৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ২১ কোটি ডলারের স্বাদ পাবেন তো রোনালদো
সৌদিতে আসলে কেমন হবে রোনালদোর নতুন ফুটবল জীবন? আরও অনেক তারকা ফুটবলারকে কি তাঁর পথ অনুসরণ করতে দেখা যাবে ভবিষ্যতে? ক্রীড়াবিষয়ক ওয়েবসাইট ‘দ্য অ্যাথলেটিক’ সেটাই জানার চেষ্টা করছে।
সৌদি আরবে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো যে রকম চান, সবকিছুই সে রকম হবে—এমন যদি কেউ ভেবে থাকেন, গত বৃহস্পতিবার সৌদি সুপার কাপের ফাইনালের পর তাদের আবার নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।
ম্যাচের সময় তাঁর দলের সমর্থকেরাই ‘মেসি’ ‘মেসি’ ‘মেসি’ কোরাস ধরে তাঁকে খেপিয়েছেন, কিং ফাহাদ স্টেডিয়ামে ম্যাচটা রোনালদোর দল আল নাসর ৩-১ গোলে হেরেছে আল ইত্তিহাদের কাছে। আল নাসরের হয়ে এ নিয়ে দ্বিতীয়বার পুরো ম্যাচ খেলেছেন রোনালদো এবং দ্বিতীয়বার গোলহীন কোনো ম্যাচ কাটিয়েছেন।
আল নাসর অবশ্য এটাকে রোনালদোকে নিয়ে তাদের চলার পথে সামান্য ঝাঁকুনি ছাড়া আর কিছু ভাবছে না। পর্তুগিজ তারকার আগমনটা তাঁর নতুন ক্লাব নতুন দিনের শুরু হিসেবে দেখছে। তারা এই চুক্তিটাকে দেশের ফুটবলের সীমানা ছাড়িয়ে আরও বড় কিছু হিসেবেই মনে করছে, যে চুক্তিটা তাদের বৈশ্বিক এই খেলাটার মানচিত্রে আলাদা একটা জায়গা এনে দেবে বলে মনে করছে।
রোনালদোর সঙ্গে নাসরের চুক্তিটা বিশাল অঙ্কের। রোনালদো আল নাসরে বছরে ২১ কোটি ৭৪ লাখ ডলার বেতন পাবেন, এ গ্রহের আর কোনো খেলোয়াড় এর চেয়ে বেশি বেতন পান না। আল নাসরের ঘনিষ্ঠ সূত্র অনুযায়ী, রোনালদোর এই বিশাল বেতনের মাত্র ১০ ভাগের এক ভাগ দেবে তাঁর ক্লাব, বাকিটা দেবে সৌদি সরকার। সেই সূত্রের কথা, এটা ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়কে কাছে পাওয়ার এক বড় সুযোগ, ক্লাবের জন্য এটা ঐতিহাসিক এক মুহূর্ত, সৌদি আরব এবং এই পুরো অঞ্চলের জন্যও। সৌদি ফুটবল ফেডারেশন অবশ্য চুক্তির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
৩০ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তির কথা জানানোর পর থেকেই রোনালদো নতুন ক্লাবে মানিয়ে নেওয়া, সবাইকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। নিজের পেশাদারি আচরণ দিয়ে ড্রেসিংরুমে ইতিবাচক প্রভাব ফেলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সৌদিতে আসলে কেমন হবে রোনালদোর নতুন ফুটবল জীবন? আরও অনেক তারকা ফুটবলারকে কি তাঁর পথ অনুসরণ করতে দেখা যাবে ভবিষ্যতে? ‘দ্য অ্যাথলেটিক’ সৌদি ফুটবলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে সেটাই জানার চেষ্টা করছে।
অনুশীলন এবং মাঠের বাইরের জীবন
এস্পানিওলের সাবেক কোচ ভিসেন্তে মোরেনো গত বছর জুলাইতে সৌদি শীর্ষ লিগের ক্লাব আল শাবাবের দায়িত্ব নিয়েছেন। এই মুহূর্তে লিগে তাঁর দলের অবস্থা তৃতীয়। স্প্যানিশ এই কোচ নতুন ফুটবল পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার গল্পটা শুনিয়েছেন। সৌদি আরবে যেটা তাঁকে প্রথম ধাক্কা দিয়েছে, তা অবশ্য অপ্রত্যাশিত কিছু নয়—তাপমাত্রা।
মোরেনো সে কারণেই বলেছেন, ‘রোনালদো কীভাবে মানিয়ে নেয়, আমি সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি। ওকে আগস্টের ৫০ ডিগ্রি গরমে বিকেলে অনুশীলন করতে হবে। সকালে অনুশীলন করা তো অসম্ভব এখানে। শুনতে হয়তো এটাকে খুব বড় পরিবর্তন মনে হচ্ছে না, কিন্তু আপনি সারা জীবন নির্দিষ্ট একটা রুটিনে অনুশীলন করে গেছেন, ফলে এটার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া কঠিন হতে পারে।’
২০২১ সালে সৌদি আরবের অনূর্ধ্ব-২৩ দলকে কোচিং করানো সের্হিও পিয়েরনাস ব্যাখ্যা করেছেন, ‘উচ্চ তাপমাত্রার কারণে সৌদি আরবের ক্লাবগুলো দিনে একটার বেশি অনুশীলন সেশন রাখে না। এর মানে হচ্ছে, কোচিং স্টাফরা খেলোয়াড়দের বেশি সময় পান না।’ তাঁর কথা, ‘গরমের মাসগুলোতে বেলা তিনটা, কিংবা এরও পরে, ৬টা-৭টার দিকে অনুশীলন হয়, যা অনুশীলন পদ্ধতিকেও প্রভাবিত করে। সম্পূরক অনুশীলনেরও ব্যবস্থা নেই খুব একটা।’
‘ক্লাবগুলো তাদের পরিকাঠামো উন্নত করেছে এবং প্রতিযোগিতাগুলো নিয়েও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, ফলে সেগুলো আরও ভালোভাবে আয়োজিত হচ্ছে। তবে খেলোয়াড়দের প্রচেষ্টার ও বিকাশের সংস্কৃতির অভাব আছে এখানে। শুধু ট্রেনিং করে যে উন্নতি করা যায় না, বিশ্রাম, নীরব কাজ, ডায়েট, সম্পূরক অনুশীলন সবকিছুই যে লাগে, এই উপলব্ধির অভাব আছে’—বলেছেন পিয়েরনাস।
পিয়েরনাস আরও যোগ করেছেন, ‘যোগাযোগ, ভাব আদান-প্রদানের ক্ষেত্রেও সমস্যা আছে। খেলোয়াড়েরা ইংরেজি বলতে পারে না। মানে, অবশ্যই আপনার দোভাষী লাগবে। এই জায়গায় অবশ্য কিছুটা উন্নতি হয়েছে।’
সুযোগ-সুবিধার কথা যদি বলা হয়, কিছুদিন আগে সৌদি আরবে হওয়া স্প্যানিশ সুপার কোপার সময় রিয়াল মাদ্রিদ আল নাসরের অনুশীলন কমপ্লেক্স ব্যবহার করেছে এবং সেটা যথেষ্ট উঁচু মানের। রোনালদো নিজেও তখন উপস্থিত ছিলেন, সাবেক সতীর্থদের অনেকের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগটা হারাতে চাননি।
মাঠের বাইরে রোনালদো রিয়াদের এমন একটা আবাসিক এলাকায় থাকবেন, যেখানে মূলত বিদেশিরাই থাকেন। মোরেনোই জানিয়েছেন, ‘কিছু কিছু জায়গা আছে, ছোট শহরের মতো, যেগুলো রুদ্ধদ্বার এবং নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে। বিদেশিরা সেখানেই থাকেন এবং নিজেদের মতো করে পশ্চিমা ধাঁচে জীবনযাপন করেন। রিয়াদ অনেক বড় শহর। এখানে শহরের ধারণা, রাস্তা, দূরত্ব, ফাঁকা জায়গা যে রকম আমরা ইউরোপে দেখি, তার চেয়ে আলাদা। এটা মাদ্রিদের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বড়।’
ম্যাচের আগে আল নাসরের খেলোয়াড়েরা শহরের কূটনৈতিক এলাকার কোনো পাঁচ তারকা হোটেলে একত্রিত হন। প্রথম কয়েক সপ্তাহ রোনালদো এ রকম একটা বিলাসবহুল হোটেলেই আছেন। তবে ক্লাব তাঁকে একটা বড় বাড়ি দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। সাম্প্রতিক কালে রোনালদো রিয়াদের একটা শপিং সেন্টার ঘুরতে যাবেন বলে সেটা দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পিয়েরনাস বলেছেন, ‘রোনালদো যে রকম প্রভাবশালী, তাঁকে এমন বলয়ের মধ্যেই থাকতে হবে।’
খেলার মান: যা মনে হয়, তার চেয়ে ভালো
আল নাসরে রোনালদো মূলত একক স্ট্রাইকার হিসেবেই খেলবেন। তাঁর নতুন ক্লাব সৌদি লিগে ১৪ ম্যাচ শেষে ৩৩ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে। সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী আল হিলালের চেয়ে ১ ম্যাচ কম খেলে ১ পয়েন্ট এগিয়ে। এই মৌসুমে নাসরের লক্ষ্য অবশ্যই লিগ শিরোপা।
এই মাসের শুরুতে দ্য অ্যাথলেটিকই এক প্রতিবেদনে লিখেছিল, একটা স্পোর্টস ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি আল নাসরকে ইংলিশ চ্যাম্পিয়নশিপের দল লুটন টাউন ও সান্ডারল্যান্ডের সঙ্গে তুলনা করেছে, যেখানে সৌদি লিগ বৈশ্বিক র্যাঙ্কিংয়ে জায়গা পেয়েছে ৫৮তম স্থানে, যা ইংল্যান্ডের লিগ ওয়ান ও লিগ টুর মাঝামাঝি মানের বলা যায়।
তবে মোরেনো বলেছেন, ‘ওদের মান আমরা যা ভাবি, তার চেয়ে ভালো।’ নিজের পরিচিতি অনুষ্ঠানে রোনালদোও সেটা বলে মনে করিয়ে দিয়েছেন, কাতার বিশ্বকাপে সৌদি আরবই একমাত্র দল যারা চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনাকে হারিয়েছিল। ‘ওরা (সৌদি আরব) গ্রুপ পেরোতে পারেনি। তবে সব কটি ম্যাচেই দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে এবং সামর্থ্য দেখিয়েছে। ওদের মান ভালো’—বলেছিলেন রোনালদো।
সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় দুই ক্লাব আল নাসর ও আল হিলাল। ‘যাদের দ্বৈরথ অনেকটা রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনার মতো’—এটা পিয়েরনাসের কথা। বিশ্বকাপে সৌদি আরব দলের ২৬ জনের ১৮ জনই ছিলেন এই দুই ক্লাবের। পিয়েরনাস আরও যোগ করেন, ‘দুটোই রিয়াদের ক্লাব। আল হিলাল কিছুটা বেশি পরিচিত, কারণ জাতীয় দলে ওদের খেলোয়াড় বেশি খেলেছে, ওরা সর্বশেষ এশিয়ান চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে, ফলে তারা ক্লাব বিশ্বকাপেও খেলবে। ওদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী আল নাসর।’
আল নাসরের মাঠের ধারণক্ষমতা ২৫ হাজারের মতো, সাম্প্রতিক কালে যা প্রায় ভরে যাওয়ার কাছাকাছি গেছে কিছু ম্যাচে। টিকিটের দাম ১৫ থেকে ৪০ ডলারের মধ্যে। নারী দর্শকের উপস্থিত ইউরোপের তুলনায় খুবই কম থাকে সৌদি আরবে। সত্যি বলতে, ২০১৮ সালের আগ পর্যন্ত সৌদি আরবের মাঠে নারী দর্শকের উপস্থিতি নিষিদ্ধই ছিল।