‘পূর্ণ’ মেসির চক্রপূরণ অথবা আস্থা রাখার গল্প
এই গল্পের শিরোনাম অনেক। চক্রপূরণের গল্প। ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। আস্থা ও বিশ্বাসের গল্প। আবিষ্কারের গল্প কিংবা আরও অনেক কিছুই বলা যায়।
চক্রপূরণের গল্পটাই আগে বলা যাক। ২০১৬ সালের ২৬ জুন—নিউ জার্সির মেটলাইফ স্টেডিয়ামে শতবর্ষী কোপা আমেরিকার ফাইনাল। সেদিন চিলির কাছে টাইব্রেকারে ৪–২ ব্যবধানে হেরে যায় আর্জেন্টিনা। তবে আর্জেন্টিনার হার ছাপিয়ে সেদিনের বড় খবর হয়ে ওঠে লিওনেল মেসির অবসর।
আকাশি–নীল জার্সির হয়ে ৩ বছরে তিনবার আর ৯ বছরের মধ্যে ৪টি ফাইনাল খেলে প্রতিবারই খালি হাতে ফিরেছেন মেসি। অদৃষ্টের প্রতি অভিমান হোক কিংবা নিজের সামর্থ্যের প্রতি ক্ষোভ থেকে, মেসি সেদিন বিদায় বলে দিয়েছিলেন আর্জেন্টিনার ফুটবলকে। তত দিনে ক্লাব ফুটবলে প্রায় সবকিছু জিতে ফেললেও জাতীয় দলে কিছুই না জেতায় নিজেকে সম্ভবত তাঁর মনে হয়েছিল রিক্ত ও নিঃস্ব। মেসির সেই অবসরের ঘোষণাটি এসেছিল যুক্তরাষ্ট্রের মাটি থেকে।
ঠিক ৭ বছর পর সেই মেসিই এখন যুক্তরাষ্ট্রে থিতু হচ্ছেন ‘সব পেয়েছি’ এর অনুভূতি নিয়ে। ‘শূন্য’ হাতে বিদায় বলে যাওয়া ভূমিতে ফিরছেন ‘পূর্ণ’ হয়ে—এমন ফেরা চক্রপূরণ নয় তো কী!
কেউ কেউ অবশ্য এই ৭ বছরের ব্যবধানে মেসির ‘দুর্ভাগা’ থেকে সৌভাগ্যবান হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরাকে কাকতালীয় বলতে পারেন। একটু এদিক–সেদিক হলেই তো বছরের এই সময়ে সৌদি আরবের লিগে নাম লেখাতে পারতেন মেসি কিংবা ফিরতে পারতেন বার্সেলোনাতেও।
তেমনটা না হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরাকে দৈব ঘটনা বলাই যায়। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প, আস্থা ও বিশ্বাসে ভর করে নতুন করে আবিষ্কারের গল্পকে কী বলবেন?
মেটলাইফ স্টেডিয়ামে সেদিন মাথা নুয়ে বসে থাকা মেসিকে মনে করে দেখুন। ২০০৭ কোপা আমেরিকায় যখন ফাইনালে হেরেছেন, তখনো হতাশার ছায়ার চেয়ে আশার আলো ছিল বেশি। পুরো ক্যারিয়ারই তো সামনে!
কিন্তু ২০১০ সালে যখন স্পেন বিশ্বকাপ জিতে নিল, যাঁদের সঙ্গে বেড়ে উঠেছেন, সেই জাভি, ইনিয়েস্তাদের ট্রফি হাতে তুলতে দেখলেন, তখন থেকেই আর্জেন্টিনার হয়ে কিছু না জিততে পারার আক্ষেপ তীব্র হওয়া শুরু। শুরু একটা অপবাদেরও—‘মেসি বার্সেলোনার, আর্জেন্টিনার নয়’। আক্ষেপটা ঘোচানোর সুযোগ এসেছিল ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে। কিন্তু আসি–আসি করেও শেষ মুহূর্তে হাতছাড়া, ফাইনালে হার জার্মানির কাছে।
পরের বছরই ক্ষতে খানিকটা হলেও প্রলেপ দেওয়ার সুযোপ আসে কোপা আমেরিকায়। আট বছর পর মহাদেশীয় টুর্নামেন্টের ফাইনালে জায়গা করে নেয় আর্জেন্টিনা। কিন্তু এবারও ফিরতে হয় খালি হাতে, হার চিলির কাছে। কিন্তু দানে দানে তিন দান কী হয়?
২০১৬ সালে কোপা আমেরিকার আরেকটি আসর আয়োজন করা হলো। উপলক্ষ সবচেয়ে পুরোনো মহাদেশীয় টুর্নামেন্টটির শতবর্ষ উদ্যাপন। উদ্যাপন রঙিন করে তুলতে বিশেষ এই কোপা আয়োজন করা হয় যুক্তরাষ্ট্রে। মেসির প্রথম শিরোপা জয়ে যা আরও রঙিন হয়ে ওঠার কথা। টুর্নামেন্টের শুরুর দিকে চোট থাকলেও জাতীয় দলের হয়ে একটা ট্রফি জিততে মেসি তখন মরিয়া। খেলছিলেন নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে। সেমিফাইনাল, কোয়ার্টার ফাইনালসহ টানা তিন খেলায় হন ম্যাচসেরা। ফাইনালে জায়গা করে নেওয়ার পর মনে হচ্ছিল এবার আক্ষেপ বোধহয় ঘুচবে!
ফাইনালে অমীমাংসিত ১২০ মিনিটের পর খেলা গড়ায় টাইব্রেকারে। দলের হয়ে প্রথম শট নিতে যান মেসি নিজেই। তাঁর শট উড়ে যায় বারের ওপর দিয়ে। মাথা নুইয়ে হতাশায় মুখ লুকালেন সঙ্গে সঙ্গে। যে মাথা আর তোলার সুযোগ হলো না টাইব্রেকার শেষেও। ৪–২ ব্যবধানে পিছিয়ে আর্জেন্টিনা হারে আরও একটি ফাইনাল। টানা তিন বছরে তিনবার, ৯ বছরের মধ্যে চারবার। হাল ছেড়ে দিয়ে মেসি তাই অবসরের ঘোষণা দিয়ে ফেলেন, ‘জাতীয় দলের সঙ্গে আমার পথচলা এখানেই শেষ। এটা আমার জন্য নয়।’ আর্জেন্টিনার কোপা আমেরিকায় হারের চেয়ে মেসির ঘোষণাটিই হয়ে ওঠে সময়ের ‘টক অব দ্য ফুটবল’।
মাত্র ২৯ বছর বয়সে আর্জেন্টিনার হয়ে খেলা ছেড়ে দিয়েছেন মেসি, ব্যাপারটা হজম করতে পারছিলেন না কেউ। শুরু হয় মেসিকে খেলা চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ। আর্জেন্টিনাজুড়ে শুরু হয় ‘লিও, যেও না’ প্রচারণা। আর্জেন্টিনা দল যেদিন কোপা আমেরিকা শেষ করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বুয়েন্স এইরেস থেকে ফেরে, সেদিন মেসিকে সিদ্ধান্ত পাল্টাতে অনুরোধ করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট মরিসিও মাক্রি। একই অনুরোধ জানান ১৯৮৬ বিশ্বকাপজয়ী কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনাও।
আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুসারে, মেসিকে অবসরের সিদ্ধান্ত বদলানোর অনুরোধ জানিয়ে ২ জুলাই রাস্তায় নেমেছিলেন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে অনুরোধ তো ছিলই। বুয়েনস এইরেসের মেয়র হারাসিও রদ্রিগেজ লারেতা মেসির প্রতি ভালোবাসা প্রকাশে শহরে একটি ভাস্কর্য তৈরি করে দেন।
এত মানুষের অনুরোধের পরও তাৎক্ষণিকভাবে চুপচাপই ছিলেন মেসি। মাসখানেক পর খবর আসতে থাকে মনোভাব বদলাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত অবসরের দেড় মাস পর ১২ আগস্ট আর্জেন্টিনার ২০১৮ বিশ্বকাপ বাছাইয়ের দলে যোগ করা হয় মেসির নাম। অবসর ভেঙে ফেরেন ১ সেপ্টেম্বর উরুগুয়ের বিপক্ষে ম্যাচে। আর্জেন্টিনার ১–০ ব্যবধানের সেই জয়ে গোলও করেন মেসিই।
অবসর নিয়ে ডিরেকটিভি স্পোর্টসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মেসি তখন বলেছিলেন, ‘সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম মুহূর্তের উত্তেজনায়। তবে ফিরে আসছি বলাটাও বিব্রতকর।’ আরেক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘দেশ আর জার্সির প্রতি ভালোবাসা আমাকে ফিরিয়ে এনেছে। যাঁরা আমাকে আর্জেন্টিনার হয়ে খেলা চালিয়ে যেতে বলেছেন, তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আশা করি, কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের উল্লাস করার মতো কিছু এনে দিতে পারব।’
উল্লাস করার কিছু অবশ্য সহসাই এনে দিতে পারেননি। উল্টো, ২০১৮ বিশ্বকাপে ফ্রান্সের কাছে হেরে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বিদায় নেয় আর্জেন্টিনা। তত দিনে অবশ্য সমালোচনা আর ব্যর্থতা উপেক্ষা করতে শিখে গেছেন মেসি। মেসির মতে, ‘৩০ বছর বয়সে ফুটবলকে আমি ভিন্নভাবে উপভোগ করতে শুরু করি। মাঠ এবং মাঠের বাইরের প্রতিটি মূহূর্তকে আমি নতুনভাবে উপলব্ধি করতে থাকি। কেউ সমালোচনা করলেও ভিন্নভাবে দেখি।’
সব সমালোচনা আর গঞ্জনার অবসান ঘটে ২০২২ সালের ১৮ ডিসেম্বর কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে। ফাইনালে টাইব্রেকারে ফ্রান্সকে ৪–২ ব্যবধানে হারিয়ে বিশ্বকাপ জেতে আর্জেন্টিনা, দীর্ঘ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মেলে মেসিরও।
৪টি চ্যাম্পিয়নস লিগ, ১ কোপা আমেরিকা আর ৭ ব্যালন ডি অর জেতার পর এই একটাই শূন্যতা ছিল মেসির, যা পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর মেসির কাছে সময়টা এখন উপভোগের। যে কারণে সৌদি আরবের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার প্রস্তাব থাকলেও, আবেগের নাম হয়ে থাকা বার্সেলোনায় ফেরার সম্ভাবনা জাগলেও আর কিছু অর্জনের চ্যালেঞ্জ অনুভূত হচ্ছে না মেসির। সব ছেড়েছুড়ে নিস্তরঙ্গ জীবন কাটাতে নাম লেখাচ্ছেন, তাই তুলনামূলক কম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ মেজর লিগ সকারে (এমএলএস)। কঠোর পরিশ্রমে সব পেয়ে যাওয়ার পর মানুষ যেমন একটু বিশ্রাম নিতে চায়, মেসির এমএলএসে যোগ দেওয়ায় তা বুঝে নেওয়া যায়।
অ্যাডিডাসকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন মেসি। সেখানে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, সবকিছু জিতে নেওয়ার পর যখন পেছন ফিরে তাকান, তখন কেমন লাগে? সেই যে হতাশামাখা দিনগুলো, যখন জাতীয় দলকে কিছু জেতানোর চেষ্টা করেও পারছিলেন না—সেসব দিনের কথা এখন ভেবে তাঁর কেমন লাগে? মেসির জবাবটা ছিল এমন ‘একবার এটাও বলেছিলাম, জাতীয় দলে আর খেলব না। তখন মনের মধ্যে অনেক সন্দেহ দানা বেঁধেছিল। এখন এটা ভেবে আনন্দ লাগে যে একসময় যা বলেছিলাম, (অবসর ঘোষণা) তার জন্য আমি অনুতপ্ত হয়েছি এবং জাতীয় দলে ফিরে সবকিছু জিতেছি। বারবার ব্যর্থ হওয়ার পর অনেকবার শুনেছি, “কখনো হাল ছেড়ো না।” আমার মনে হয়, যে চ্যালেঞ্জ আমি নিয়েছিলাম, তার চেয়ে হাল না ছাড়াটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’