আরেকজন বাদল রায় কবে আসবেন
জীবন ক্ষণস্থায়ী। এই সত্য মনে করিয়ে দিয়ে ২০২০ সালের আজকের দিনে না-ফেরার দেশে চলে যান বাদল রায়। কিন্তু রয়ে যাবে তাঁর স্মৃতি। কত ম্যাচ জিতেছেন ফুটবল মাঠে, কত বিনোদন দিয়েছেন! ফুটবলে ছিলেন গ্ল্যামার বয়। ঢাকা মোহামেডানে খেলেছেন ১৯৭৭ থেকে ৮৯ পর্যন্ত। ছিলেন দলটির অধিনায়কও। ‘সাদাকালো’দের হয়ে জিতেছেন পাঁচ-পাঁচটি লিগ—১৯৭৮, ৮০, ৮২, ৮৬, ৮৭ ও ৮৮। এমন সফল ক্যারিয়ার পেয়েছেন খুব কম ফুটবলারই।
কুমিল্লার সুতাকল ক্লাব দিয়ে ঢাকার ফুটবলে হাতেখড়ি হয়েছিল বাদল রায়ের। ওই সুতাকলে খেলতে খেলতেই এ দেশের ফুটবল ইতিহাসের একটা অংশ হওয়ার পথে পা বাড়ান। সেখানে বেতন পেতেন ১৮০ টাকা। ঈদের সময় বোনাস দেওয়া হতো। তা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া, আড্ডা, কত–কী!
এ সময়ই চট্টগ্রাম কাস্টমসে চাকরি ও খেলার ডাক এল। কিন্তু রায় বংশের চাকরির প্রতি আগ্রহ ছিল কম। তবু সাড়া দিলেন। ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামে খেললেন তরুণ বাদল, একই সঙ্গে কুমিল্লার সুতাকল ক্লাবের খেলোয়াড়ও ছিলেন। কুমিল্লার দ্বিতীয় বিভাগে তাঁকে নাকি জোর করে খেলানো হয়েছিল। তাতেই একটু–আধটু নামও হতে থাকে সে সময়। এরপর প্রথম বিভাগে খেলা হলো। লিগ ফাইনালে গোলও পেলেন। দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দে বন্ধুরা মিলে রসমালাই খেতে গেলেন কুমিল্লারই এক মিষ্টান্ন ভান্ডারে। ঠিক তখনই তাঁর জীবনে বাঁকবদলের ক্ষণটা এসে ধরা দিল।
রসমালাই খেতে খেতেই ডাক পেলেন ভানু দার। ভানুদা মানে কুমিল্লার আরেক বিখ্যাত ফুটবলার, প্রণব কুমার ভানু। তিনি তখন ঢাকা মোহামেডানে খেলেন, মিডফিল্ডার। সেই ভানুই বাদলকে এসে বললেন, ‘ঢাকার মোহামেডান ক্লাব থেকে একজন ভদ্রলোক এসেছেন। তোমাকে মোহামেডানে যেতে বলেছেন।’ এটি ১৯৭৭ সালের শেষ দিকের ঘটনা।
সে বছরটা মোহামেডানের ভালো কাটেনি মাঠে। পারফরম্যান্সে ধস নামে। লিগে হয় অষ্টম। ঘুরে দাঁড়াতে বিভিন্ন স্থান থেকে নবীন খেলোয়াড় তুলে আনে মতিঝিল ক্লাবপাড়ার ঐতিহ্যবাহী দলটি। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবেই কুমিল্লা থেকে বাদল রায় ও রংপুর থেকে মোসাব্বের হোসেন এলেন মোহামেডানে। আবদুল গাফফার এলেন ১৯৮০ সালে। মোহামেডান থেকে ডাক পাওয়ার খবরটা শুনে তরুণ বাদল বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। রসমালাই খাওয়া বন্ধ করে ঝিম ধরে রইলেন। তবে অজানা শিহরণে কয়েক রাত নাকি ঘুমই হলো না ঠিকমতো।
নিজেকে সামলে এলেন মোহামেডানে। ওপরে ওঠার জন্য যা কিনা তাঁর কাছে হয়ে গেল রীতিমতো লিফট। সিঁড়ি ভাঙতে হয়নি। ঢাকার ফুটবল তীর্থে এসেই পেলেন আগা খান গোল্ডকাপ। ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে অভিষেক হলো বাদলের। এই টুর্নামেন্টেই সাদাকালো জার্সিতে বাজিমাত করলেন নবীন বাদল, মোসাব্বের। অলিখিত ভারতীয় দলের বিপক্ষে গোল করে মোসাব্বের শোরগোল ফেলেন। ভারতের তারকা ডিফেন্ডার গুরুদেব সিংকে ডজ দিয়ে করা ওই গোল রাতারাতি মোসাব্বেরের পায়ের তলার মাটি শক্ত করে দিল। বাদলেরও তা–ই।
মোহামেডানের কর্মকর্তাদের ছিপ ফেলা বড়শিতে আটকে বাদল রায়ের জীবন বদলে যেতে থাকল। ছুটে চলতে থাকল ‘কুমিল্লা এক্সপ্রেস’। তারপর আর কখনো ব্রেক কষতে হয়নি। হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা তারকা।
১৯৭৭ সালে ঢাকা মোহামেডানের হয়ে ঢাকার মাঠে যাত্রা শুরু করে ক্যারিয়ারের শেষটাও এখানেই। বাদল রায় হাতে গোনা সেই ফুটবলারদের একজন, যিনি মোহামেডানে শুরু করে ইতিও টেনেছেন এই ক্লাবে। মধ্যে আবাহনী, ব্রাদার্স অনেক লোভনীয় প্রস্তাব দিলেও শেষ পর্যন্ত ছাড়া হয়নি সাদাকালো শিবির। মোহামেডানে নিজের প্রথম বছরে কোনো পারিশ্রমিক পাননি। পরের বছর পান ২০ হাজার টাকা। ’৭৯ সালে একলাফে বেড়ে তা হয়েছে ৪০ হাজার। ’৮০ সালে লিগ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর হয় দেড় লাখ টাকা। পরের বছরই আবাহনী তাঁকে প্রস্তাব দিল ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। তাঁর সামনে রাখা হলো টাকার বান্ডিল। কিন্তু ‘টাকাটা আপনারা রাখেন’ বলেন বাদল নাকি দে ছুট! এই গল্প তাঁর মুখেই শোনা।
আরেকটি গল্পও বলছিলেন। মোহামেডানে আসার পর অনেকে পরামর্শ দিলেন, এই ক্লাবে যেহেতু নিয়মিত খেলার সুযোগ আসবে না, তাই মাঝারি মানের কোনো দলে যেতে। সেটা ভেবেই ’৭৯ সালে বিজেএমসি থেকে ২০ হাজার টাকা নিলেন বাদল। এটা জেনে মোহামেডান কর্মকর্তা মনিরুল হক চৌধুরী দেদার শাসালেন বিজেএমসির কর্মকর্তা সলিমুল্লাহকে। কেন টাকা দেওয়া হলো বাদলকে? ‘তখন মনিরুল হক চৌধুরী ভাই সলিমুল্লাহ ভাইকে ডেকে বললেন, আপনাকে আমি রড দিয়ে পিটিয়ে অবস্থা খারাপ করে দেব। কেন বাদলকে টাকা দিয়েছেন’—পেছন ফিরে এর আগে বলেছিলেন বাদল রায়। এটাও জানিয়ে গেছেন, হুমকির পর সেই ২০ হাজার টাকা ফেরত নিয়েছেন সলিমুল্লাহ।
মোহামেডানে এসেই বাদল রায়ের থাকার জায়গা হলো প্রণব কুমার ভানু, রামা লুসাই আর কালা গফুরের রুমে। পাকিস্তানের বিখ্যাত ফুটবলার কালা গফুরের তখন ক্যারিয়ারে শেষ সময়। বাদলকে দেখে মোহামেডান কর্মকর্তাদের কালা গফুর বলতেন, ‘ইয়ে লাড়কা কেয়া খেলে গা।’ শুনে ঘাবড়ে যেতেন বাদল। ‘কালা গফুর থাকতেন ঠিক আমার সামনের বিছানায়। কী এক ফুটবলার ছিলেন! নাম শুনলেই কেমন যে লাগত! কালা গফুর!’ স্মৃতিচারণায় বলেছিলেন বাদল রায়। বলছিলেন, তখন ঢাবির জিম ব্যবহার করতেন মোহামেডানের ফুটবলাররা। ওটা শেষ করে ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রিন্স হোটেলে নাশতা করতেন, পাশেই প্রেসিডেন্ট হোটেলেও খেতে যেতেন। এমন হাজারো স্মৃতি রয়েছে।
মোহামেডানে আসার চার বছরের মাথায় পেলেন এনায়েতুর রহমানের ১০ নম্বর জার্সি। বাদল সে বছর হলেন সাদাকালোর অধিনায়কও। চারপাশে এত আলো আগে দেখেননি। ১৯৮৬ সালে আবার পান মোহামেডানের অধিনায়কের বাহুবন্ধনী। ’৮৬-তে তিন বছর পর মোহামেডানের ঢাকা লিগ জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। ক্যারিয়ারজুড়ে মোহামেডানকে জেতাতে রেখেছেন অনেক অবদান।
বাদল, সালাম, গাফফার, কোহিনূর—আশির দশকে মোহামেডানে চার রত্ন। বাদল রায়ের ভাষায়, ‘আতঙ্ক ছড়ানো চতুষ্টয়। তখনকার দিনে আমরা মাঠে নামলেই খবর হয়ে যেত চারপাশে।’ কোহিনূরের ছিল অনেক গতি। যে গতি অনেক সময় তিনিই নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন না। এ কারণে কোহিনূরকে বলা হতো “ব্রেকলেস”। সালাম মুর্শেদীর গতিও ছিল অনেক। গতিতে নজর কাড়তেন জোসিও। বেঁচে থাকতে এসব নিয়ে অনেক গল্প করতেন বাদল রায়।
জীবনে গোল করেছেন অনেক। ১৯৮২ দিল্লি এশিয়ান গেমসে জাতীয় দলের জার্সিতে স্মরণীয় গোল করেছেন মালয়েশিয়ার বিপক্ষে। যে ম্যাচে গোল করেন আশীষ ভদ্রও। ম্যাচটা বাংলাদেশ জিতেছে। কিন্তু বিশেষ একটা গোলের কথা ভুলতে পারেননি বাদল। ঢাকা স্টেডিয়ামে (আজকের বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) প্রথম বিভাগ লিগে খেলা চলছিল মোহামেডান-ধানমন্ডি। ধানমন্ডিতে তখন নিহাররা খেলতেন। ম্যাচ চলছিল ১-১। এমন সময় মশাল প্রান্তে এক গোল করে বসলেন বাদল। যে গোল তাঁর মনে গেঁথে ছিল আমৃত্যু।
চিমাদের আবাহনীকে হারিয়ে ক্লাবে ফিরেছেন, সেই দিনটাও কখনো ভোলেননি। কলকাতা লিগে তিন তারকা—নাইজেরিয়ার চিমা ওকোরি, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য আর ভাস্কর গাঙ্গুলীকে নিয়ে আবাহনী নামল ১৯৮৬ সালের সেই বিখ্যাত লিগ ম্যাচ খেলতে। সবাই ধরে নিয়েছেন মোহামেডান হারছে। কিন্তু সব হিসাব পাল্টে ঢাকা স্টেডিয়ামের ৫০ হাজার দর্শকের সামনে মোহামেডান স্মরণীয় জয় পেল বাদল রায়ের অধিনায়কত্বে। মনু আর ইলিয়াস ছিলেন গোলদাতা। ফেবারিট আবাহনীর বিপক্ষে ২-০ গোলের জয়ে সাদাকালো সমর্থকদের মধ্যে আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। ম্যাচের দিন ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস ছিল বাদল রায়ের। ঢাকেশ্বরী বা হাইকোর্ট মাজারে যেতেন। তাঁর প্রার্থনা বিফলে যায়নি সেদিন।
খেলোয়াড়ি জীবন থেকেই তিনি ছিলেন রাজনীতিসচেতন। ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে ডাকসুর ক্রীড়া সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। থাকতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে। এমনও হয়েছে, আগের দিন মাঠে কোনো শিরোপা জিতেছেন। জয় উদ্যাপনে গায়ে লেগে রয়েছে রং। সেই রং নিয়ে পরদিন পরীক্ষার হলে বসেছেন। ঢাবিতে প্রথমে পেয়েছেন মৃত্তিকা বিজ্ঞান। কিন্তু মোহামেডানের মতো ক্লাবে খেলে মৃত্তিকা বিজ্ঞানের মতো কঠিন বিষয় পড়া সম্ভব নয় মনে করেছেন। পরে বিষয় পাল্টে চলে যান সমাজবিজ্ঞানে।
চোটের কারণে জাতীয় দলে তাঁর ক্যারিয়ার খুব বেশি দীর্ঘ হয়নি। তবে ১৯৮১-৮৬ জাতীয় দলে খেলার অধ্যায়টা ভালোই কেটেছে এই মিডফিল্ডারের। খেলা ছাড়ার পর সংগঠকের খাতায় নাম লিখিয়ে সফলও হয়েছেন। সর্বশেষ বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের ( বাফুফে) সভাপতি ছিলেন টানা তিনবার। বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, সোনালী অতীত ক্লাব, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদে দেখা গেছে তাঁকে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের সহ-ক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন।
আজ সবই স্মৃতি। যেমন স্মৃতি হয়ে গেল তাঁর সেই মাঠে বাইরের লড়াইও। বাফুফেতে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সরব ছিলেন। আন্দোলন করেছেন। তাঁর মতো এমন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর আর দেখা যায়নি। বাদল রায় চলে যাওয়ার পর ফুটবলে ‘অনিয়মের’ বিরুদ্ধে কথা বলার লোকও যেন হারিয়ে গেছে।
২০১৭ সালের জুনে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে চলে যান বাদল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহায়তায় সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয় তাঁকে। হাসপাতালে চলে জীবন বাঁচানোর লড়াই। একটা সময় সুস্থ হয়ে ফিরেছেন দেশে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। মৃত্যুর কয়েক দিন আগে তাঁর লিভার ক্যানসার ধরা পড়ে। শারীরিক নানা কষ্ট সয়ে বাদল রায় চলেই গেলেন। তাঁর মতো আরেকজন বাদল রায় কবে আসবেন কে জানে!
বাফুফে ভবনে তাঁর সেই কক্ষটা অনেক আগেই আরেক কর্মকর্তার হাতে চলে গেছে। বাদল রায় নেই, তাঁর সেই কক্ষে সাংবাদিকদের আড্ডাও বসে না অনেক দিন। সবকিছু শূন্য। সেই শূন্যতার মাঝেই আজ তাঁকে স্মরণ করা। বাদল রায়ের আত্মা চিরশান্তিতে থাকুক।