চুমু–কাণ্ডে চুরমার, সিটির ‘ত্রিমুকুট’, মেসি–রোনালদোর ‘বিপ্লব’
শেষ হওয়ার পথে আরেকটি বছর—২০২৩। কেমন ছিল খেলার এই বছর? ধারাবাহিক বর্ষপরিক্রমায় আজ ফিরে দেখা যাক আন্তর্জাতিক ফুটবল।
রোনালদোর সৌদি–যাত্রা ও ডমিনো–ইফেক্ট
বছরের শুরুতেই রোনালদোর কারণে আলোচনায় আসে সৌদি প্রো লিগ। রোনালদোর পর মেসি-এমবাপ্পেদের পেতে হাত বাড়ায় সৌদি লিগের ক্লাবগুলো। এ দুজনকে শেষ পর্যন্ত না পেলেও দলবদলে ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলোর কাঁপন ধরিয়ে দেয় প্রো লিগ। রোনালদোর সৌদি–যাত্রা ছিল মূলত ডমিনো ইফেক্টের (ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকা প্রভাব) মতো। রোনালদোর পর করিম বেনজেমা, সাদিও মানে, রবার্তো ফিরমিনো, জর্ডান হেন্ডারসন এবং রিয়াদ মাহরেজরা গিয়ে হাজির হন সৌদি লিগে। অর্থের হাতছানি পেয়ে ফুটবলারদের সৌদিমুখী হওয়া নিয়ে নিজেদের আতঙ্কের কথা জানান পেপ গার্দিওলা-ইয়ুর্গেন ক্লপের মতো বিশ্বসেরা কোচরা। এমনকি দলবদলেও ইউরোপের শীর্ষ লিগগুলোকে টেক্কা দিয়ে ওপরের দিকে উঠে আসে সৌদি লিগ। তবে এ বছরের দলবদল ইউরোপের জন্য স্রেফ ‘ট্রেলার’ ছিল। সামনের দিনগুলোয় হয়তো ফুটবল আরও বড় সুনামি হয়ে হাজির হবে সৌদি ক্লাবগুলো।
মেসির পায়ে ‘সকার’ হলো ফুটবল
পিএসজিতে কোণঠাসা হয়ে পড়া মেসির জন্য আক্ষরিক অর্থেই টাকার থলে নিয়ে হাজির হয়েছিল সৌদি আরবের ক্লাব আল হিলাল। একপর্যায়ে রোনালদোর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে মেসির সৌদি–যাত্রা মনে হচ্ছিল শুধুই সময়ের অপেক্ষা। এর মধ্যে মেসির ফের বার্সেলোনায় ফেরার সম্ভাবনাও বেশ উজ্জ্বল হয়েছিল। তবে দুই পক্ষকে ফাঁকি দিয়ে মেসিকে মায়ামির সৈকতের পাড়ে নিয়ে যায় ডেভিড বেকহামের ইন্টার মায়ামি। জুনে মেসির আগমনের ঘোষণাতেই মূলত বদলে যায় যুক্তরাষ্ট্রের খেলার দুনিয়া।
যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয়তায় পিছিয়ে থাকা ফুটবল আকস্মিকভাবে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসে। মেসিকে একপলক দেখার জন্য অন্য খেলা এবং হলিউডের তারকারা ভিড় জমান স্টেডিয়ামে। পাশাপাশি মাঠের খেলাতেও মায়ামিকে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দেন মেসি। কখনো শিরোপা না জেতা ক্লাবটিকে এনে দেন প্রথম শিরোপা (লিগস কাপ)। নিয়ে যান অন্য এক টুর্নামেন্টের (ইউএস ওপেন কাপ) ফাইনালেও। তবে মেসির হাত ধরে মায়ামি ও যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলের বদলে যাওয়ার এটি কেবল শুরু। নতুন বছরে দেখা মিলতে পারে আরও বড় চমকের।
‘অষ্টম স্বর্গে’ মেসি ও আর্জেন্টিনার জয়যাত্রা
ফুটবলের কাছে আমার আর কোনো চাওয়া–পাওয়া নেই—বিশ্বকাপ জয়ের পর ফুটবল থেকে এভাবে নিজের আকাঙ্ক্ষার ঝুলি গুটিয়ে নিয়েছিলেন মেসি। কিন্তু অর্জন কি আর এত সহজে পিছু ছাড়ে! বিশ্বকাপের পায়ে পায়ে হেঁটে গত অক্টোবরে এসেছে অষ্টম ব্যালন ডি’অর ট্রফিটিও। ব্যক্তিগত এ অর্জনে মেসির ধারেকাছেও এখন আর কেউ নেই। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা রোনালদোর দখলে আছে পাঁচটি ব্যালন ডি’অর। কিন্তু ৩৯ ছুঁই ছুঁই রোনালদোর মেসিকে ছোঁয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
ভবিষ্যতে কারও মেসিকে ছুঁতে হলে অবিশ্বাস্য কিছুই করে দেখাতে হবে। মেসির এ অর্জন যেন আর্জেন্টিনার বছরজুড়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের প্রতীকও। বিশ্বকাপ জেতা দলটি প্রথমে প্রীতি ম্যাচে এবং পরে বিশ্বকাপ বাছাইয়েও ধরে রাখে দুর্দান্ত ছন্দ। এর মধ্যে ব্রাজিলকে মারাকানায় ১-০ গোলে হারিয়েছেন মেসিরা। আর বছরের একমাত্র হারের স্বাদ আর্জেন্টিনা পেয়েছে মার্সেলো বিয়েলসার উরুগুয়ের কাছ থেকে। নিজেদের মাঠে ২-০ গোলে হেরেছিল লিওনেল স্কালোনির দল।
স্প্যানিশ মেয়েদের বিশ্বজয়
শিরোপা জিততে স্পেনের ছেলেদের বিশ্বকাপ খেলতে হয়েছিল ১৩ বার। সেখানে তৃতীয়বার বিশ্বকাপ খেলতে এসেই বাজিমাত করে স্পেনের মেয়েরা। যদিও ছেলেদের সঙ্গে একটি মিল আছে স্পেনের নারী দলের। দুই দলই প্রথমবার ফাইনালে উঠেই ট্রফি নিয়ে ঘরে ফিরেছে। সিডনিতে ইংল্যান্ডের মেয়েদের ১-০ গোলে হারায় স্পেনের মেয়েরা। তবে স্প্যানিশ মেয়েদের এমন ঐতিহাসিক অর্জন ঢাকা পড়ে যায় এক বিতর্কিত ঘটনায়।
চুমু–কাণ্ডে চুরমার রুবিয়ালেস
সিডনিতে স্প্যানিশ নারীদের বিশ্বকাপ জয়ের ঘটনা দ্রুত ম্লান হয়ে যায় বিতর্কিত এক চুমু-কাণ্ডে। ফাইনালের পর পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে স্প্যানিশ ফুটবলার হেনি হেরমোসোর ঠোঁটে চুমু খান স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি রুবিয়ালেস। এরপরই ফুটবল–বিশ্বে বিতর্কের ঝড় ওঠে। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে রুবিয়ালেসের পদত্যাগ ও শাস্তির দাবি আসতে থাকে। এ ঘটনায় হেরমোসো মামলা করলে আরও চাপে পড়েন রুবিয়ালেস। তবে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে পদে অটল থাকার কথাও জানান রুবিয়ালেস। এরপরও অবশ্য শেষ রক্ষা হয়নি। একপর্যায়ে স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতির পদ থেকেই শুধু নয়, উয়েফার নির্বাহী কমিটির সহসভাপতির পদ থেকেও সরে দাঁড়ান তিনি। ফিফাও তাঁকে ফুটবলীয় কার্যক্রম থেকে বরখাস্ত করে। বছরের আলোচিত ‘খলনায়ক’–এর তালিকাতেও ঠাঁই পেয়েছেন রুবিয়ালেস।
সিটির ট্রেবল এবং আরও...
ট্রফি ক্যাবিনেটে একটি চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফি যোগ করতে তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষা করে ছিল ম্যানচেস্টার সিটি। তবে ২০২০-২১ সালে ফাইনালে খেলে চেলসির কাছে ১-০ গোলে হারটাই ছিল চ্যাম্পিয়নস লিগে গত বছর পর্যন্ত ম্যান সিটির সর্বোচ্চ অর্জন। সেই অর্জনকে অবশেষে এ বছর ছাপিয়ে গেছে সিটি। ইন্টার মিলানকে ফাইনালে ১-০ গোলে হারিয়ে নিজেদের প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জিতে নিয়েছে পেপ গার্দিওলার দল। পাশাপাশি এফএ কাপ ও প্রিমিয়ার লিগ জিতে ঐতিহাসিক ‘ট্রেবল’ নিশ্চিত করে তারা। তবে সিটির ট্রফি জয়ের ধারা এটুকুতেই থামেনি। এরপর উয়েফা সুপার কাপ এবং ক্লাব বিশ্বকাপের ট্রফি জিতে অর্জনের ষোলোকলা পূর্ণ করেছে ক্লাবটি।
ব্রাজিলের দুরবস্থা ও সান্তোসের রেলিগেশন
ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ঐতিহ্যের অন্যতম প্রতিনিধি সান্তোস। ফুটবলের রাজা পেলের ক্লাব হিসেবেই সবাই চেনে সান্তোসকে। এমনকি ব্রাজিলের হালের সেনসেশন ও ইতিহাস–সেরা গোলদাতা নেইমারের আঁতুড়ঘরও এই সান্তোস। আর সেই সান্তোসই কিনা ১১১ বছরের ইতিহাসের প্রথমবারের মতো অবনমনের শিকার হয়ে পরের বিভাগে চলে গেল। একে চাইলে অবশ্য ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের বর্তমান দুরবস্থার প্রতীক হিসেবে দেখা যায়। এখন সামনের বছর ব্রাজিলের ফুটবল ও সান্তোস ঘুরে দাঁড়াতে পারে কি না সেটাই দেখার অপেক্ষা।