করে আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে দেন মেসি। আর ওই গোলের পরই ম্যাচ থেকে ধীরে ধীরে ছিটকে পড়ে ক্রোয়েশিয়া।
ব্রিটেনের আইটিভি স্টুডিওতে বসে ম্যাচটি দেখার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ মতামতও দেন সাবেক তিন ফুটবলার গ্যারি নেভিল, রয় কিন ও ইয়ান রাইট। তিনজনই পেনাল্টির বিপক্ষে অবস্থান নেন। ইংল্যান্ড ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাবেক ফুটবলার নেভিল বলেন, ‘এটা পেনাল্টি না। সে (লিভাকোভিচ) আর কী করতে পারত? তাকে তো এগিয়ে গিয়ে বলটা সেভ করার চেষ্টা করতেই হতো। সে কিন্তু ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল। যদি দৌড়ে গিয়ে আলভারেজকে ফেলে দিত, তাহলে (পেনাল্টি) মানা যেত। কিন্তু সে তার আগেই থেমেছে। আমি জানি না এটা পেনাল্টি কি না!’
আইটিভির সঞ্চালক এ সময় ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সাবেক রেফারি পিটার ওয়ালটনের কাছে জানতে চান, ক্রোয়েশিয়া গোলকিপারের তখন কি করা উচিত ছিল? ওয়ালটন জবাব দেন, ‘...আগে বলের দখল নিতে হতো। সে জন্য সে (লিভাকোভিচ) এগিয়ে গিয়েও কিন্তু বলটা হারিয়েছে। তারপর (প্রতিপক্ষ) খেলোয়াড়ের সঙ্গে লেগেছে। আসলে সে যেটা করেছে, ফরোয়ার্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তাতে সে (আলভারেজ) আর এগোতে পারেনি। তাই এটা ফাউল।’
ওয়ালটন এরপর সেই কথাটার ব্যাখ্যা দেন, যে প্রশ্নটা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে—গোলকিপার ওই পরিস্থিতিতে কী-ই-বা করতে পারতেন? বিবিসির সংবাদকর্মী জন বেনেটের এ নিয়ে এক টুইটে ফুটবল ধারাভাষ্যকার ও সংবাদকর্মী স্টিভেন ওয়েইথ ঠিক এমন প্রশ্নই রাখেন, ‘গোলকিপার তো আর হুট করে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে না? আলভারেজের সঙ্গে সংঘর্ষে তার কোনো দোষ নেই।’
ওয়ালটন আইটিভিতে এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘বুঝতে পারছি, এই প্রশ্ন উঠবে সে (গোলকিপার) আর কি-ই-বা করতে পারত? কিন্তু এভাবে একটু ভেবে দেখুন, মাঠের খেলোয়াড় যখন বলের দখল নিতে স্লাইড ট্যাকল করে খেলোয়াড়কে আঘাত করে—সেটা কিন্তু সব সময়ই ফাউল। গোলকিপার ঠিক এই কাজটাই করেছেন।’
নেভিল এরপর সোজাসাপ্টা প্রশ্ন করেন, ‘পিটার, তুমি কি বলতে চাও, গোলকিপার সরে গিয়ে প্রতিপক্ষকে ফ্রি শট নিতে দেবে?’ ওয়ালটনের জবাব, ‘না। কিন্তু তার (লিভাকোভিচ) এগিয়ে যাওয়ার ধরনে বোঝা গেছে, ফরোয়ার্ডের দিকে যাচ্ছে। অর্থাৎ, সংঘর্ষ ঘটতে যাচ্ছে। এটা হলে গোলকিপার নিজের কাজে অসাবধান। তাই এটা ফাউল। সিদ্ধান্তটা নিষ্ঠুর মনে হতে পারে, কিন্তু এটা ফাউলই।’
আর্সেনালের কিংবদন্তি ও ইংল্যান্ডের সাবেক স্ট্রাইকার ইয়ান রাইট অবশ্য নেভিলের সুরেই কথা বলেছেন, ‘(মুহূর্তটা) আবারও ভালো করে দেখলে বোঝা যায়, সেন্টার ফরোয়ার্ড আসলে বলে ঠিকমতো কিক নিতে পারেনি। সে ঠিকমতো কিক নিতে পারলে এবং বলটা জালে পৌঁছালে গোলকিপারের কিছুই করার ছিল না। তাই থেমে গিয়েছিল। আলভারেজ ঠিকমতো কিক নিতে পারেনি। গোলকিপারেরও করার কিছু ছিল না। রেফারিও এটা ঠিকমতো খেয়াল করেনি। ঠিক বুঝতে পারলাম না।’ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাবেক অধিনায়ক ও আইরিশ কিংবদন্তি রয় কিনও একমত হয়ে বলেন, ‘ডিফেন্ডিং ভালো হয়নি। তবে পেনাল্টিটা যে হয়নি, সে বিষয়ে আমি একমত। তার (লিভাকোভিচ) আর কী-ই-বা করার ছিল, কোথায় দাঁড়াত?’
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানে এই ম্যাচের ধারাবিবরণীতে পেনাল্টির সিদ্ধান্ত নিয়ে বলা হয়, ‘নো ব্রেইনার।’ অর্থাৎ সিদ্ধান্তটি নিতে মাথা খাটানোর দরকার পড়ে না। লিভাকোভিচকে কেন লাল কার্ড না দেখিয়ে হলুদ কার্ড দেখানো হলো—সেই ব্যাখ্যাও ম্যাচের ধারা বিবরণীতে দিয়েছে গার্ডিয়ান, ‘শুধু আলভারেজের সঙ্গে সংঘর্ষ নয়, সে বলটাও দখলের চেষ্টা করেছে। তাই শুধু হলুদ কার্ড দেখানো হয়।’
ক্রোয়েশিয়ার তারকা লুকা মদরিচের দাবি অবশ্য, এটি পেনাল্টি ছিল না। ম্যাচ শেষে বলেছেন, ‘আমার কাছে এটি পেনাল্টি নয়। আর্জেন্টাইন খেলোয়াড় কিক করার পর গোলকিপারের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। সেও (লিভাকোভিচ) বল ঠেকাতে গিয়েছিল। বিশ্বাসই হচ্ছে না, রেফারি পেনাল্টির বাঁশি বাজিয়েছে। তাতে ম্যাচের গতিপথও পাল্টে যায়।’
সান্ডারল্যান্ডে খেলা সাবেক গোলকিপার এবং বর্তমানে গোলকিপারদের কোচ ডেভিড প্রিস টুইট করেন, ‘গোলকিপারদের পাশে দাঁড়ানোয় আমি হয়তো দ্বিতীয়। কিন্তু এটা কিভাবে পেনাল্টি হয় না?’
সানডে টাইমসের সংবাদকর্মী ডানকান ক্যাসলের টুইটটি অবশ্য বিতর্কিত, ‘মেসির আর্জেন্টিনার জন্য ফিফা কি পেনাল্টির নতুন নিয়ম চালু করল?’
ফুটবল বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘ফুটমব’-এর দূত এবং ইংলিশ ফুটবল নিয়ে কাজ করা অ্যান্ডি ক্যাসেল অবশ্য উল্টো প্রশ্ন করেন টুইটে—এটা পেনাল্টি নয়, তা নিয়ে লোকে কীভাবে তর্ক করতে পারছে? ক্যাসেল লিখেছেন, ‘গোলকিপার বের হয়ে এসে বল মিস করেছে এবং প্রতিপক্ষে খেলোয়াড়ের সঙ্গে ধাক্কা লেগেছে। ব্যাপারটা এমন, ট্যাকল করতে গিয়ে যদি বল মিস করেন সেটা পেনাল্টি। কিন্তু বলের দখল নিতে পারলে লোকে বলে ভালো ট্যাকল।’
অর্থাৎ, লিভাকোভিচ যদি বলের দখল নিতে পারতেন, তাহলে রেফারি হয়তো পেনাল্টি দিতেন না। যেহেতু তা পারেননি এবং প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়কে ফেলে দিয়েছেন, তাই ওটা পেনাল্টি।