ফাইনাল যেন ‘এলএম ১০’ বনাম ‘কেএম ১০’
একজনের বয়স ৩৫, অন্যজনের ২৩। ১২ বছরের ব্যবধানে বন্ধুত্ব হওয়া একটু কঠিনই। একই ক্লাবে খেলেও তাঁরা ঠিক বন্ধু নন। তবে মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। একে অন্যের আয়নাও। বলা হচ্ছে লিওনেল মেসি ও কিলিয়ান এমবাপ্পের কথা। আগামী দুই দিন ফুটবল–দুনিয়ায় নিশ্চিতভাবে সবচেয়ে আলোচিত হবে এ দুটি নাম। যাঁদের কাঁধে ভর করে আছে দুটি দেশের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন।
আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের স্বপ্নের বোঝা কাঁধে নিয়ে বিশ্বকাপের মঞ্চে এসেছেন মেসি। ২০০৬ বিশ্বকাপ থেকে প্রতিবারই তাঁকে ফিরতে হয়েছে হতাশা নিয়ে। ২০১৪ বিশ্বকাপে খুব কাছে গিয়েও ছোঁয়া হয়নি সোনালি ট্রফি। গত বিশ্বকাপে এই এমবাপ্পের কাছে হেরে চোখের জলে বিশ্বকাপকে দ্বিতীয় রাউন্ডেই বিদায় বলতে হয়েছিল মেসিকে। আর এবার জিততে না পারলে চিরস্থায়ী এক বেদনা নিয়ে কাটাতে হবে বাকি জীবন। তাই অনেক হিসাব আর সমীকরণ মেলানোর এক ফাইনাল এখন মেসির সামনে।
মেসির ক্যারিয়ারে অসামান্য সব অর্জন। গোল আর গোলে সহায়তার হিসাব বাদ দিলেও চারটি চ্যাম্পিয়নস লিগের পাশাপাশি এককভাবে সর্বোচ্চ সাতবার ব্যালন ডি’অর জিতেছেন আর্জেন্টাইন মহাতারকা। ফুটবল ইতিহাসে তাঁর অমরত্ব নিশ্চিত হয়ে গেছে আরও আগে। এরপরও বিশাল এক শূন্যতা নিয়ে প্রায় দেড় দশক ধরে প্রতি রাতে ঘুমাতে যান মেসি। একটা প্রশ্ন যেন প্রতি রাতে তাঁর কানে প্রতিধ্বনিত হয়—‘কই বিশ্বকাপ তো এখনো জিততে পারলে না!’ একটিমাত্র বিশ্বকাপ ট্রফি দিয়ে তাঁর মতো একজন কিংবদন্তিকে মাপার সুযোগ নেই। তবু মেসির স্বর্গারোহণের প্রাণপাখিটা যেন সেই সোনালি ট্রফিটিতেই লুকিয়ে। সেই পাখিকে ছুঁতে ‘এলএম টেন’র সবচেয়ে বড় বাধার নাম এমবাপ্পেই।
যে ট্রফির জন্য মেসি নিজের সব অর্জন ফিরিয়ে দিতে রাজি আছেন, সেই বিশ্বকাপ শিরোপা হেসেখেলে এমবাপ্পে জিতেছেন মাত্র ১৯ বছর বয়সে। শুধু তা–ই নয়, আরেকটি বিশ্বকাপ শিরোপা এখন হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাঁকে। টানা দুটি বিশ্বকাপ জয় এমবাপ্পেকে অর্জনের দিক থেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে যাবে, যেখানে আর কখনো পৌঁছানো হবে না মেসির, যা ফাইনালের মঞ্চে মেসি ও এমবাপ্পের এই দ্বৈরথকে দিচ্ছে ভিন্ন এক রোমাঞ্চ।
খেলার ধরন বিবেচনায় দুজনের মাঝেই রয়েছে ভিন্নতা। মেসি যদি হন শৈল্পিক পায়ের মায়াবী বিভ্রম, এমবাপ্পে সেখানে তীব্র গতিসম্পন্ন শত মাইল বেগে ধেয়ে আসা বুলেট ট্রেন। মেসি যদি হন ধ্রুপদের সুর, এমবাপ্পে সেখানে তুমুল রক অ্যান্ড রোল। এ দুজনের ফিউশনে পিএসজিও এ মৌসুমে পেয়েছে দারুণ সাফল্যও। তবে রোববার তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইটা অপরের বিরুদ্ধে।
দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জিততে এসে প্রত্যাশার দামটা কড়ায়–গন্ডায় দিয়েছেন তাঁরা। মেসি-এমবাপ্পে দুজনই গোল করেছেন ৫টি করে। মেসির সহায়তা ৩, এমবাপ্পের ২টি। একাধিক ম্যাচে এককভাবে পায়ের জাদুতে বদলে দিয়েছেন দৃশ্যপট। যখনই দুজনের পায়ে বল গেছে ম্যাচের পরিস্থিতি বদলানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সেমিফাইনালের ম্যাচ দুটির কথাই ধরা যাক।
বিশ্বকাপের সেরা ডিফেন্ডার ইওস্কো গাভারদিওলকে যেভাবে নাকাল করে মেসি হুলিয়ান আলভারেজকে গোলে সহায়তা করেছেন, তা অনেক দিন চোখে লেগে থাকার মতো। মেসির সেই সহায়তা যদি শিল্পীর তুলিতে আঁকা কোনো ছবি হয়, তবে ফ্রান্সের দ্বিতীয় গোলে এমবাপ্পে ঝড়ের গতিতে মরক্কোর রক্ষণকে যেভাবে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন, সেটিকে কী বলা যায়! তাঁর সেই ঝোড়ো আক্রমণ থেকেই পরে গোল করেন কোলো মুয়ানি। যেন চোখে চোখ রেখে লড়াই করা!
বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচ্যগ্র মেদিনী—ফাইনালেও এই মন্ত্র বুকে নিয়ে মাঠে নামবেন এ দুজন। এই একটি জয় যে বাকি জীবনের জন্য দুজনের সবকিছু বদলে দেবে। দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব তো রয়েছেই। তা ছাড়া এই ম্যাচ দিয়ে বিশ্বকাপের সঙ্গে গোল্ডেন বুট জয়ের সুযোগ আছে দুজনের। গোল্ডেন বলের লড়াইয়েও নিশ্চিতভাবে আছেন এ দুজন। আর বিশ্বকাপ জয় মেসিকে অষ্টমবারের মতো এবং এমবাপ্পেকে প্রথমবারের মতো এগিয়ে দেবে ব্যালন ডি’অরের লড়াইয়ে।
এখন সেরার মঞ্চে চূড়ান্ত বিজয়ী কে হবেন, তা জানতে তাকিয়ে থাকতে হবে রোববারের ফাইনালের দিকে। সেদিন কি মেসি পারবেন বিশ্বকাপ শিরোপা উঁচিয়ে ডিয়েগো ম্যারাডোনার সঙ্গে আকাশি-সাদায় মিশে চিরন্তন হয়ে যেতে, নাকি ফুটবল–দুনিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী হবে এমবাপ্পে-রাজের?