কে জানত, দশরথ স্টেডিয়ামের কাদামাখা মাঠে সাবিনা খাতুনদের পায়ে ফুটবল ফুল হয়ে ফুটবে!
বাংলাদেশের মেয়েরা নান্দনিক ফুটবলের পসরা সাজিয়ে উপহার দিয়েছে মনভরানো খেলা। সানজিদা আক্তারের ড্রিবলিং, সাবিনার ব্যাকহিল পাস মুগ্ধ করেছে খেলা দেখতে আসা প্রবাসী বাংলাদেশিদের। কৃষ্ণা রানী, মারিয়া মান্দাদের পায়ে বল পড়তেই ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’ বলে গলা ফাটিয়েছেন দর্শকেরা। ছোট–বড় লাল-সবুজ পতাকায় ছেয়ে গিয়েছিল গ্যালারি।
কাঠমান্ডুতে আজ দুপুরে মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে বাংলাদেশ পেয়েছে কাঙ্ক্ষিত জয়। পাকিস্তানকে ৬-০ গোলে উড়িয়ে দিয়েছেন সাবিনারা। হ্যাটট্রিক করেন সাবিনা। সাফের টুর্নামেন্টে এটি তাঁর দ্বিতীয় হ্যাটট্রিক। এর আগে ২০১৬ সাফে শিলিগুড়িতে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৬-০ গোলের জয়ে ৫ গোলই করেন বাংলাদেশের এই ‘গোলমেশিন’। সাফে এ পর্যন্ত ১৯ গোল করলেন সাবিনা। পরপর দুই ম্যাচে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পেলেন সাবিনা। ম্যাচে ১টি করে গোল করেন মণিকা চাকমা, সিরাত জাহান, ঋতুপর্ণা চাকমা।
পাকিস্তানের বিপক্ষে এই জয়ে সেমিফাইনালে ওঠার পথও অনেক সহজ হয়ে গেল বাংলাদেশের। আজ সন্ধ্যায় টুর্নামেন্টের পরের ম্যাচে ভারত মালদ্বীপকে হারাতে পারলে সেমিফাইনালে পৌঁছে যাবে বাংলাদেশ। ১৩ সেপ্টেম্বর গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে বাংলাদেশ মুখোমুখি হবে ভারতের।
আট বছর পর আন্তর্জাতিক ফুটবলে ফেরা পাকিস্তানের বিপক্ষে অবশ্য জয়টা অনুমিতই ছিল। তবে ব্যবধান কত হবে, সেটাই ছিল দেখার বিষয়; যদিও পাকিস্তান দলে রয়েছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের নারী লিগে খেলা মারিয়া খান, সৈয়দা মাফারা ও জুলফিয়া নাজির। ম্যাচে দু–একবার অবশ্য বাংলাদেশের রক্ষণে ঢুকে আতঙ্ক ছড়িয়েছেন মারিয়া, জুলফিয়া। কিন্তু গোল হয়নি।
পাকিস্তান দলের বেশ কয়েকজন ফুটবলার বয়সে এগিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে। কিন্তু সাবিনা, সানজিদাদের অভিজ্ঞতা আর গতিময় ফুটবলের কাছে পেরে ওঠেনি পাকিস্তান। মালদ্বীপের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারেনি বাংলাদেশের মেয়েরা। তবে এবার আর সেই ভুল হয়নি। শুরু থেকেই আক্রমণে উঠেছে বাংলাদেশ।
মাঝমাঠে প্রাণভোমরা ছিলেন মণিকা চাকমা। নিজে গোল করেছেন, করিয়েছেনও। ৩ মিনিটে সাবিনার শট পাকিস্তানের ডিফেন্ডার মিশেল আকরাম রিসিভ করতে গিয়ে পড়ে যান। কিন্তু ওই গতিময় বলেই মণিকার জোরালো শট খুঁজে নেয় জাল। গোল করেই বাংলাদেশের মেয়েরা স্যালুট করেন দর্শকদের।
এমনিতেই রক্ষণ সামলে আক্রমণে ওঠার পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তানের কোচ আদিল মির্জার। কিন্তু শুরুতে গোল খেয়ে অতি রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলতে শুরু করে পাকিস্তান। মিনিট বিশেক রক্ষণে ছয় ফুটবলারকে দাঁড় করিয়ে দেয়াল বানিয়ে রাখা হয়।
কিন্তু এরপরই বাংলাদেশ খেলেছে আসল ফুটবল। পরিকল্পনামাফিক গোছানো ও ‘বিল্ডআপ’ ফুটবল খেলে ভেঙেছে পাকিস্তানের রক্ষণ। সাবিনার থ্রু পাস খুঁজে নেয় বক্সে থাকা সিরাত জাহান। আলতো টোকায় সিরাত এনে দেন ম্যাচের দ্বিতীয় গোল।
৩০ মিনিটে মণিকা মাঝমাঠ থেকে বল পায়ে বক্সের একটু ওপরে এসে সাবিনার উদ্দেশে পাস বাড়ান। পাকিস্তানের ডিফেন্ডার হাজেরা খান ক্লিয়ার করতে গেলে বল তার পায়ে লেগে উঠে যায় ওপরে। দারুণ টোকায় সুযোগ কাজে লাগান সাবিনা ৩-০। ম্যাচে সাবিনা নিজের দ্বিতীয় গোলটি করেছেন ৩৫ মিনিটে। আঁখির লং পাস ধরে ডান দিক থেকে ক্রস বাড়ান সানজিদা। গোলমুখ থেকে বল পেয়ে অনায়াসে বাকি কাজ সারেন সাবিনা ৪-০।
বিরতিতে যাওয়ার খানিক আগে পাকিস্তানের জুলফিয়া নাজির বল নিয়ে বক্সে ঢুকে গোলরক্ষক রুপনা চাকমাকে কাটিয়ে এগিয়ে যান। কিন্তু অরক্ষিত গোলবারে থেকে ডিফেন্ডার আঁখি সেই বলটি ক্লিয়ার করেন। এরপর ৫৯ মিনিটে মারিয়ার ক্রস থেকে দারুণ হেডে সাবিনা হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেছেন।
কৃষ্ণার বদলি হিসেবে নামা ঋতুপর্ণার গোলটাও ছিল দেখার মতো। ৭৭ মিনিটে বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া শট পাকিস্তানের গোলরক্ষক শাহিদ বুখারির মাথার ওপর দিয়ে জালে জড়ায়। এর আগে ২০১০ এসএ গেমসে একবার পাকিস্তানের মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে সেবার ২-০ গোলে পাকিস্তানকে হারিয়েছিল বাংলাদেশের মেয়েরা। অবশ্য ভুটানে ২০১৮ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে বয়সভিত্তিক সাফে বড় জয় পায় বাংলাদেশ। থিম্পুর চাংলিমিথাং স্টেডিয়ামে পাকিস্তানকে ১৭-০ গোলে উড়িয়ে দেন মারিয়া মান্দা, তহুরা খাতুনেরা।
বাংলাদেশ দল: রুপনা চাকমা, মাসুরা পারভীন, আঁখি খাতুন, শিউলি আজিম (নীলুফার ইয়াসমিন), মণিকা চাকমা, মারিয়া মান্দা, শামসুন্নাহার, সানজিদা আক্তার (মার্জিয়া), কৃষ্ণা রানী সরকার (ঋতুপর্ণা চাকমা), সিরাত জাহান (তহুরা) ও সাবিনা খাতুন (শামসুন্নাহার জুনিয়র)।