ম্যারাডোনার জন্মদিনে আরও এক ‘নতুন ম্যারাডোনা’র গল্প
কৃষ্ণসাগরের উপকূলে জর্জিয়ার কোবুলেতি শহরের দ্বিতীয় বিভাগের ক্লাব শুকুরা তেমন পরিচিত কোনো নাম নয়। জর্জিয়ার বাইরে এই ক্লাবটিকে কেউ চেনারও কথা না। তবে এই নামটির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে জর্জিয়ার এক সোনালি সন্তান এবং আরও অনেক গল্প।
যাঁর কথা বলছি, নাম তাঁর রেভাজ চেলেবাজদে। কোবুলেতি শহরেরই ছেলে। যাঁকে সবাই চেনে ‘চেলে’ নামে। নাহ শুকুরার হয়ে কখনো খেলেননি চেলে। তবে শুকুরার স্টেডিয়াম গেটের নাম রাখা হয়েছে তাঁর নামে—‘চেলে অ্যারেনা’।
চেলে তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা সময়টা পার করেছেন দিনেমো তিবিলিসিতে। ১৯৭৮ সালে তিবিলিসির সোভিয়েত ইউনিয়নের সেরা ক্লাব হওয়াতেও বড় অবদান ছিল চেলের। চেলেবাজদে থেকে শুধুই ‘চেলে’ হওয়ার গল্পটাও দারুণ। সমর্থকেরা ভালোবেসে নামটা তো ছোট করেছেনই, সঙ্গে ফুটবল কিংবদন্তি পেলের সঙ্গে মিলিয়ে ‘চেলে’।
তিবিলিসির হয়ে খেলা চেলে তার ক্যারিয়ার শেষ করেছেন ১৯৮৭ সালে। এর প্রায় ১৪ বছর পর সেই তিবিলিসিতেই জন্ম খিচা কাভারাস্কেইয়া নামে একজনের। তাঁরও শুরুটা সেই দিনেমো তিবিলিসির হয়ে। ২১ বছর বয়সের সেই কাভারস্কেইয়া এখন ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলে পরিচিত ‘কাভারাডোনা’ নামে। আজ ম্যারাডোনার জন্মদিনে জেনে নেওয়া যাক নতুন ম্যারাডোনার গল্পটা।
পেলে থেকে যেমন চেলে, কাভারাস্কেইয়াও তেমন ম্যারাডোনা থেকে ‘কাভারাডোনা’। এ যেন অদ্ভুত এক কাকতাল! অপেক্ষাটা হয়তো একটুই দীর্ঘই হলো। তবু পেলের পর ম্যারাডোনাকেও যেন পেয়ে গেল জর্জিয়া। এমন ভাগ্য তো খোদ ব্রাজিল-আর্জেন্টিনারও যে হয়নি!
মজার ব্যাপার, নাপোলিতে ম্যারাডোনার সঙ্গে তুলনায় আসার আগে কাভারাস্কেইয়ার পরিচিতি ছিল ‘জর্জিয়ান মেসি’ নামে। এই তুলনা যে আকাশ-কুসুম কোনো কল্পনা নয় অর্ধেক মৌসুম পেরোনোর আগেই সে প্রমাণ দিয়েছেন কাভারাস্কেইয়া।
এ মৌসুমে নাপোলির যে দাপুটে পারফরম্যান্স, তার নিউক্লিয়াস তো ৭৭ নম্বর জার্সি গায়ের এই তরুণই। ফুটবল দেবতা যেন তাঁর পায়ে যেন অর্ঘ্য দিয়ে পাঠিয়েছেন। ড্রিবলিং, শুটিং, পাসিং এবং স্কোরিং—সবকিছুতেই যেন অপ্রতিরোধ্য কাভারস্কেইয়া। বল নিয়ন্ত্রণ থেকে গোল পোস্টে শট—যেন সবুজ গালিচায় রং-তুলির আঁচড়।
জর্জিয়ায় বয়সভিত্তিক ফুটবল খেলার সময় থেকেই আলো ছড়াতে শুরু করেন কাভারাস্কেইয়া। সে সময় প্রতি ম্যাচে ১০টির বেশি ড্রিবলিং করে ডেটা সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে রীতিমতো চমকে দিয়েছিলেন তিবিলিসির ছোট্ট এই কিশোর। প্রতিষ্ঠানগুলো ভেবেছিল তাদের ড্রিবলিং মেট্রিকসই হয়তো নষ্ট হয়ে গেছে।
ফুটবলে সর্বকালের সেরা ড্রিবলারদের তালিকা করতে গেলে সবার আগে যার নাম আসে, সেই গারিঞ্চার সঙ্গে মিলিয়ে তখন তাকে ‘কাভারিঞ্চা’ ডাকাও শুরু হয়। অর্থ্যাৎ, বয়স ২১ পেরোনোর আগেই কাভারাস্কেইয়ার সঙ্গে জুড়ে যায় ফুটবল ইতিহাসের তিন নক্ষত্র—মেসি, ম্যারাডোনা ও গারিঞ্চার নাম!
দিনেমোর হয়ে শুরুর পর রুস্তাভি, লোকোমোটিভ মস্কো, রুবিন কাজান, দিনামো বাতুমি হয়ে কাভারাস্কেইয়া এ মৌসুমে ঠিকানা খুঁজে নেন নাপোলিতে।
ইতালিতে কাভারাস্কেইয়া তাঁর যাত্রাটা হয়তো হাঁটি হাঁটি পা পা করে মাত্র শুরু করেছেন, তবে এর মধ্যেই ফুটবলের ছায়াপথে এক উদীয়মান নক্ষত্র বলা যায় তাঁকে। নাপোলির হয়ে প্রতি ম্যাচেই যেন তিনি আরও ক্ষুরধার, আরও অপ্রতিরোধ্য। নাটমেগ, ডাবল নাটমেগে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের রীতিমতো নাস্তানাবুদ করে ছাড়ছেন।
কেন নাপোলি সমর্থকেরা তাঁকে ‘কাভারাডোনা’ নাম দিয়েছেন, সেটা বুঝতে হলে ফিরে যেতে হবে লাৎসিওর বিপক্ষে মৌসুমের শুরুর দিকের ম্যাচটিতে। যেভাবে মাছের মতো শরীর বাঁকিয়ে শট নিয়ে পোস্ট কাঁপিয়েছিলেন, সেই শব্দ হয়তো আরও অনেক দিন পর্যন্ত লাৎসিও গোলরক্ষক ইভান প্রোভেদেলের ঘুমের ভেতর দুঃস্বপ্ন হয়ে হানা দেবে। সেই মুহূর্তটি একই সঙ্গে ম্যারাডোনাকেও মনে করিয়ে দিয়েছে সবাইকে।
এখানে আরেকটি মজার তথ্য জানিয়ে রাখা যেতে পারে। কাভারাস্কেইয়ার নামটা এখন পর্যন্ত যে কজন কিংবদন্তির সঙ্গে জড়িয়েছে, কেউই কিন্তু তাঁর শৈশবের আদর্শ নন! তাঁর সবচেয়ে পছন্দের খেলোয়াড় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। তবে মাঠে মার্কারকে ছিটকে ফেলার ধরনটা ছাড়া রোনালদোর সঙ্গে কাভারাডোনার মিল কিন্তু সামান্যই।
নামের সঙ্গে অনেক দায়িত্বও চলে আসে। এসেছে কাভারাডোনার কাঁধেও। নেপলসবাসী নিজ শহরে খেলতে আসা প্রতিভাদের কীভাবে ভালোবাসে, তার প্রমাণ খোদ ম্যারাডোনা। জাদুকর ম্যারাডোনাও সেই ভালোবাসা সুদসমেত ফেরত দিয়েছিলেন।
যে শহর নোংরা, সন্ত্রাস এবং বদমাইশির জন্য বিখ্যাত ছিল, তাকে ফুটবল শহর বানিয়ে দিয়েছিলেন তো ম্যারাডোনাই। যিনি ক্লাবে এসেই বলেছিলেন, ‘আমি নেপলসের দরিদ্র শিশুদের আদর্শ হতে চাই। কারণ, তারা আমার মতোই। বুয়েনস এইরেসে ছোটবেলায় আমি এমনই ছিলাম।’
নাহ, কাভারাস্কেইয়া এমন কোনো বিপ্লবী ব্রত নিয়ে আসেননি। তাঁর নেপলসে যোগ দেওয়া নিয়েও ছিল না এত মাতামাতি। তবে মাঠের খেলাতে তাঁর মাঝে ম্যারাডোনার ঝলক দেখেছে নেপলস, দেখেছে পুরো ইউরোপও।
অবশ্য ম্যারাডোনা যে এখনো দূরের বাতিঘর, তা কাভারাস্কেইয়ার জানা আছে, ‘আমি জানি, নেপলসের কাছে ম্যারাডোনা সবকিছু। অবশ্যই এই ডাকনামটি আমি পছন্দ করি। তাঁর সঙ্গে আমার নাম উচ্চারিত হওয়ার মধ্য দিয়েই অনেক বড় দায়িত্ব চলে আসে। জানি, আমি ম্যারাডোনার ধারেকাছেও যেতে পারব না। তবে ক্লাবের বড় খেলোয়াড় হওয়ার জন্য আমি সবকিছু দিতে পারব।’
হ্যাঁ, ম্যারাডোনা তো একজনই। ফুটবল ছাপিয়ে আরও বড় কিছু। তবুও মাঠের ম্যারাডোনার সঙ্গে তুলনাও একজন খেলোয়াড়ের আজীবনের প্রাপ্তি। নাপোলিতে কাভারাস্কেইয়া যাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন, সেই লরেনৎসো ইনসিনিয়েও ছিলেন ম্যারাডোনার ভক্ত। যাঁর পায়ে আঁকা আছে ম্যারাডোনার ট্যাটু।
নাপোলি কোচ লুসিয়ানো স্পালেত্তি অবশ্য মনে করেন কাভারাস্কেইয়ার সেরাটা এখনো দেওয়া বাকি। ম্যাচের আগে চাপের কারণে নাকি নিজেকে ঠিকঠাক মেলে ধরতে পারছেন না জর্জিয়ান তারকা। স্পালেত্তি বলেছেন, ‘সে ম্যাচের আগে সব সময় দুশ্চিন্তায় থাকে। চাপমুক্ত হলেই দেখবেন সে আসলে কী।’ স্পালেত্তি এমন কথা বলেছিলেন মিসরীয় তারকা মোহাম্মদ সালাহকে নিয়েও। সেটা খুব একটা মিথ্যা হয়নি।
কাভারাস্কেইয়ার গল্পটা অবশ্য মাত্র ডানা মেলতে শুরু করেছে। ইউরোপিয়ান ক্লাব ফুটবলে এমন শুরু যেকোনো খেলোয়াড়ের জন্য স্বপ্নের মতো। তাঁকে থামানোর জন্য ছক আঁকাও হয়তো প্রতিপক্ষ কোচরা শুরু করে দিয়েছেন। আধুনিক ট্যাকটিস–নির্ভর ফুটবলে রহস্য ধরে রাখা কঠিন নয়, রীতিমতো অসম্ভব ব্যাপার।
তবে কাভারাস্কেলিয়াকে বলা হচ্ছে, ‘আসোমতাভ্রুলি, নুসখুরি এবং এমখেদরুলি’। নাহ, এসব কিন্তু কোনো খেলোয়াড়ের নাম নয়। এগুলো হচ্ছে জর্জিয়ান ভাষা লেখার সময় ব্যবহৃত তিনটি পদ্ধতি, যার পাঠোদ্ধার করা নাকি খুবই দুরূহ। কাভারাস্কেইয়াকেও মনে করা হচ্ছে তেমন দুরূহ। যার ফল, নাপোলির হয়ে সব টুর্নামেন্ট মিলিয়ে মাত্র ১৬ ম্যাচে ৮ গোল ও ১০টি গোলে সহযোগিতা। যার ফল, লিগ ও চ্যাম্পিয়নস লিগ মিলিয়ে এখনো অপরাজিত নাপোলি।
এই ছন্দটা যদি ধরে রাখতে পারেন কাভারাস্কেইয়া, ‘কাভারাডোনা’ নামটা তখনই পুরোপুরি সার্থক হবে।