এনদ্রিক ও রকি—রিয়াল ও বার্সায় শত্রু–শত্রু খেলতে দুই বন্ধু কতটা প্রস্তুত
‘প্রতিভা’—একই সঙ্গে ক্লিশে ও আকর্ষণীয় শব্দ! কেউ চাইলে রহস্যময়ও বলতে পারেন। প্রতিভা আসলে এমন কিছু, যা কুঁড়ি হিসেবে অনেক দেখা গেলেও শেষ পর্যন্ত বিকশিত হয় সামান্যই। আর এই শব্দটি যখন ফুটবলে ব্যবহার করা হয়, তখন কথাটি যেন আরও বেশি সত্য। প্রতিটি মৌসুমের শুরুতে ফুটবলের আনাচকানাচে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য প্রতিভার কথা শোনা যায়। কিন্তু যখন সুবাস ছড়ানোর সময় হয়, তখন খুব কমজনই সেই কাজটি করতে পারেন। কিছুদিন ধরেই ব্রাজিলের ফুটবলে শোনা যাচ্ছে দুই প্রতিভার নানা গল্পকথা। কাদের কথা বলা হচ্ছে, যাঁরা গভীরভাবে ফুটবলের খোঁজ রাখেন, তাঁদের বুঝে যাওয়ার কথা। তবু বলি, একজনের নাম ভিতর রকি এবং অন্যজন এনদ্রিক ফেলিপে।
দুজনই শেষ পর্যন্ত জ্বলে উঠতে পারবেন কি না, সে প্রশ্নের উত্তর এখনই পাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু কার প্রতিভা ও সম্ভাবনা বেশি, তা নিয়ে আলোচনা হতে তো আর দোষ নেই, হচ্ছেও। এর মধ্যে সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফুটবল হিস্টোরি অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকসের (আইএফএফএইচএস) অনূর্ধ্ব–২০ বছর বয়সী সেরা ফুটবলারের তালিকায় মনোনয়ন পেয়েছেন দুজনই। অবশ্য দুজনকে মুখোমুখি রেখে আলোচনার প্রধান কারণ সম্ভবত তাঁদের পরবর্তী গন্তব্য। এনদ্রিক যাচ্ছেন স্পেনের রিয়াল মাদ্রিদে এবং রকির গন্তব্য সেখান থেকে ৫০৪ কিলোমিটার দূরের বার্সেলোনায়। রকি আগামী জানুয়ারি থেকে খেলতে পারলেও এনদ্রিকেকে অপেক্ষা করতে হবে আগামী মৌসুম পর্যন্ত।
ভিতর রকি বনাম এনদ্রিক ফেলিপে—ইংরেজিতে লিখে খুঁজলে ইউটিউবে বেশ কিছু ভিডিও পাওয়া যাবে। যেখানে দুই ফুটবলারের সামর্থ্য ও প্রতিভার চাক্ষুষ প্রমাণও আছে। দুজনকেই যেখানে দেখা যাবে ড্রিবলিং, পাসিং কিংবা স্কোরিংয়ে প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করতে। তবে মনে রাখা ভালো, এসব ভিডিও মূলত তাঁদের সেরা মুহূর্তগুলোকে একত্র করে বানানো। ভিডিওগুলো তাঁদের সামগ্রিক পারফরম্যান্সের সমার্থক নয়। পাশাপাশি এটাও সত্য, দু–তিন–চার মিনিটে তাঁরা যা করে দেখাচ্ছেন, তা হয়তো কারও কারও সারা জীবনের আরাধ্য।
শুধু অবশ্য এই ভিডিওগুলোয় নয়, কাছ থেকে যাঁরা এ দুজনকে দেখেছেন, যাঁরা দলে টানতে হাত বাড়িয়েছেন, তাঁদের পাশাপাশি পরিসংখ্যানও এই দুজনকে নিয়ে উন্মাদনার পক্ষে রায় দিচ্ছে। এমনকি দুজনকে মুখোমুখি রেখে তাদের নিয়ে তুলনামূলক আলোচনাও চলছে বেশ। আর বরাবরের মতো ইতিহাসের সেরা তারকাদের আয়নাতেও মেপে দেখা হচ্ছে তাঁদের।
‘নতুন পেলে’, ‘নতুন রোনালদো’ বা ‘নতুন রোনালদিনিও’—ব্রাজিল তথা ফুটবলের সঙ্গে জুড়ে থাকা চিরন্তনী বিশেষণ। একে চাইলে ‘দুঃখগাঁথা’ও বলা যায়। কারণ, এমন বিশেষণের বোঝা চেপে ফুটবলে আবির্ভাব তো অনেকেরই হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঝরে পড়াই যেন তাঁদের নিয়তি। এনদ্রিক ও রকিকেও কিছুদিন ধরে নিতে হচ্ছে এই বিশেষণের চাপ। এই চাপ তাঁরা সামাল দিতে পারবেন কি না, তা এখনই বলা মুশকিল। তবে যে আলোচনা তাঁদের ঘিরে শুরু হয়েছে, তা যে অমূলক নয়, সেটা বলাই যায়।
ফুটবলীয় দিক থেকে মোটাদাগে বিবেচনা করলে রকি ও এনদ্রিক একে অপরের আয়না। দুজনের জন্মও প্রায় কাছাকাছি সময়ে। রকির জন্ম ২০০৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি আর এনদ্রিকের জন্ম ২০০৬ সালের ২১ জুলাই। তাঁরা দুজন বন্ধুও বটে। দুজনই খেলেন মূলত একই পজিশনে। ব্রাজিলিয়ান পারানায়েনসের হয়ে এত দিন ৯ নম্বর জার্সিতে দেখা গেছে রকিকে। আর এনদ্রিক ৯ নম্বর জার্সি পরেন পালমেরাইসের হয়ে। অর্থাৎ তাঁদের মূল কাজ বক্সের ভেতর নিজেদের মুনশিয়ানা দেখানো। আগামী মৌসুমে ফুটবল ইতিহাসের দুই সেরা ও চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের জার্সিতে মুখোমুখি লড়াইয়ে নামবেন তাঁরা। মূলত ক্লাব দুটির হয়ে তাঁদের পারফরম্যান্সই ঠিক করে দেবে ব্রাজিলের জার্সিতে তাঁদের ভবিষ্যৎও।
সত্যি কথা হচ্ছে, লম্বা সময় ধরে এমন একজন খেলোয়াড়ের অপেক্ষায় আছে ব্রাজিল। বিভিন্ন সময় ব্রাজিলিয়ান ‘নাম্বার নাইন’ হওয়ার সম্ভাবনা অনেকের মধ্যে উঁকি দিলেও কেউ সেভাবে হলুদ জার্সির মান রাখতে পারেননি। তাই ‘ফেনোমেনন’ রোনালদোর শূন্যস্থানটা এখনো হাহাকার করে যাচ্ছে। এ দুজনকে দিয়ে সে শূন্যতা পূরণের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে ব্রাজিল সমর্থকেরা। দুজনই যদি একই সঙ্গে জ্বলে ওঠেন, তা স্ট্রাইকার নিয়ে হাহাকার দূর করার সঙ্গে মধুর সমস্যাতেও ফেলবে টিম ম্যানেজমেন্টকে। এই পজিশনে খেলা দুজন সেরা খেলোয়াড়ের মধ্য থেকে একজনকে বেছে নেওয়া নিশ্চয় সহজ হবে না। জায়গা পেতে দুজনের লড়াইটা তাঁদের বন্ধুত্বে প্রভাব ফেলবে কি না, সেদিকেও নিশ্চয় চোখ থাকবে ফুটবলপ্রেমীদের।
দুজনের মধ্যে মিল যতই থাকুক, শেষ পর্যন্ত রকি ও এনদ্রিক আলাদা দুজন মানুষ ও খেলোয়াড়। বল পায়ে রানিং, পাসিং ও ম্যাচ পড়তে পারার মতো ব্যাপারগুলো কতটা আলাদা, তা তাঁদের নিয়ে বানানো ভিডিওগুলো দেখলেই বোঝা যাবে। বার্সেলোনায় ক্যারিয়ার শুরু করতে যাওয়া রকি বক্সের ভেতর এককথায় দুর্দান্ত। ১.৭২ মিটার উচ্চতার রকি গতিময় ও বিধ্বংসী। জায়গা বের করে শট নেওয়া এবং তড়িৎ গতিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারার ক্ষেত্রেও রকি অনন্য। ফিনিশিংয়েও প্রতিপক্ষ গোলরক্ষককে রীতিমতো নাস্তানাবুদ করতে পারেন রকি। যে কারণে সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর নামের সঙ্গেই ‘নতুন রোনালদো’ বিশেষণটি বেশি শোনা যাচ্ছে। স্ট্রাইকার হিসেবে গোল করায় কেউ কেউ তাঁকে এনদ্রিকের চেয়ে এগিয়ে রেখেছেন। এ ছাড়া ৪-৩-৩ ফরমেশনে রকিকে উইংয়ে খেলানোর সুযোগও আছে।
গত জুলাইয়ে ইএসপিনের সাংবাদিক পাউলো কোবোস রকিকে নিয়ে বলেছেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সে সেরা সিদ্ধান্তটি নিতে জানে। সে ২০২৪ সালে বার্সেলোনায় এসে সেরা একাদশে নিজের দাবি রাখবে।’ এরপর এনদ্রিকের চেয়ে রকিকে কেন এগিয়ে রাখবেন, সে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কোবোস আরও বলেছেন, ‘রিয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাবে পার্থক্য বোঝাতে এনদ্রিককে অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে। তারও অনেক গুণ আছে। ভিতরের মতো সে–ও শক্তিশালী এবং আর স্কিলও অনেক বেশি। বক্সের বাইরেও সে খেলতে পারে। তবে পালমেরাইসে তার অধারাবাহিকতা প্রমাণ দেয় যে সে এখনো বড় লিগে খেলার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত না। এই মুহূর্তে ভিতর রকি এনদ্রিকের চেয়ে ভালো। যদিও এটা বদলে যেতে পারে।’
হিসাব বদলে যাওয়ার প্রমাণ অবশ্য গত পাঁচ মাসেই দিয়েছেন এনদ্রিক। ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের চূড়ান্ত নিদর্শন ড্রিবলিংয়ে রকির চেয়ে এনদ্রিক বেশ এগিয়ে আছেন। তাঁর ফুটবলীয় প্রতিভা অনেকটাই সহজাত। লেগে থাকা মার্কারকে মুহূর্তের মধ্যে বোকা বানিয়ে এলোমেলো করে দিতে পারেন প্রতিপক্ষের রক্ষণ। আর বক্সের ভেতর ফিনিশিংয়ে রকির চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও ফিনিশিং জোনে তাঁর সাহসী সিদ্ধান্ত এরই মধ্যে তাঁকে প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে এগিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি শারীরিক ফিটনেসের কারণেও ইউরোপে বেশ সুবিধা পাবেন এনদ্রিক।
সব মিলিয়ে ‘লস ব্লাঙ্কোস’ শিবিরে নিজের সেরাটা দিয়ে নতুন করে ইতিহাস লেখার সব রসদই আছে এনদ্রিকের মধ্যে। যেখানে বাড়তি প্রণোদনা জোগাবে তাঁর জেতার মানসিকতা। আর গত ছয় মাসে ব্যবধানটাকে উল্টে দিয়েছেন তিনি, সে প্রমাণ মিলবে ব্রাজিলিয়ান ফুটবল বিশ্লেষক মালদিনির কথায়। তিনি বলেছেন, ‘আমার মনে হয়, এনদ্রিকের ভবিষ্যৎ বেশি উজ্জ্বল। দেখে মনে হয় তার মধ্যে বেশি কিছু আছে। সে একটু বেশিই প্রতিভাবান। সে একটু বেশি দারুণ কিছু করতে পারে। আমার কাছে ভিতর রকির চেয়ে এনদ্রিককে দেখা বেশ মুগ্ধকর।’
রকি ও এনদ্রিককে নিয়ে তুলনামূলক আলোচনার ধারাটা অবশ্য কেবলই শুরু হলো। আগামী মৌসুমে বার্সা ও রিয়ালের হয়ে দুজন যখন প্রতি সপ্তাহে মাঠে নামবেন, তখন তুলনামূলক এই আলোচনা তুঙ্গে উঠবে। তাঁদের পক্ষে–বিপক্ষে আলোচনার ঝড় উঠবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সমালোচক ও বিশ্লেষকদের নির্মম ছুরির নিচেও প্রতিনিয়ত পড়তে হবে দুজনকে। মাঠের পারফরম্যান্সের সঙ্গে এই চাপ সামাল দেওয়ার চ্যালেঞ্জও নিতে হবে দুই বন্ধুকে। তাই শুধু খেলোয়াড়ি নৈপুণ্যেই নয়, মাঠের বাইরের মানসিক চাপ সামলানোর বিষয়টিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই সামগ্রিকভাবে যিনি মাঠ ও মাঠের বাইরের এসব চাপ সামলানোয় এগিয়ে থাকবেন, শেষ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠত্বের গানটাও হয়তো তিনিই গাইবেন।