পাশেই ব্যাগভর্তি টাকা, ম্যাথাউস চাইলেই ম্যারাডোনার কথায়...
লোথার ম্যাথাউস তাঁর সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ—এই কথা আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। সেটি মাঠের কথা। কিন্তু মাঠের বাইরে বন্ধুত্ব ছিল দুজনের। আর এই বন্ধুত্ব থেকে অন্তত দুবার বড় অঙ্কের টাকাপয়সা কামাইয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন জার্মান কিংবদন্তি। কিন্তু টাকাপয়সার মোহ ভুলে ম্যাথাউস বন্ধুত্বকেই বড় করে দেখেছেন।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘মেইল অনলাইন’কে দুটি ঘটনা সবিস্তারে জানিয়েছেন অধিনায়ক হিসেবে জার্মানিকে ১৯৯০ বিশ্বকাপ জেতানো ম্যাথাউস। প্রথমবার এমন ঘটনা ঘটেছিল মিউনিখের এক হোটেলে। ম্যাথাউস যে টেবিলে বসেছিলেন, তার পাশেই টাকাভর্তি ব্যাগ ছিল। স্রেফ ‘হ্যাঁ’ বললেই ব্যাগটা পেয়ে যেতেন।
পরেরবার আসলে নির্দিষ্ট কোনো ঘটনা নয়, ম্যারাডোনার জার্সি ছিল ম্যাথাউসের কাছে। সেই জার্সি তিনি চাইলেই নিলামে তুলে বেশ বড় অঙ্কের টাকা পেতে পারতেন। কিন্তু তা না করে, ম্যাথাউস বন্ধুত্বের দাবিকে বড় করে দেখে সেই জার্সি গত মাসে আর্জেন্টাইনদের হাতেই ফিরিয়ে দেন। মাদ্রিদে আর্জেন্টিনার দূতাবাসে গিয়ে জার্সিটি হস্তান্তর করেছিলেন বায়ার্ন মিউনিখ কিংবদন্তি।
ইংল্যান্ডের সাবেক মিডফিল্ডার স্টিভ হজের কাছে ১৯৮৬ বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে ম্যারাডোনার পরা জার্সিটি ছিল। সেই যে ‘হ্যান্ড অব গড’ গোল এবং বিশ্বকাপের ইতিহাসে অন্যতম সেরা গোল করেছিলেন ম্যারাডোনা যে ম্যাচে। ইংল্যান্ডের হারের পর ম্যারাডোনার সঙ্গে জার্সি বদল করেছিলেন হজ। গত মে মাসে ম্যারাডোনার সেই জার্সি নিলামে তুলে রেকর্ড ৭১ লাখ পাউন্ডে বিক্রি করেন। জার্সিটি বিক্রি করে পাওয়া টাকাকে নিজের ‘পেনশন তহবিল’ আখ্যা দিয়েছিলেন হজ।
কিন্তু ৬১ বছর বয়সী ম্যাথাউস সে ধাতে গড়া মানুষ নন। ১৯৮৬ বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্টিনার কাছে হারের পর ম্যারাডোনার সঙ্গে জার্সি অদল–বদল করেছিলেন ম্যাথাউস। নিজের বাসায় এতদিন তা সংরক্ষণ করে রাখলেও শেষ পর্যন্ত জার্সিটি আর্জেন্টাইনদের হাতে ফিরিয়ে দিয়েছেন। অথচ, জার্সিটি বিক্রি করলে বেশ ভালো অংকের টাকাই পেতেন ম্যাথাউস।
কিন্তু তা না করে, ম্যাথাউস যা করেছেন তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন মেইল অনলাইনকে, ‘না। গত ৩৬ বছরে এমনকিছু কখনো ভাবিনি (ম্যারাডোনার জার্সি বিক্রি করা)। বরং আর্জেন্টিনার মানুষকে জার্সিটি ফিরিয়ে দিয়ে ভালো লেগেছে।’
জার্মানির একমাত্র ফুটবলার হিসেবে ফিফা বর্ষসেরার পুরস্কার জেতা সাবেক মিডফিল্ডার ম্যাথাউস জানেন, আত্মজীবনীতে ম্যারাডোনা তাঁকে নিজের ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ নিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘এর চেয়ে ভালো প্রশংসা আমি কখনো পাইনি, পাবও না। ডিয়েগো আমার সময়ের সেরা। ফুটবল নিয়ে সে যা করেছে, তা এই পৃথিবীতে কেউ পারেনি। ডিয়েগো আর্জেন্টিনায় ঈশ্বরতুল্য। এ কারণেই জার্সিটি ফিরিয়ে দেওয়া ছিল আমার জন্য বিশেষ কিছু।’
ম্যাথাউস জার্মানিতে টেলিভিশনে ফুটবল–পণ্ডিত হিসেবে সুনাম কামিয়েছেন। অন্তত জার্সি বিক্রি করে দুই পয়সা রোজগারের মতো আর্থিক সমস্যা তাঁর নেই। ২৫ বছর বয়সে ম্যাথাউস বায়ার্ন মিউনিখে খেলতেন। ম্যারাডোনা তখন নাপোলিতে। দূরে থাকলেও বন্ধুত্ব ছিল দুজনের। সে সময়ের এক চমকপ্রদ ঘটনাও জানিয়েছেন ম্যাথাউস।
তাঁকে নাপোলিতে ভেড়ানোর জন্য ইতালি থেকে চারজন লোক পাঠিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। ম্যাথাউস অবশ্য সেই চারজন লোককে ‘মাফিয়া’ বলতে নারাজ। তাঁর মুখেই শুনুন, ‘সেটি ১৯৮৬ বিশ্বকাপের পরের ঘটনা। নেপলস থেকে ডিয়েগো কয়েকজন লোক পাঠায় আমার কাছে। সে ওদের বলেছিল “আমার দলে ম্যাথাউসকে এনে দাও।”’
পরের ঘটনা ম্যাথাউস বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘সেদিন ছিল শনিবার, কোলনে বুন্দেসলিগায় ম্যাচ ছিল। সেখান থেকে মিউনিখে উড়াল দিয়ে রাত ১০টা নাগাত একটি ইতালিয়ান হোটেলে ঢুকি। আমার ব্যবস্থাপক দল সেখানে ম্যারাডোনার পাঠানো লোকজনের সঙ্গে রাতভর খাওয়াদাওয়া ও পানাহার করছিল। তারা কী চায়, সেটা আমাকে জানাল। ডিয়েগো আমাকে চায়। নাপোলির সঙ্গে তিন বছরের চুক্তি করতে বলা হয়। শুধু সই করার ফি হিসেবেই ১ মিলিয়ন ডয়েচ মার্ক (জার্মানির তৎকালীন মুদ্রা) দেওয়া হতো, আর সেই টাকাভর্তি ব্যাগটা ছিল টেবিলের পাশেই। আমি (নাপোলিতে) যোগ দিলে টাকাটা পাব, না দিলেও পাব। তবে টাকাটা নেওয়ার পর অন্য কোনো ইতালিয়ান ক্লাবে খেলতে পারব না।’
ম্যাথাউস ভেবেছিলেন, টাকাটা তাঁর বেতনের চার গুণ। কিন্তু তিনি যে ধরনের মানুষ, ম্যারাডোনার প্রক্রিয়ার সঙ্গে মেলেনি। ম্যাথাউস তাই না করে দেন। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘বলেছিলাম, না কেউ আমাকে কিনতে পারবে না। মনে হয়েছিল, কাজটা স্বাভাবিকভাবে হচ্ছে না। এরপর তারা ফিরে যায় টাকাটা নিয়ে, আমার সই নিতে পারেনি।’
১৯৮৮ সালে বায়ার্ন ছেড়ে ইতালিয়ান ক্লাব ইন্টার মিলানে খেলেছেন ম্যাথাউস। ক্লাবটির হয়ে জিতেছেন সিরি আ ও উয়েফা কাপ। ম্যাথাউস নাপোলি ছেড়ে ইতালির অন্য ক্লাবে যোগ দিলেও ম্যারাডোনার সঙ্গে বন্ধুত্ব কিন্তু অটুট ছিল। ১৯৮৯ সালে ইন্টারের হয়ে প্রথম মৌসুমে সিরি আ জয়ের পথে পয়েন্ট টেবিলে দ্বিতীয় হয়েছিল ম্যারাডোনার নাপোলি।