১৮৭০ না ১৮৭২, আন্তর্জাতিক ফুটবলের জন্ম কবে
প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ হয়েছে কবে?
উত্তর খুব সহজ। গুগল করলেই উইকিপিডিয়ায় চলে আসবে দিন, তারিখ, দুই দল ও ম্যাচের গল্প। ১৮৭২, স্কটল্যান্ড বনাম ইংল্যান্ড ফুটবল ম্যাচ।
সেই লিংকে ক্লিক করলে জানবেন, সে বছর ৩০ নভেম্বর গ্লাসগোর হ্যামিল্টন ক্রিসেন্ট পার্কে স্কটল্যান্ড-ইংল্যান্ড গোলশূন্য ড্র ম্যাচটি অফিশিয়ালি আন্তর্জাতিক ফুটবলের প্রথম ম্যাচ। মাঠের নাম দেখে কোনো কারণ ছাড়াই গ্যাভিন হ্যামিল্টনকে মনে পড়তে পারে। অতি আগ্রহী ব্যক্তিরা যোগসূত্রটা ধরতে পারবেন।
১৯৯৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে ফিফটি করে ম্যাচটা প্রায় ছিনিয়ে নেওয়া স্কটিশ হ্যামিল্টনের সঙ্গে হ্যামিল্টন ক্রিসেন্ট পার্কের শুধু নামে নয়, কাজেও মিল আছে। ক্রিকেট। এটা ওয়েস্ট অব স্কটল্যান্ড ক্রিকেট ক্লাবের মাঠ। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও সত্য, পৃথিবীর প্রথম অফিশিয়াল আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ হয়েছিল এই ক্রিকেট মাঠে। ‘অফিশিয়াল’ শব্দটা বারবার আসছে! অর্থাৎ যেটা স্বীকৃত। অস্বীকৃত মানে, আন–অফিশিয়াল প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচও কিন্তু হয়েছিল ক্রিকেট মাঠেই!
সেই মাঠ যেনতেন মাঠ নয়, তা ইংলিশ ক্রিকেটের ঐতিহ্যের অংশ, আর একসময় ছিল ‘কসমোপলিটন’—মানে, খেলার জাত-পাতের ভেদাভেদ নেই। প্রাচীনতম জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ এফএ কাপের প্রথম ফাইনাল (১৮৭২) হয়েছে এই মাঠে। পাঁচ বছর পর সেখানে রাগবিতে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছে ওয়েলস ও স্কটল্যান্ড। রাগবির প্রথম ভার্সিটি ম্যাচও সেখানে (১৮৭৭)। তিন বছর পর সেই মাঠই ইংল্যান্ডের মাটিতে প্রথম টেস্ট ভেন্যু। কেনিংটন ওভাল।
কিন্তু গল্পটা কেনিংটন ওভালের নয়। উইকিপিডিয়ায় ওভালের গল্প ঘাঁটতে গিয়ে একটি খটকার সূত্র ধরে এই গল্প ১৫৩ বছর আগের এক ম্যাচের।
উইকিপিডিয়ার তথ্য স্বীকৃত নয় সত্য, তবু ইংলিশ ক্রিকেটের আদি খেলাঘর ওভালে ‘ইংল্যান্ড প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ খেলেছে ১৮৭০ সালে’ তথ্যটি খটকা জাগায়। প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ যে হয়েছে, তার দুই বছর পর হ্যামিল্টন ক্রিসেন্ট পার্কে, যেখানে অংশ নিয়েছিল ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড—অফিশিয়ালি এটাই স্বীকৃত এবং হ্যামিল্টন ক্রিসেন্ট পার্কের উইকিপিডিয়া পেজেও তথ্যটি আছে। তাহলে!
রহস্যটা পেঁয়াজের খোসার মতো ছাড়ানো যাক। একদম শুরু থেকে।
ইংল্যান্ডের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (এফএ) দুনিয়ার প্রাচীনতম অ্যাসোসিয়েশন। ১৮৬৩ সালে যাত্রা শুরুর তিন বছর পর এফএর কমিটিতে আসেন চার্লস উইলিয়াম অ্যালকক। ভদ্রলোকের কাজকর্মের যে ব্যাপ্তি, তাতে আলাদা করে পরিচয় না করিয়ে দিলে অন্যায় হবে।
একাধারে লেখক, সম্পাদক, প্রশাসক, সাবেক ফুটবলার, এফএ কাপ চালুর নেপথ্য নায়ক, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ও ফুটবলেও তা–ই। শুরুটা যাঁদের মাধ্যমে হয়েছিল, তাঁদের একজন। তবে কোনো কোনো ইতিহাসবিদ আন্তর্জাতিক ফুটবলের জন্মে অ্যালককে একক ‘পিতৃত্ব’ (কৃতিত্ব) দিলেও ‘ফিফামিউজিয়াম’ ওয়েবসাইটে দাবি একটু অন্য রকম। এই ম্যাচ নিয়েই লেখায় সেখানে অ্যান্ডি মিচেলের ‘বুক ফার্স্ট ইলেভেনস’ বইয়ের উদ্ধৃতি, ‘…অ্যালকক হয়তো নিজেও এমন দাবি করবেন না।’ তখন ‘ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের কমিটিতে ১২ জনের মধ্যে ৫ জনের শরীরে স্কটিশ রক্ত ছিল। বোঝাই যাচ্ছে, ধারণাটা কোত্থেকে এসেছিল।’
ইঙ্গিতটা শতাব্দীপ্রাচীন ইংলিশ-স্কটিশ ‘ওল্ড এনিমি’ শত্রুতা নিয়ে। একই কমিটিতে থেকে আগে নিজেরা মুখোমুখি হওয়ার যে ব্যাপারটা!
ফিফামিউজিয়ামে ‘দ্য ফিল্ড’ সংবাদমাধ্যমে ১৮৭০ সালের ২২ জানুয়ারি প্রকাশিত সংস্করণে ম্যাচের দিন–তারিখ নিয়ে উদ্ধৃতি, ‘ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের নিয়মের অধীনে স্কচ ও ইংলিশদের মধ্য থেকে সেরা প্রতিনিধিরা ১৯ ফেব্রুয়ারি শনিবার ওভালে ম্যাচ খেলবেন।’
১৮৭০ থেকে ১৮৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লন্ডনে ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের মধ্যে হওয়া পাঁচটি ম্যাচের এটি প্রথমটি। ইংল্যান্ড দল গোছানোর দায়িত্ব পেয়েছিলেন অ্যালকক ও আরেক সাবেক ফুটবলার রবার্ট গ্রাহাম (লেখক উনিফ্রিড গ্রাহামের বাবা)। স্কটল্যান্ডের দল গুছিয়েছিলেন ওয়ান্ডারার্সের সাবেক গোলকিপার জেমস কার্কপ্যাট্রিক ও তর্কযোগ্যভাবে ব্রিটিশ ফুটবলে প্রথম তারকা আর্থার কিনিয়ার্ড। এফএ কাপে তাঁর ৯ বার ফাইনাল খেলার রেকর্ড এখনো কেউ ভাঙতে পারেননি।
স্কটল্যান্ডের খেলোয়াড়ের জন্য তখন অ্যালকক (এফএ সেক্রেটারি ও ইংল্যান্ড দলের অধিনায়ক) নিজে স্কটিশ সংবাদপত্রে কয়েক দফা বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। লাভ হয়নি তেমন। স্কটল্যান্ডের বেশির ভাগ খেলোয়াড় ছিলেন লন্ডন-কেন্দ্রিক স্কটিশ রক্তের। যদিও বইয়ে মিচেলের দাবি, ‘আধুনিক নিয়মেও তারা স্কটল্যান্ডের হয়ে খেলার যোগ্যতা রাখতেন।’ সে যাই হোক, সংবাদপত্রে প্রকাশিত দিন-তারিখ মেনে কিন্তু খেলা মাঠে গড়ায়নি।
১৮৭০ সালে লন্ডনের তুষারপাতের নাকি কোনো তুলনা হয় না। টেমসের বুকে চাঁই চাঁই বরফ। বৈরি আবহাওয়ায় ম্যাচটা দুই সপ্তাহ পেছানো হয়। লোকজনের যে আগ্রহ ছিল তা বোঝা যায় ‘দ্য ফিল্ড’–এর প্রতিবেদনে। পাঁচ থেকে ছয় শ লোক হয়েছিল ম্যাচের দিন। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ফুটবল মাঠে এমন (ভিড়) আগে দেখা যায়নি।’
স্কটল্যান্ডের রক্ষণে ছিলেন ব্রিটেনের দুই পার্লামেন্ট সদস্য উইংফিল্ড ম্যালকম ও উইলি গ্লাডস্টোন। পরের নামটা চেনা চেনা লাগতে পারে। তিনি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম গ্লাডস্টোনের ছেলে। কার্কপ্যাট্রিক ছাড়াও আরও চারজন ছিলেন ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসের সদস্য। ‘গার্ডিয়ান’ এ লেখা হয় ‘স্কটল্যান্ড দলের হয়ে উইলি গ্লাডস্টোন ভালো খেলেছেন।’
ঠিক যেমনটা ইংল্যান্ড দলের হয়ে খেলেছিলেন অ্যালকক। ফুটবলার হিসেবে সুনাম ছিল। ১৮৬৪ সালের জানুয়ারিতে ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রচলিত আইনে প্রথম ট্রায়াল ম্যাচে প্রথম গোলটা ছিল অ্যালককের।
ফিফামিউজিয়ামের লেখায় দাবি, অ্যালকক অ্যাসোসিয়েশন ফুটবলের ইতিহাসে প্রথম গোলদাতা। তাঁর সঙ্গে আলফ্রেড বেকার, এডয়ার্ড বোয়েন ও ১৬ বছর বয়সী স্কুলপড়ুয়া ‘প্রিন্স অব ড্রিবলার’ খ্যাতি পাওয়া ওয়ালপোল ভিদালদের নিয়ে ইংল্যান্ড দলটা বেশ শক্তিশালী ছিল। অ্যালকক অ্যাসোসিয়েশন ফুটবলের ইতিহাসে প্রথম গোলদাতা হলেও আন্তর্জাতিক ফুটবলে প্রথম গোলদাতা হতে পারেননি। সেই কীর্তি স্কটল্যান্ড দলের ১৭ বছর বয়সী হ্যারো স্কুলের ছাত্র রবার্ট ক্রফোর্ডের, দ্বিতীয়ার্ধের ১৫ মিনিটে দূরপাল্লার শটে। দু-একটি সংবাদমাধ্যমের দাবি, ইংল্যান্ডের গোলকিপার নাকি তখন ওপরে উঠে গিয়েছিলেন।
এই রবার্ট ক্রফোর্ড পরে আফগান যুদ্ধে অংশ নেওয়া ব্রিটিশ আর্মির বীর। আর মাঠে ফুটবলার ও ক্রিকেটার। স্কটল্যান্ড রিপ্রেজেনটিটিভস দলের হয়ে চারটি ফুটবল ম্যাচ খেলার পাশাপাশি এমসিসির হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটও খেলেছেন। কিন্তু শেষ জীবনটা তাঁর ভালো কাটেনি। আন–অফিশিয়াল আন্তর্জাতিক ম্যাচে প্রথম গোলদাতা হিসেবেও তাঁকে কেউ মনে রাখেননি। সিয়েরা লিওনে পুলিশ কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকতে বাসার চাকরকে চাবকে মেরে ফেলার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। কলঙ্কটা নিয়েই মরেছেন।
স্কটল্যান্ড কিন্তু জিততে পারেনি। ৮৯ মিনিটে দারুণ এক মুভ থেকে গোল করেন নিলামকারী আলফ্রেড বেকার। ইংল্যান্ডকে ১-১ গোলের ড্র এনে দেওয়া বেকার পেশায় ছিলেন নিলামকারী। একদিন ট্রেন ধরতে গিয়ে দৌড়ানোর সময় আর ফিরলেন না।
সেই ড্রয়ের পর আরও চারটি ‘ইংল্যান্ড বনাম স্কটল্যান্ড রিপ্রেজেনটিটিভস ফুটবল ম্যাচ’ হয়েছে। সব কটিই লন্ডনে। স্কটল্যান্ড থেকে প্রতিবাদ ওঠে, তাদের দলের খেলোয়াড়দের বেশির ভাগ লন্ডনের। অ্যালকক সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়ার কৈফিয়ত দেন। এভাবে আড়াই বছরে আরও চার ম্যাচ খেলে ফেলার পর ষষ্ঠ ম্যাচটি স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয় (১৮৭২, ৩০ নভেম্বর) খেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া নেয়। ফিফামিউজিয়ামের লেখায় বলা হয়েছে ‘অফিশিয়াল স্ট্যাটাস পেতে এই সীমান্ত পাড়ি দেওয়াই সম্ভবত বড় ভূমিকা রেখেছে।’
আরও মজার বিষয় হলো, ‘রহস্যজনকভাবে ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের মিনিট বুকে (রেকর্ড বই) ১৮৭০ সালে ওভালের সেই ম্যাচ ও পরের চারটি ম্যাচের কোনো কাভারেজ নেই’ বলেও উল্লেখ করা হয়। কিন্তু মজা এখানেই শেষ নয়। বাকিটা পড়ুন ‘মিনিট বুকে ১৮৭২ সালে গ্লাসগোর ম্যাচের পুরো কাভারেজ আছে। লন্ডনে যে পাঁচটি ম্যাচ খেলা হয়েছিল, সেগুলো বাদ দিয়ে গ্লাসগোর ম্যাচকেই অফিশিয়াল বানানোর ইচ্ছাটা বোঝা যায়।’
তবু কি ওভালের সেই ম্যাচের গুরুত্ব এতটুকু কমে? এত দিনে রূপকথার চরিত্র হয়ে ওঠা অ্যালকক-ক্রফোর্ডদের প্রসঙ্গ অন্তত আজ তোলাই যায়। ওভালের সেই ম্যাচ যে হয়েছিল ১৮৭০ সালের ৫ মার্চ।
হ্যাঁ, ১৫৩ বছর আগে এই দিনে!