ওল্ড ট্রাফোর্ডের স্বপ্ন দেখছে সিরাজগঞ্জের সাদমান, জয়পুরহাটের পাপন ও গাইবান্ধার রাহাত
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সকার ট্রেনিং স্কুলের হেড কোচ মাইকেল নিরি খুব কায়দা করে ঘোষণা করলেন তিন খুদে ফুটবলারের নাম। নাম ঘোষণার আগে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব মাঠে হয়ে গেল দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এক ফুটবল ম্যাচ। ব্রুনো ফার্নান্দেজ, কাসেমিরো, মার্কাস রাশফোর্ডদের ক্লাব অনুশীলনে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্য ধানমন্ডির এই মাঠে গত দুই দিন ৫০০ ফুটবল প্রতিভা নাম লিখিয়েছিল নিজেদের দক্ষতা প্রমাণের লক্ষ্যে। মাইকেল নিরির সামনে বসে থাকা ফুটবলাররা সবাই ছিল স্বপ্ন পূরণের শেষ ধাপে। নিরি যতই কায়দা করছিলেন, তাঁর সামনে বসে থাকারা ছিল গম্ভীর। সবারই তখন মনের ভেতর একটিই বিষয় খেলা করছিল—যদি ওল্ড ট্রাফোর্ডে গিয়ে অনুশীলনের সুযোগ মেলে! প্রতিভায় যে কেউই কারও চেয়ে পিছিয়ে নয়। সন্ধ্যায় ফ্লাড লাইট জ্বালিয়ে হওয়া উপভোগ্য ফুটবল ম্যাচটি হয়ে থেকেছে তারই সাক্ষী।
নিরি ঘোষণা করলেন তিনজনের নাম— সিরাজগঞ্জের সাদমান সাজিদ অয়ন, জয়পুরহাটের পাপন রায় ও গাইবান্ধার রাহাত শেখ। এদের মধ্যে প্রথমজন গোলকিপার, বাকি দুজন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। ৫০০ প্রতিভার মধ্য থেকে এই তিনজনকে পছন্দ করেছেন নিরি—খুব ছোটখাট বিষয় নয়। নাম ঘোষণার পর ফটোসেশন করে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হলো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জার্সি। সাদমান সাজিদ, পাপন রায়, রাহাত শেখ—তিনজনেরই মুখ তখন আলো ঝলমলে। ফুটবলার হওয়াই তাদের স্বপ্ন। সাদমান, পাপন তা–ও ফুটবলার হওয়ার দ্বারপ্রান্তেই আছেন। দুজনই শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের অনূর্ধ্ব–১৬ দলের খেলোয়াড়। গাইবান্ধা থেকে এই ট্রায়ালের কথা শুনেই ছুটে আসে রাহাত শেখ। স্থানীয় এক একাডেমিতেই অনুশীলন করে সে। এত দূর এসে সফল হওয়ার পর আপ্লুত ছিল রাহাত, ‘আমার লক্ষ্য ফুটবলার হওয়া। এখানে এসে এত ফুটবলারের মধ্য থেকে বাছাই হলাম। আমার কষ্ট সফল।’
সাজিদের অভিব্যক্তিও এমনই, ‘কোচ নিরি যে আমার গোলকিপিং পছন্দ করবেন, ভাবিনি। আমি অবশ্য নিজের সর্বোচ্চটা দিয়েই চেষ্টা করেছি।’ পাপন চায় সুযোগটা কাজে লাগাতে, ‘শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবে অনুশীলন করি। অনূর্ধ্ব–১৬ দলে আছি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ট্রায়াল হয়তো আমার স্বপ্ন পূরণে অনেক সাহায্য করবে।’
অ্যাপলো টায়ার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সঙ্গে যৌথভাবে এই ট্রায়ালের আয়োজন করেছিল। ‘ইউনাইটেড উই প্লে’ নামের এই ট্রায়ালের কাল ছিল শেষ দিন। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়াও ছিলেন খুদে ফুটবলারদের উৎসাহিত করার জন্য। তিনি ফুটবল–উৎসবে যোগ দিয়ে যেন কিছুটা আবেগাপ্লুতই, ‘কত স্বপ্ন নিয়ে ফুটবলাররা এসেছে। আমি অভিনন্দন জানাই, যারা চূড়ান্ত বাছাইয়ে সফল হয়েছে। যারা সফল হয়নি, তাদের মন খারাপ করার কিছু নেই। যাদের চূড়ান্ত বাছাইয়ে নাম ওঠেনি, আমি বরং তাদের অনুপ্রাণিত করতে চাই। বলতে চাই, তোমাদের সামনে অনেক সময় পড়ে রয়েছে। কঠোর পরিশ্রমের বিকল্প নেই।’
গোলকিপার সাদমান, মিডফিল্ডার পাপন আর রাহাত আগামী জুলাইয়ে যাবেন ভারতের বেঙ্গালুরুতে। সেখান বিভিন্ন দেশের আরও কিশোরদের সঙ্গে ট্রায়ালের পর বাংলাদেশের তিনজনের মধ্য থেকে একজনের ভাগ্যে জুটবে তিন দিনের জন্য ওল্ড ট্রাফোর্ডে খেলা দেখা, প্রশিক্ষণ ও ঘোরাঘুরির সুযোগ। কিন্তু এতে দেশের ফুটবলের উপকার কীভাবে হবে—এ প্রশ্নটাও কিন্তু এসেছে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের আনন্দমুখর ফুটবল–উৎসবের মধ্যেও।
এর আগেও এমন উদ্যোগের শামিল হয়েছিল বাংলাদেশের খুদে প্রতিভারা। কিন্তু সেই প্রতিভাদের বেশির ভাগই ফুল হয়ে ফোটেনি। ২০১২ ও ২০১৪ সালে এমন স্বপ্ন নিয়েই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের ২৪ জন কিশোর ফুটবলার। পর্যাপ্ত পরিচর্যার অভাবে ঝরে গেছে প্রায় সবাই। এবার অ্যাপলো টায়ারের সঙ্গে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড যে উদ্যোগটা নিয়েছে, এখান থেকে বাংলাদেশের ফুটবল কীভাবে লাভবান হতে পারে? ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সকার স্কুলের প্রধান প্রশিক্ষক নিরির পরামর্শ, ‘এই প্রতিভাদের উচিত নিজেদের জন্য পরিশ্রম করা, নিজেদের আরও শানিত করা। পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই।’
নিরি বাড়তি আরও একটি পরামর্শও যোগ করেছেন। সেটি অবশ্য এ দেশের ফুটবল প্রশাসকদের উদ্দেশ করেই, ‘এখানে চূড়ান্ত বাছাইয়ে যারা এসেছে, তারা সবাই প্রতিভাবান। এই প্রতিভাদের লালন করার দায়িত্ব বাংলাদেশের ফুটবলের। বাংলাদেশের ক্লাবগুলোর উচিত এদের বাছাই করে নিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। মোট কথা, এই প্রতিভাদের কোনোভাবেই হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না।’
জামাল ভূঁইয়াও বললেন একই কথা, ‘এই ছেলেদের মনোযোগটা ধরে রাখতেই হবে। পাশাপাশি পড়ালেখাটাও যেন তারা মনোযোগ দিয়ে করে।’