অন্ধ অলিভারেসের চোখে স্থির ম্যারাডোনার শতাব্দী সেরা গোল
‘আমরা যাইনি ম’রে আজো—তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়’—নাহ, জীবনানন্দ দাশের এই লাইন মনে হয় সব সময় সত্য নয়। অন্তত একজন মানুয়াল আলবা অলিভারেসের জন্য তো অবশ্যই নয়। ১৯৮৬ সালের ২২ জুনের পর বেঁচে থাকলেও পৃথিবীর বুকে তাঁর জন্য জন্মায়নি আর কোনো নতুন দৃশ্য। মরা মাছের নির্লিপ্ত দৃষ্টির মতো তাঁর গোটা জীবন থমকে গেছে একটা দৃশ্যে।
যে দৃশ্যে একজন ডিয়েগো ম্যারাডোনা করেছেন শতাব্দীর সেরা গোলটি। স্থির হয়ে যাওয়ার জন্য এর চেয়ে সুন্দর মুহূর্ত সম্ভবত পৃথিবীতে খুব কমই এসেছে। কিন্তু এমন কিছু রূপকথার গল্পে শুনতে যতটা ভালো লাগে, বাস্তবে কি আসলেই ততটা রোমান্টিক? কিন্তু রোমান্টিক বা লোমহর্ষক যেমনই হোক অলিভারেসের জীবনে সেটাই এসেছে বাস্তব হয়ে। অন্যভাবে বললে বলা যায়, শাপে বর হয়ে এসেছে! কীভাবে? ম্যারাডোনার তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে অলিভারেসের সেই গল্পটাই বলব।
অলিভারেসের রূপকথার গল্পের মতো বাস্তবতায় প্রবেশের আগে ফিরে দেখা যাক ম্যারাডোনার সেই গোলটি। ফুটবল ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম মুহূর্তগুলোর একটি ১৯৮৬ বিশ্বকাপে মেক্সিকোর আজতেকা স্টেডিয়ামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে ম্যারাডোনার করা দ্বিতীয় গোলটি। সেদিন ম্যারাডোনা মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে ছুটেছেন মাত্র ১১ সেকেন্ড। আর চোখের পলক ফেলার আগেই পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে দেখেছে অমর এক দৃশ্যের জন্ম।
আজতেকার অবস্থা সেদিন খুব একটা ভালো ছিল না। মাঠের বিভিন্ন জায়গায় জমে ছিল পানিও। এমনকি ম্যারাডোনা যখন ড্রিবলিং শুরু করেছিলেন, তখনো বলটা নিয়ন্ত্রণ করা ছিল কঠিন। কিন্তু সেই গোলটা যে ছিল নিয়তির লেখা। নিয়তিকে আর কে ঠেকাতে পারে! সেটা বুঝতেই পেরেই হয়তো ড্রিবলিংয়ে ম্যারাডোনার শিকার পিটার রিড থামিয়ে দিলেন দৌড়। রিড পরে বলেছিলেন, তিনি নাকি বুঝতে পেরেছিলেন দৌড়ে আর ম্যারাডোনা পর্যন্ত পৌঁছতে পারবেন না।
এরপর টেরি বুচার এবং টেরি ফেনউইককেও কাটালেন। পাস দিতে পারতেন সঙ্গে থাকা বুরুচাগা বা ভালদানোকে। কিন্তু কাউকেই দিলেন না। ফেনউইকের দ্বিধার সুযোগ নিয়ে নিজেই ঢুকে পড়লেন বক্সে। ঝড় থামানোর শেষ চেষ্টায় এগিয়ে এলেন ইংল্যান্ডের শেষ ভরসা অধিনায়ক ও গোলরক্ষক পিটার শিলটন। কিন্তু তিনিও হলেন নাস্তানাবুদ। তাঁকে পেরিয়ে গিয়েই বল জালে জড়ান ম্যারাডোনা। এরপর বাকিটা ইতিহাস। আর এভাবেই মাত্র ১১ সেকেন্ডে লেখা হয়েছিল ফুটবলের অমর সেই দৃশ্যটি। যার সঙ্গে তুলনা হতে পারে কেবল অমর কোনো সাহিত্য কিংবা চিত্রকর্মের। এর মাহাত্ম্য গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ারস অব সলিচিউড’ কিংবা ভ্যান গঘের ‘স্টারি নাইটে’র চেয়ে একটুও কম নয়।
আজ এত বছর পরও তাই সেই দৃশ্যের কাছে ফিরে যাওয়ার অনুভূতিটা হয় অনন্য। ভাবুন তো, যে মানুষটি সে সময় এই দৃশ্য উপভোগ করেছেন, তাঁর অনুভূতিটা কেমন হতে পারে? আর এই দৃশ্যই যদি হয় কারও মনে করতে পারা সবচেয়ে শক্তিশালী দৃশ্য? হ্যাঁ, এমনটাই ঘটেছিল অলিভারেসের সঙ্গে। সাদা-কালো পর্দায় ম্যারাডোনার সেই গোলটি দেখার কিছুদিন পরই দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলেন এই কলম্বিয়ান। কিন্তু দৃষ্টি চোখকে বিদায় জানালেও একটি দৃশ্য থেকে গেছে অলিভারেসের চোখে। যে দৃশ্যে ১১ বছর বয়সী এক কিশোর দেখেছিলেন ম্যারাডোনাকে শতাব্দীর সেরা গোলটি করতে। বলা হয়, ম্যারাডোনার সেই গোলটির বর্ণনা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ধারাভাষ্যকারদের থেকেও ভালোভাবে দিতে পারতেন অলিভারেস।
এমনকি সেই গোলের কোনো ভিডিও না থাকলেও অলিভারেসের বর্ণনা থেকে নাকি পুনরায় সৃষ্টি করা যাবে সেই দৃশ্যটির হুবহু প্রতিরূপ। অলিভারেস আমাদের মনে করিয়ে দেন অন্ধ হোমারের কথা, যিনি জন্ম দিয়েছিলেন ইলিয়াড ও ওডিসির মতো মহাকাব্য। উরুগুয়ের কিংবদন্তি সাহিত্যিক এদুয়ার্দো গালেয়ানো তাঁর বই ‘চিলড্রেন অব দ্য ডেজ’-এ অলিভারেসকে নিয়ে লিখেছেন, ‘সেটি ছিল মানুয়েল আলবা অলিভারেসের পৃথিবীতে দেখা শেষ দৃশ্য। তার বয়স তখন ছিল ১১, আর জাদুকরি সেই দৃশ্যটি অলিভারেজের চোখে চিরস্থায়ী হয়ে গেল।’
আর ম্যারাডোনার সেই গোলের দৃশ্যটিই আকস্মিকভাবে অন্ধ হয়ে যাওয়া অলিভারেসকে শক্তি জুগিয়ে এসেছে বছরের পর বছর। যে শক্তিতেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একটি ফুটবল ক্লাব। যে দলের তিনি পরিচালকও হন। শুনতে বিস্ময়কর মনে হলেও এসব কিন্তু রূপকথার কোনো গল্প নয়। এমনটাই ঘটেছে অলিভারেসের জীবনে।
এক সাক্ষাৎকারে অলিভারেস বলেছিলেন, ‘আমি ডিয়েগোকে আমার স্মৃতিতে ধরে রেখেছি। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করা তার সেই জাদুকরি গোলটি বয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আমি তাকে দারুণ পছন্দ করি। কিং পেলের সঙ্গে ডিয়েগোকে দেখা ছিল বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়কে দেখার আনন্দময় এক অভিজ্ঞতা। আমি পেলেকে খেলতে দেখিনি। কিন্তু ডিয়েগোকে দেখেছি। আমি মনে করি সে ইতিহাসের সেরা। মাঠে ও মাঠের বাইরে আমি তাঁকে সবকিছুর ওপরে রাখি। তার কারণে আমার ভেতর অনেক ভালো ব্যাপার আছে। কারণ, আমার স্মৃতিতে তার স্মৃতি খোদাই করা আছে।’
ম্যারাডোনাকে দেখেই ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন অলিভারেস। কিন্তু জীবন চেয়েছিল অন্য কিছু। শতাব্দীর সেরা গোলের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাওয়ার কদিন পরেই সুইমিং পুলে আঘাত পেয়ে দৃষ্টিশক্তি হারান এই কলম্বিয়ান। দৃষ্টি ফেরানোর আশায় দুবার অস্ত্রোপচারও হয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই আর কিছু হয়নি। এরপর আরও দেড় বছর ধরে চলে চিকিৎসা। কিন্তু আর সেরে ওঠেননি অলিভারেস। একপর্যায়ে নিজেও বুঝে যান আর কিছুই হওয়ার নয়।
কিন্তু যার অস্তিত্বের সঙ্গে ম্যারাডোনা শাশ্বত তিনি কি আর ভেঙে পড়তে পারেন? অলিভারেসও ভেঙে পড়েননি। বন্ধু ও পরিবারের সাহচর্যে ঘুরে দাঁড়ান আবার। আঁকড়ে ধরেন ফুটবল ও সংগীতকে। আর যে ফুটবলকে তিনি ভালোবেসেছিলেন সেটিই তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিল মানুষের মধ্যে। ফুটবলের প্রতি ভালোবাসাটা কেমন অলিভারেসের কণ্ঠেই শোনা যাক, ‘বলটাই আমার কাছে সবকিছু। এটা আমাকে উদ্বেগ থেকে মুক্তি দেয়। এটা জীবনের সুন্দর জিনিসগুলোকে ধারণ করে, জীবনের সৌন্দর্য এখানেই। এটাই ফুটবল।’
দৃষ্টিশক্তি হারানোর পরও ফুটবলের মতো একটা উচ্চ-কৌশলসম্পন্ন খেলাকে কীভাবে ধারণ করতে পেরেছিলেন অলিভারেস? ভিন্ন এক সাক্ষাৎকারে জবাবটা এভাবে দিয়েছিলেন, ‘আমি পুরোপুরিভাবে রেডিওর শ্রোতা হয়ে পড়ি। আমি কার্লোস অ্যান্তোনিও ভেলজ এবং হার্নান পেলেজকে শুনতাম। আমি ফুটবল সহজেই বুঝতে পারি, কারণ আমি খেলাটা খেলেছি। সে সময়টাতে আমি সঠিক নেতৃত্বগুণ অর্জন করেছিলাম। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল একজন মানুষ যে চোখে দেখে না, সে ফুটবল নিয়ে কথা বলছে এবং ছেলেদের পরিচালকের কাজ করছে। আর তারাও তার প্রতি মনোযোগ দিচ্ছে এবং সম্মান করছে।’
ফুটবলকে ভালোবেসেই ১৯৮৯ সালে নিজ শহর হুয়ান ডি আকোস্তায় বন্ধুদের নিয়ে অলিভারেস প্রতিষ্ঠা করেন মানুয়েলিতো নাসিওনাল ক্লাব। তবে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য ২০০০ ক্লাবের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় তাঁর। এরপর আটলান্টিক ডিজেবলড অ্যাসোসিয়েশনও গঠন করা, বাইসাইকেল চালানো, সংবাদমাধ্যমগুলোতে ফুটবল নিয়ে নানা আলোচনা করা এবং মাঝেমধ্যে মিউনিসিপ্যাল দলকে পরিচালনার কাজ করেন অলিভারেজ। নিজের জগৎ নিয়ে সব সময় দারুণ খুশি অলিভারেস।
তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তিনি কি আবার দেখতে চান? বাবা-মা-ভাইসহ অনেক কিছু দেখতে চাইলেও অলিভারেস অবশ্য ম্যারাডোনার সেই গোলটি আর দেখতে চান না। কিন্তু কেন? কারণ, অলিভারেস জানেন ম্যারাডোনা বা অন্য কেউ এটা কখনো করতে পারবেন না। তাঁর মতে, কিছু বিষয় আছে যা জীবনে একবারই দেখা যায়। ম্যারাডোনার গোলটিও তেমন কিছু, যা তাঁর দৃষ্টিহীন জীবনের স্মৃতিতে শাশ্বত হয়ে আছে।