‘রিয়ালের সর্বকালের অন্যতম সেরা’ বেনজেমাকে আবেগী বিদায়
সেই ছবির কথা নিশ্চয়ই মনে আছে?
পুরস্কার হাতে দাঁড়িয়ে আছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, টনি ক্রুস ও সের্হিও রামোস। একটু পেছনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে তালি দিচ্ছেন করিম বেনজেমা। হাসির তো নানা রকম অর্থ হয়। বেনজেমার সেই হাসিতে সতীর্থদের প্রাপ্তির সঙ্গে খানিকটা বেদনাও লুকিয়ে ছিল, সেটি ছিল কারও ছায়ায় আড়াল হয়ে থাকার বেদনা। সেই ছবি যদি অসহায়ত্বের প্রতীক হয়, তবে গত মৌসুমে ব্যালন ডি’অর জয়ের পর অ্যাডিডাসের পোস্ট করার সোনালি ব্যান্ডেজ মোড়ানো হাতের আইকনিক ছবিটি ছিল বেনজেমার ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতীক। এই দুই ছবিতে চাইলে বেনজেমার পুরো ক্যারিয়ারকে দেখে ফেলা যায়।
শূন্য থেকে চূড়ায় উঠে বৃত্ত পূরণ করা বেনজেমা অবশেষে তাঁর সাদা-কালো জার্সির যাত্রাটাকে শেষ করেছেন। রিয়াল মাদ্রিদ আজ যখন বেনজেমাকে বিদায় জানাচ্ছিল, তিনি তখন ‘লস ব্লাঙ্কোস’ ইতিহাসে সর্বকালের অন্যতম সেরা তারকাদের একজন। রিয়ালের হয়ে যৌথভাবে সর্বোচ্চ ২৫ ট্রফির মালিক (অন্য খেলোয়াড়টি হলেন সাবেক ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডার মার্সেলো) হয়ে বিদায় নিতে যাচ্ছেন বেনজেমা। আগামী মৌসুমে সৌদি আরবের ক্লাব আল ইত্তিহাদের হয়ে খেলবেন বেনজেমা।
রিয়ালের ইতিহাসে বেনজেমার অবস্থান কোথায়, সে সম্পর্কে আন্দাজ পেতে দারস্থ হওয়া যায় ক্লাব সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের কাছে। ফরাসি স্ট্রাইকারকে বিদায় জানাতে গিয়ে পেরেজ ফিরে গেছেন ১৪ বছর আগের স্মৃতিতে, যখন প্রথমবারের মতো রিয়ালের জার্সিতে খেলতে নেমেছিলেন বেনজেমা। রিয়াল সভাপতি বলেছেন, ‘আজকের দিনটা আমার জন্য খুবই কঠিন। এটা এমন দিন, যখন গত ১৪ বছরের স্মৃতি এবং আবেগের অভিজ্ঞতাটুকু আমার মনে ফিরে এসেছে। এটা রিয়াল মাদ্রিদের সব ভক্তদের জন্য আবেগী হওয়ার দিন। ১৪ বছর আগে এ মঞ্চটি রিয়াল মাদ্রিদের জন্য ছিল বিপুল উৎসাহের, যা কিনা আমাদের ১২১ বছরে ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্দান্ত মুহূর্তগুলোর একটি।’
নিজের আবেগী বার্তাটাকে আরেকটু দীর্ঘায়িত করে পেরেজ আরও বলেছেন, ‘প্রিয় করিম, ১৪ বছর আগে তুমি রিয়াল মাদ্রিদে এসেছিলে। তুমি আমাদের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়দের একজন। আজ যারা তোমার বিদায়ে বেদনার্ত, তাদের জন্য বলতে চাই, এটা সেই মুহূর্তটিও মনে রাখার মতো। কারণ, অনেক বছর ধরে আমাদের তার ফুটবল উপভোগ করার সৌভাগ্য হয়েছে। আমরা তোমাকে বিশ্বব্যাপী আমাদের জন্য অবিশ্বাস্য সব কীর্তি গড়তে দেখেছি। মাদ্রিদের কোনো সমর্থক এটা ভুলতে পারবে না। তুমি খুব অল্প বয়সে এসেছিলে এবং আমাদের প্রতীকে পরিণত হয়েছিলে। পাশাপাশি তুমি আমাদের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়দের একজনও। তুমি যেভাবে খেলাটাকে বুঝতে পার, তা আমাদের তাড়িত করেছে। তুমি একেবারে অন্য রকম একজন খেলোয়াড়। কারও কারও তোমাকে বুঝতে কিছুটা সময় লাগতে পারে।’
শূন্য থেকে শুরু করে নানা ঝড়ো পথ পাড়ি দিয়ে রিয়ালের আর্মব্যান্ড পরার সুযোগ পেয়েছিলেন বেনজেমা। বিশেষ করে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর বিদায়ের পর বেনজেমায় হয়ে ওঠেন রিয়ালের বড় অস্ত্র। বিদায় বেলায় বেনজেমাকে প্রশংসায় ভাসিয়ে পেরেজ আরও বলেছেন, ‘তুমি এই দলের নেতৃত্ব দিয়েছ। তুমি আমাদের আত্মপরিচয়ের প্রতীক হয়ে ওঠার সেরা উদাহরণ। যখন কোনো অসম্ভব দেখায়, যখন কেউ আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারে না, তখন সতীর্থদের সঙ্গে মিলে তুমি দেখিয়ে দাও রিয়াল কখনো হাল ছাড়ে না। গত বছরে তোমার হাত ধরে অসম্ভবকে সম্ভব করে ঘুরে দাঁড়ানোর মুহূর্তকে মাদ্রিদ–ভক্তরা কখনো ভুলতে পারবে না।’
একসময় রোনালদোর কারণে কিছুটা আড়ালে পড়ে ছিলেন বেনজেমা। কিন্তু কখনো হাল ছাড়েননি তিনি। রোনালদোর বিদায়ের পর বেনজেমা অনেকটা এককভাবে টেনেছেন রিয়ালের ফরোয়ার্ড লাইনকে। বিদায় বেলায় আবেগ ছুঁয়ে গেল তাঁকে, ‘রিয়াল মাদ্রিদ সব সময় আমার পরিবার এবং আমি সব সময় দলের খেলা দেখব। আমার ইচ্ছা ছিল রিয়ালের হয়ে ক্যারিয়ার শেষ করব। কিন্তু জীবন আপনার সামনে আরেকটি সুযোগ নিয়ে আসে।’
রিয়ালকে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্তটা যে সঠিক ছিল, তা উল্লেখ করে বেনজেমা আরও বলেছেন, ‘এটা আমার জীবনের জন্য ভালো পথ ছিল। আমি আমার শৈশবের স্বপ্নকে পূরণ করতে পেরেছি, সে জন্য প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ। আমি যখন তাঁকে দেখি, তখন বলি ওনি হলেন সেই মানুষ, যিনি রোনালদো ও জিদানকে নিয়ে এসেছিলেন। এটা অবিশ্বাস্য। আজ হচ্ছে যাওয়ার দিন এবং অন্য একটি গল্পের দিন। আমার জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো আমি একজন শিশুর মতো উপভোগ করেছি।’
গত মৌসুমে কোচ কার্লো আনচেলত্তির অধীনে খেলে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেন বেনজেমা। লিগ ও চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের পর ব্যক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার ব্যালন ডি’অরও জিতে নেন বেনজেমা। বিদায়ের মুহূর্তে কোচকে স্মরণ করে বেনজেমা বলেছেন, ‘আনচেলত্তিকেও ধন্যবাদ, যিনি শুরু থেকে আমাকে আত্মবিশ্বাস দিয়ে গেছেন। আমি আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। এটা আমার জন্য কিছুটা দুঃখের দিন। কারণ, আমি আমার ক্লাব ছেড়ে যাচ্ছি। আমাকে শক্ত রাখার জন্য সমর্থকদেরও ধন্যবাদ।’