বাফুফেতে কর্মকর্তা জিন্দাবাদ, কোচ মঞ্চ থেকেই বাদ
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) আগামী দু–এক দিনের মধ্যেই সম্ভবত একটি তালিকা করবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠাতে সেই তালিকার বড় অংশজুড়েই থাকবেন কর্মকর্তারা। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হবে, তাঁর হাত থেকে আর্থিক পুরস্কার নেওয়া যাবে। অনূর্ধ্ব–২০ নারী সাফে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর যখন এমন একটা সুযোগ দুয়ারে আসি আসি করছে, তা কে হাতছাড়া করে! সুতরাং তালিকায় নামের কমতি হবে না, হতে দেওয়া যাবে না।
তাতে কোচ-টোচ কেউ বাদ পড়লে পড়ুক। কী আসে যায়! কর্মকর্তারা যেতে পারলেই তো হলো। অতীতে নানা স্তরের ফুটবল কর্মকর্তারা সেই কাজটাই করেছেন। এখনো সেই ধারা চলছে এবং মনে হয় না সেখান থেকে শিগগির বেরিয়ে আসা সম্ভব।
প্রসঙ্গটা কেন টানা হলো তা বলা যাক, গতকাল রাতে কমলাপুর স্টেডিয়ামে মেয়েদের সাফ অনূর্ধ্ব-২০ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর বাংলাদেশ দলের গোলকিপিং কোচ মাসুদ আহমেদ মঞ্চে উঠে পদক নিতে পারেননি। না, ভুল করে তাঁর নাম বাদ পড়েনি। জেনেবুঝে সুস্থ মস্তিষ্কে কোচ মাসুদ আহমেদের নামটা বাদ দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ দল যখন শিরোপা উৎসব করছিল, টুর্নামেন্টজুড়ে রুপনা চাকমাদের গোলকিপিং কোচের দায়িত্বে থাকা মাসুদ আহমেদ তখন নীরবে মাঠ ছেড়ে যান। পরে পদক দেওয়া হলেও জানা গেছে, কর্তাদের মঞ্চে ওঠার সুযোগ করে দিতেই কেটে দেওয়া হয়েছিল গোলকিপার কোচের নাম। এটা বোধ হয় শুধু বাংলাদেশের ফুটবলেই সম্ভব!
বাংলাদেশের এই চ্যাম্পিয়ন দলটির কর্মকর্তাদের তালিকা এত দীর্ঘ যে এ নিয়ে গত কয়েক দিন প্রচুর হাসাহাসি হয়েছে। কারণ, এ রকম পৃথিবীর আর কোথাও নেই। হ্যাঁ, অতীতেও অনেক সময় কর্তাদের তালিকা দীর্ঘ ছিল, কিন্তু এবারের মতো এত হাস্যকর পর্যায়ে নামেনি। অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফের জন্য এবার ২৩ জন ফুটবলারের সঙ্গে রাখা হয়েছে ১৪ জন কোচ-কর্মকর্তা! কোচ বেশি থাকলে সমস্যা নেই। কিন্তু কর্তা এত বেশি যে তাঁদের কার কী পদবি, সেটা মনে রাখাই কঠিন।
দলের ‘টিম লিডারই’ দুজন! দুই টিম লিডারের সঙ্গে আছেন দুজন সহকারী টিম লিডারও। তার মানে সব মিলিয়ে চারজন। ২৭ বছরের ক্রীড়া সাংবাদিকতা জীবনে একটি ক্রীড়া দলে চারজন টিম লিডার আর সহকারী টিম লিডারের বহর দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এর বাইরে ছিলেন বাফুফের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পল স্মলিও। অবশ্য স্মলি তো থাকবেনই। যেখানে মেয়েদের ফুটবল, সেখানেই তিনি; ছেলেদের ফুটবলে তাঁকে দেখা যাক বা না যাক।
গত রাতে মেয়েদের ফুটবলে পুরস্কার বিতরণীর সময় দেখা যায়, পদক নেওয়াদের তালিকায় উঠে গেছে দলনেতা-২ জাকির হোসেন চৌধুরী ও দুই সহকারী দলনেতা টিপু সুলতান এবং নুরুল হোসেনের নাম। গোলরক্ষক কোচের নাম ডাকা হয়নি মঞ্চে। অপমানে মাঠ ছেড়ে যান কোচ মাসুদ। খেলোয়াড়দের অনুরোধে অবশ্য পুরস্কার বিতরণীর পর মাঠে ফিরেছেন।
বাফুফেতে বেশির ভাগ কর্মকর্তাই আসেন দলের সঙ্গে বিদেশ সফরে যেতে। কয়েক বছর ধরে নতুন সংস্কৃতি মেয়েদের দলের সঙ্গে থাকার চেষ্টা। যেকোনো টুর্নামেন্টে মেয়েদের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ভালো সম্ভাবনা থাকে। আর চ্যাম্পিয়ন হলেই তো রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে পুরস্কার–সংবর্ধনার হাতছানি। অন্তত অতীতে তাই দেখা গেছে। মেয়েদের দলের সঙ্গে থাকার একটা সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা তাই সৃষ্টি হয়েছে অনেক কর্মকর্তার মধ্যে। এই সুযোগে এমন লোকের নামও তালিকায় ঢুকে যায়, মেয়েদের ফুটবল দেখতে যাঁরা কখনো মাঠেও যান না। শুধু ছবি তোলার সময় সবার আগে হাজির।
মেয়েদের দলে কর্মকর্তাদের দীর্ঘ বহর নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল বাফুফের নারী ফুটবল কমিটির প্রধান মাহফুজা আক্তারের কাছে। তাঁর ব্যাখ্যা, তাঁরা সবাই মেয়েদের ফুটবলে কাজ করেন। তাই তাঁদের নাম রাখা। তবে ফুটবলাঙ্গন বিষয়টাকে অন্যভাবেই দেখছে। সামনেই বাফুফের নির্বাচন। ভোটের সময় তো এই মানুষদেরই দরকার হবে। কাজেই তাদের যতটা সম্ভব তুষ্ট রাখা যায়।
মাহফুজা আক্তারের কাছে ফোনে জানতে চাওয়া হয়েছিল, গোলকিপিং কোচ মাসুদকে কেন মঞ্চে ডাকা হলো না? তাঁর উত্তরের শুরুটা ছিল পাল্টা প্রশ্নে, ‘পদক নিতে মঞ্চে উঠতে হবে কেন?’ তো চ্যাম্পিয়ন দলের গোলকিপার কোচ মঞ্চে উঠে পদক নিতে পারবেন না, কিন্তু বাফুফের কর্মকর্তারা ঠিকই মঞ্চে থাকবেন! এবার মাহফুজা আক্তার বলার চেষ্টা করলেন, ‘ওনাকে তো ডাকা হয়েছে। পদকও দেওয়া হয়েছে।’ আসলে তা নয়। গোলকিপিং কোচ মাসুদকে পদক দেওয়া হলেও সেটি দেওয়া হয়েছে পরে, পুরস্কার বিতরণীর মঞ্চে নয়। সংবাদমাধ্যমে এসব নিয়ে সমালোচনারও পাল্টা দিতে চাইলেন বাফুফের নারী ফুটবল কমিটির প্রধান, ‘এসব অপপ্রচার। আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করে লেখা হয়।’
গত সেপ্টেম্বরের দৃশ্যটা মনে পড়ে যায়। মেয়েদের জাতীয় দল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে কাঠমান্ডু থেকে ফিরে আসার পর বাফুফে ভবনের সংবাদ সম্মেলনে কোচ গোলাম রব্বানী এবং অধিনায়ক সাবিনা খাতুনকে চেয়ার ছেড়ে কর্তাদের পেছনে গিয়ে দাঁড়াতে হয়েছিল। আসলে এটাই যেন বাংলাদেশের ফুটবলে অলিখিত রীতি—খেলোয়াড়, কোচের আগে কর্মকর্তা জিন্দাবাদ!